অভিযোগের কোনো সত্যতা না পেয়ে ডালাস-ফোর্ট ওয়ার্থ এলাকায় মুসলিমকেন্দ্রিক একটি পরিকল্পিত আবাসিক উন্নয়ন প্রকল্প, ‘এপিক সিটি’ নিয়ে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে শুরু হওয়া ফেডারেল তদন্ত বন্ধ করে দিয়েছে মার্কিন বিচার বিভাগ। গত ১৩ জুন কমিউনিটি ক্যাপিটাল পার্টনার্স নামে প্রকল্পটির উন্নয়ন সংস্থাকে লেখা এক চিঠিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাটর্নি জেনারেল হরমিত ঢিল্লন জানান, এই তদন্ত বন্ধ করা হচ্ছে এবং এর ফলে কোনো মামলা বা অভিযোগ আনা হচ্ছে না। টেক্সাসের রিপাবলিকান সিনেটর জন করনিন এই প্রকল্পের পেছনে ‘ধর্মীয় পক্ষপাতিত্ব’ বা ‘শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা’ রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার আহ্বান জানানোর পরই বিচার বিভাগ এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করে। এই প্রকল্পটি পরিকল্পনা করেছে ইস্ট প্লানো ইসলামিক সেন্টার। তাদের লক্ষ্য, ডালাস শহরের উত্তর-পূর্বে জোসেফিন এলাকায় ৪০০ একর জমিতে একটি পরিকল্পিত বহুমুখী আবাসিক কমিউনিটি গড়ে তোলা।
প্রস্তাবিত এপিক সিটিতে এক হাজারের বেশি আবাসিক ইউনিট, একটি স্কুল, খুচরা ব্যবসার এলাকা, পার্ক এবং একটি কেন্দ্রীয় মসজিদ থাকার কথা রয়েছে। এটি একটি লাভজনক বেসরকারি উদ্যোগ, যার পেছনে রয়েছেন মূলত। উত্তর টেক্সাসের অন্যতম বৃহৎ মসজিদ ইস্ট প্লানো ইসলামিক সেন্টারের সদস্যরা। উদ্যোক্তারা জানান, যদিও এটি মুসলিম পরিবারগুলোর কথা ভেবে পরিকল্পিত, প্রকল্পটি সব ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। তাদের লক্ষ্য একটি নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ, বহু সাংস্কৃতিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা। তবে টেক্সাসের রক্ষণশীল রাজনৈতিক মহলে এ প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। সিনেটর করনিন, টেক্সাস গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট ও অ্যাটর্নি জেনারেল কেন প্যাক্সটনসহ একাধিক রিপাবলিকান নেতা দাবি করেন, এই প্রকল্পে মুসলিম শুধু সম্প্রদায় গঠনের চেষ্টা হচ্ছে, যেখানে শরিয়া আইন চালু হতে পারে, যদিও এর পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা বিচার বিভাগে জমা দেননি। বিশেষ করে একটি পুরোনো অনলাইন বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে বিতর্ক তৈরি হয়, যেখানে লেখা ছিল, আমরা শুধু এমন ব্যক্তিদের জন্য বিক্রয় সীমিত রাখবো, যারা আমাদের সম্প্রদায়ের গঠনে অবদান রাখবেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে সম্পত্তি কিনতে ও বিনিয়োগে আইনি যোগ্যতা রাখেন।
সিনেটর করনিন দাবি করেন, এই বক্তব্য ফেয়ার হাউজিং আইনের লঙ্ঘন করতে পারে। প্রকল্পটির পক্ষে আইনজীবী ড্যান কগডেল বলেন, বিচার বিভাগের কাছ থেকে আমরা যে প্রতিক্রিয়া পেয়েছি তাতে আমরা সন্তুষ্ট। অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাটর্নি জেনারেল ঢিল্লন ও তার টিম অত্যন্ত পেশাদার, দায়িত্বশীল ও সহযোগিতাপূর্ণ ছিলেন। কমিউনিটি ক্যাপিটাল পার্টনার্স একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক কমিউনিটি গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর এবং তারা ফেয়ার হাউজিং আইনের সব নিয়ম মেনে চলে। বিচার বিভাগ এই বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে-এটি আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। প্রকল্পের উন্নয়নকারী সংস্থা বারবার বলেছে যে, তারা ফেডারেল ও স্টেট আইন মেনে চলবে এবং প্রকল্পটি সব ধর্মের মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
তবে বিচার বিভাগীয় তদন্ত ছিল এপিক সিটিকে ঘিরে পরিচালিত বেশ কয়েকটি তদন্তের মধ্যে একটি মাত্র। টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট অন্তত পাঁচটি স্টেট সংস্থাকে এপিক সিটি এবং এর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে বলেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, প্রকল্পটি ও এর সহযোগী সংস্থাগুলো সম্ভাব্য অবৈধ কার্যকলাপে জড়িত। সম্প্রতি তিনি একটি নতুন আইনেও স্বাক্ষর করেছেন, যার উদ্দেশ্য এই ধরনের প্রকল্পের ব্যবসায়িক কাঠামো, বিক্রয় প্রক্রিয়া এবং বিনিয়োগকারীদের অধিকার আরো স্বচ্ছ করা। আইনটির প্রধান রচয়িতা ছিলেন রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা ক্যান্ডি নোবেল। তার ভাষ্য অনুযায়ী, এই আইন মূলত সেই বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেবে যারা সম্পত্তি নয়, বরং প্রকল্পের ব্যবসায়িক অংশ কিনছেন।
কমিউনিটি ক্যাপিটাল পার্টনার্স জানিয়েছে, এই নতুন আইন তাদের প্রকল্পে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। বর্তমানে প্রকল্পটি নির্মাণাধীন নয়; এখন পর্যন্ত ট্রাফিক বিশ্লেষণ, বন্যা ও পরিবেশগত সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি জুলাই বা আগস্ট মাসে উন্নয়নের আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের জন্য আবেদন করার পরিকল্পনা করছে। উল্লেখ্য, সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপের মধ্যেও প্রকল্পের প্রথম ধাপের ৫০০টি প্লট ছয় মাসের মধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে এবং বর্তমানে দ্বিতীয় ধাপের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে আবেদন নেওয়া হচ্ছে।
প্রকল্পের আইনজীবী কগডেল বলেন, এই প্রকল্প নিয়ে যতগুলো তদন্ত হচ্ছে, তার মূলে রয়েছে ধর্মীয় প্রোফাইলিং। যদি এটি কোনো গির্জা বা মন্দিরকেন্দ্রিক হতো, তবে এভাবে সন্দেহ করা হতো না। তিনি আরো বলেন, এই মানুষগুলো মার্কিন নাগরিক, আইন মেনে চলা মানুষ এবং টেক্সাসের বাসিন্দা। এপিক সিটিকে ঘিরে যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে, তা অনুচিত, বিভাজনমূলক এবং গভীর উদ্বেগের বিষয়। এই ঘটনাপ্রবাহ আবারও যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতা, ফেডারেল বনাম রাজ্য অধিকার এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি সরকারের মনোভাব নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
বিচার বিভাগ যেহেতু কোনো ধরনের বৈষম্যের প্রমাণ পায়নি এবং তদন্ত বন্ধ করেছে, এটি প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনগত বিজয় বলে বিবেচিত হচ্ছে। এখন স্টেট পর্যায়ের তদন্তগুলো কী ফলাফল বয়ে আনে, তার ওপর নির্ভর করছে এপিক সিটি প্রকল্পের ভবিষ্যৎ। এপিক সিটি প্রকল্পকে কেন্দ্র করে টেক্সাসে যে বিতর্ক ও তদন্ত শুরু হয়েছিল, তা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এসে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ যখন কোনো বৈষম্য বা আইনি লঙ্ঘনের প্রমাণ না পেয়ে তদন্ত বন্ধ করে দিয়েছে, তখন এটি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের জন্য এক বড় আইনি বিজয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে এই প্রকল্প এখনো পুরোপুরি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ থেকে মুক্ত নয়। রাজ্য পর্যায়ে একাধিক তদন্ত চলমান থাকায় ভবিষ্যতের পথ সহজ হবে না।
এ ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে, ধর্মীয় পরিচয় বা সম্প্রদায়ভিত্তিক উদ্যোগকে ঘিরে আমেরিকার কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে এখনো সংশয় ও অবিশ্বাস বিদ্যমান, যা নাগরিক স্বাধীনতা ও সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এপিক সিটি কেবল একটি আবাসিক প্রকল্প নয়, বরং এটি আজ এক বৃহৎ সামাজিক ও সাংবিধানিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু- যেখানে প্রশ্ন উঠছে ধর্মীয় স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং আমেরিকান স্বপ্নের সর্বজনীনতা নিয়ে। ভবিষ্যতে এই প্রকল্প কীভাবে এগোয় এবং আইনি ও সামাজিক বাধাগুলো কতটা সফলভাবে অতিক্রম করতে পারে, তা গভীরভাবে লক্ষ করার বিষয়।