২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০২:৫৩:১৫ পূর্বাহ্ন


উত্তাপ ছড়াচ্ছে পিটার হাসের ‘নিরাপত্তা শঙ্কা’
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-১০-২০২৩
উত্তাপ ছড়াচ্ছে পিটার হাসের ‘নিরাপত্তা শঙ্কা’ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস


ক্রমশই উত্তাপ ছড়াচ্ছে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার বিষয়টি। হঠাৎ করেই মার্কিন রাষ্ট্রদূত তার নিজের ও মার্কিন দূতাবাসসহ মার্কিন দূতাবাসের অধীনে যেসব অফিস বিদ্যমান তাতে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশের পর এ আলোচনা দিন দিন বাড়ছে। কারণ বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের অধীনে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে ইউএস এইডসহ। এছাড়াও বাংলাদেশে শেভরনের মতো প্রতিষ্ঠানও গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। ফলে বাংলাদেশে তাদের ইনভেস্ট অনেক। এতে করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে যদি শেষ পর্যন্ত বের করে দেওয়া হয়, তার স্থানে অনুরূপ আরো একজন আসবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সম্ভব্য নতুন রাষ্ট্রদূতের নীতিও পিটার হাসের মতো হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। কারণ একজন রাষ্ট্রদূত চলেন সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায়, এটাই স্বাভাবিক। 

তবে রাষ্ট্রদূতকে বের করে দেওয়া বা ফেরত নেওয়া বা রাখার ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রে এর ব্যাতিক্রমও ঘটে। সেটা একান্ত সে দেশেরই ইচ্ছাশক্তির ওপর নির্ভরশীল। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে তারা, তাদের রাষ্ট্রদূত বাড়তি কোনো কিছু করছেন কি না যা দুই দেশের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যদি সেটা না হয়, তাহলে তাকে টিকিয়ে রাখারও চেষ্টা করা হতে পারে। এক্ষেত্রে মার্কিনিদের যে নীতি সেটা হলো, রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের কর্মচারী সংখ্যা হ্রাস করে সেখানে কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়ে আসা এবং এটা হলে হয়তো বাংলাদেশ থেকে জরুরি ভিসা ছাড়া অন্যান্য ভিসা প্রসেসিংয়ে স্থবিরতা নেমে আসতে পারে। কারণ বিশাল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তার ইস্যু যখন, তখন নিরাপত্তা ইস্যুতে তাদের সাময়িক বরখাস্ত বা ছুটি বা চাকরিচ্যুত করার উদ্যোগ নিতে পারে দূতাবাস, তাদের কর্মপরিধি ছোট করার নিমিত্তে। কারণ মার্কিনিরা তাদের অফিস ও কর্মচারীদের নিরাপত্তাকে ভীষণভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আর যদি এগুলোতে তারা না যান, সবকিছু বহাল রাখতে চান, সে ক্ষেত্রে দূতাবাস ও রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তার জন্য বাড়তি তাদের নিজস্ব ইউএস সিকিউরিটিও নিয়োগ দিতে পারেন। এতে বাংলাদেশে তাদের জনবল আরো বৃদ্ধি পাবে। চারদিকে এসব আলোচনাই এখন ডালপালা মেলছে। তবে পিটার হাসের এ শঙ্কার শেষ পরিণতি কোন দিকে যাচ্ছে সেটা এখনো অজ্ঞাত। 

কী বলেছিলেন পিটার হাস 

গত ২৪ সেপ্টেম্বর চ্যানেল ২৪-এর টকশো মুক্তবাকে অংশ নিয়ে বাংলাদেশে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, ‘আমি শুধু আমার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত নই। সেই সঙ্গে দূতাবাসসহ যারা সেখানে কাজ করেন, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।’ সেইসঙ্গে তিনি জানান, অবাধ, সুষ্ঠু  এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থেই ভিসানীতি প্রয়োগ করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। সরকারি দল, বিরোধীদল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর এবার বিচার বিভাগ এবং গণমাধ্যমও ভিসানীতিতে যুক্ত হতে পারে বলে সতর্কবার্তা দেন তিনি।

রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এখন দেখার বিষয় কতটা নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য পরিচালিত হচ্ছে। প্রভাবমুক্তভাবে বিচারকার্য চলছে কি না।’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটি কোনো স্বাধীন দেশের ওপর হস্তক্ষেপ নয়।’ এক প্রশ্নের জবাবে পিটার হাস বলেন, কত জনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, তা মুখ্য বিষয় নয়। আগামীতে গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।  

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার

পিটার হাসের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রসঙ্গে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা সম্পর্ককে মূল্যায়ন করে। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ সরকার ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাস ও সেখানে কর্মরত আমাদের কর্মীদের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে বলে জানিয়েছেন তিনি। গত ২৬ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে এমন মন্তব্য করেন মিলার। 

প্রশ্ন ছিল, তার (পিটার হাস) এই উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। কারণ আমরা বর্তমান সরকারের অধীনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ওপর কয়েকটি হামলা দেখেছি। এখন প্রশ্ন হলো, পিটার হাসের এই উদ্বেগ কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছেন? জবাবে মিলার বলেন, অবশ্যই কূটনৈতিক কর্মীদের নিরাপত্তা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ বিষয়ে আমরা আলোচনা করতে যাচ্ছি না। কূটনৈতিক সম্পর্কের ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে, দূতাবাস ও সব কূটনৈতিক কর্মীকে রক্ষার দায়িত্ব আয়োজক দেশের। তাদের ওপর আক্রমণ প্রতিরোধে সব কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে আয়োজক দেশকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা সম্পর্ককে মূল্যায়ন করে। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ সরকার আমাদের কর্মীদের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে।  

১৯০ জন বিশিষ্টজনের বিবৃতি 

মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের গণমাধ্যমের কর্মীদের প্রসঙ্গে ভিসানীতি দেওয়ার কথা বলার পর দেশের ১৯০ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে বলা হয়, গণমাধ্যমে ভিসানীতি প্রয়োগের ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নীতির পরিপন্থী। বাংলাদেশে সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যম একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। উগ্রবাদী শক্তি, জঙ্গি, জামায়াত ইসলামীর মতো যুদ্ধাপরাধীর দল, সন্ত্রাসী যা প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলোকে নির্মূল করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরিতে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম। এর ফলে বাংলাদেশ তালেবানের মতো একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, গণমাধ্যমের ওপর ভিসানীতি নিয়ে হাসের বক্তব্যটি কট্টরপন্থী ও স্বাধীনতাবিরোধীরা স্বাগত জানিয়েছে। এই স্বাগত জানানো পক্ষটি অন্যান্য নীতিতে পশ্চিমাদের নিন্দা করে, মুক্তচিন্তকদের শত্রু মনে করে এবং ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধীদের দায়মুক্তির পক্ষে। হাসের বক্তব্যকে জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত ‘বাঁশের কেল্লা’ নামের ফেসবুক পেজ থেকে স্বাগত জানিয়ে পোস্ট করা হয়েছে। যেখানে হাসকে ‘একজন সত্যিকারের বন্ধু’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অতীতে এই পেজে ব্লগার ও মুক্তচিন্তকদের হত্যার পক্ষে নানা বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে। ফলে এই পেজে হাসের বিবৃতি নিয়ে উল্লাস আসলে ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিকদের জন্য নিগূঢ় বার্তা দেয়। 

বিবৃতিতে লেখক, অধিকারকর্মী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য, যুদ্ধাপরাধবিরোধী প্রচারক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ মোট ১৯০ জন বিশিষ্ট নাগরিক সই করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, শিক্ষাবিদ শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, শহিদ জায়া সালমা হক, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, আইনজীবী ও বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাণা দাশগুপ্ত, চলচ্চিত্রনির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ, ক্যাপ্টেন (অব.) আলমগীর সাত্তার বীর প্রতীক প্রমুখ। 

পিটার হাসকে বের করে দেওয়া উচিত: মানিক 

মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে বাংলাদেশ থেকে বের করে দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। সম্প্রতি বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে অংশ নিয়ে তিনি এই কথা বলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বাস্তবতা হলো তাদের কোনো অধিকার নেই। সুতরাং দে মাস্ট বি কোয়াইট। তারা চুপ করে থাকবে। আমি যেটা বললাম, তাদের ভিসানীতি দেখে দিনের শেষে কিন্তু তারাই লজ্জিত হবে। আর হিউম্যান রাইটসের কথা, যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে আমাদের হিউম্যান রাইটস অনেক বেশি। যে দেশে প্রতিদিন পুলিশ কালো লোকদের গুলি করে মারছে। এগুলো কি আমরা চোখে দেখি না? তাই আমাদের এখন উচিত তাদের ইগনোর করা এবং তাদের যে রাষ্ট্রদূত এগুলো কথা বলছে তাকে বের করে দেওয়া।’ শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক আরও বলেন, ‘আমার কথা খুব সোজাসাপটা। তাকে বের করে দেওয়া। যেহেতু তিনি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছেন, ডিপ্লোম্যাটিক আইন লঙ্ঘন করছেন।’

ছাত্রলীগের সাবেক সেক্রেটারি নাজমুল 

এছাড়াও ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে নিজ দেশে ফিরে যেতে বললেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে এ আহ্বান জানান তিনি। ফেসবুক পোস্টে নাজমুল লেখেন, ‘আমরা আপনার কর্মকাণ্ডে খুবই উদ্বিগ্ন, আপনি বাংলাদেশে ইতিমধ্যে আপনারা সীমা লঙ্ঘন করেছেন। মনে রাখবেন, এটি ১৯৭৫ সাল নয়, এটি ২০২৩। এখন আমাদের জনগণ অনেক ঐক্যবদ্ধ ও আপনাদের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের) নোংরা এজেন্ডা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। দয়া করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিরে যান।’ 

সর্বশেষ

এদিকে সর্বশেষ দুই দিনের সরকারি সফরে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলার অ্যাফেয়ার্স সম্পর্কিত অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি রেনা বিটার। ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে এসে পৌঁছান তিনি ঢাকায়। সফরকালে তিনি কনস্যুলার ইস্যু নিয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ঢাকায় আসার আগে তিনি পাকিস্তানের ইসলামাবাদ ও করাচি সফর করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর জানিয়েছে, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি রেনা বিটার দূতাবাস ও কনস্যুলেট কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং কনস্যুলার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন।

যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র বলেন, ‘তার সফর বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রর নাগরিকদের সুরক্ষা এবং যুক্তরাষ্ট্রে বৈধ ভ্রমণ ও অভিবাসনের সুবিধার প্রতি আমাদের গভীর ও টেকসই অঙ্গীকারকে তুলে ধরে।’ ফলে রেনা বিটারের সফরটাও এ নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ের সঙ্গে জড়িত। হয়তো বিষয়টা সেভাবে কেউ আমলেই নেয়নি। কিন্তু নিরাপত্তাটা মার্কিনীদের। তাদের কাজটা তারা ঠিকই করবেন এটাই বাস্তবতা।

শেয়ার করুন