২৬ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ১০:০১:০২ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :


হাহাকার বাড়ছে শিল্পখাতে
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-১১-২০২২
হাহাকার বাড়ছে শিল্পখাতে


বিদ্যুৎ জ্বালানির তীব্র সংকটে হাহাকার করছে বাংলাদেশের শিল্পকারখানাসমূহ। মার্কিন ডলারের সঙ্গে টাকার মূল্যমান কমে যাওয়া, আর ডলার সংকটে এমনিতেই কাঁচামাল আমদানির সংকটে ভুগছে শিল্পখাত। তদুপরি স্বাধীনতার পর থেকে এযাবৎকালের সবচেয়ে তীব্র জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকটে সার্বিকভাবে শিল্প উৎপাদন শিল্পকারখানা ভেদে ২৫-৬০ শতাংশ কমে গেছে। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর  মাসে রফতানি  আয় কমেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ। শিল্পউদ্যোক্তারা নিশ্চিত, নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসেও রফতানি কমবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ। 

অধিকাংশ শিল্পকারখানা এরই মধ্যে তিন শিফটের পরিবর্তে দুই শিফট চালানো হচ্ছে। তারপরও চাহিদা অনুযায়ী অধিকাংশ শিল্পকারখানা গ্রিড বিদ্যুৎ সরবরাহ পাচ্ছে না। ডিজেল, ফার্নেস অয়েলের অগ্নিমূল্যের কারণে তেলনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন করেও ব্যয়সাধ্য এখন। ছোট-মাঝারি কারখানার কথাই নেই।  বড় বড় রফতানিমুখী শিল্পকারখানাগুলো পারছে না বিদেশি ক্রেতাদের শিডিউল অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করতে।

শিল্পউদ্যোক্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, বিদ্যমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক আর টেক্সটাইল শিল্প অচিরে বাজার হারাবে। ক্রেতারা বাংলাদেশের জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকট বিষয়ে অবহিত হয়েছে। একবার বড় বড় ক্রেতা অন্য দেশে চলে গেলে দীর্ঘস্থায়ী সংকটে পড়বে বাংলাদেশের প্রধান বিদেশি মুদ্রা অর্জনকারী খাত। বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয় সঙ্কুুচিত হবে, অনেক মানুষ চাকরি হারাবে। এমিনটেই অর্থনৈতিক মন্দা দুর্ভিক্ষের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এমতাবস্থায় শিল্পসঙ্গত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত করবে। 

সরকার বর্তমান অবস্থার জন্য করোনা অভিঘাত আর ইউক্রেন যুদ্ধে অজুহাত খুঁজলেও বিজ্ঞজনেরা জানেন ভ্রান্ত জ্বালানি নীতি, দুর্বল বাস্তবায়ন কৌশল আর সীমাহীন দুর্নীতি বর্তমান জ্বালানি সংকটের জন্য দায়ী। বিপুল পরিমাণ প্রমাণিত কয়লাসম্পদ মাটির নিচে রেখে আর জলে-স্থলে গ্যাস-তেল অনুসদ্ধান উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা না করে আমদানিকৃত জ্বালানির দিকে ঝুঁকে হয়েছে সংকট। এর ফলে সরকারের কিছু আমলা, কয়েকজন উপদেষ্টা আর সরকার ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ী ফুলে ফেঁপে উঠলেও সংকটে পড়েছে দেশের শিল্প, দেশের মানুষ। 

বর্তমান সংকটের মূল কারণ বাছবিচার না করেই হঠাৎ করে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দেয়ায়। এমনিতেই দেশের ২৩৩০ এমএমসিএফডি আর গড়ে ৭০০-৭৫০ আমদানিকৃত এলএনজি দিয়ে কোনোমতে পরিস্থিতি সামাল দিতো পেট্রোবাংলা। করোনা চলাকালীন ভারতসহ কয়েকটি দেশ এলএনজি সরবরাহকারী দেশের সঙ্গে সমঝোতা করে দীর্ঘস্থায়ী চুক্তির অধীন আমদানিকৃত এলএনজি মূল্য সমন্বয় আর পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে। ভুল পরামর্শে বাংলাদেশ করেনি। দেশের ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। আর তাই একপর্যায়ে এসে সরকার প্রধান স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে হয়েছে সংকট।

সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে শিল্প করেই উদ্যোক্তা, সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করে অন্তত কয়েক মাসের জন্য বিদ্যমান মূল্যে এলএনজি আমদানি করা হলে বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। এলএনজি আমদানির ওপর থেকে ট্যাক্স ভ্যাট প্রত্যাহার করা যেতো। শিল্পমালিকদের কিছুটা অধিক মূল্যে গ্যাস সরবরাহ দেয়া যেতো। এখন শিল্পমালিকরা দাবি করছে এলজি আমদানিতে ১ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে শিল্পকে দেয়া হলে সেটি ১০-১২ ডলার অর্জন করে রফতানি আয়ের মাধ্যমে। বিষয়টির পুঙ্খানুপুঙ্খ অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করা হলে সঠিক অবস্থা জানা যেতো, হয়নি সেটা। আর তাই তীব্র জ্বালানি সংকটে খাবি খাচ্ছে শিল্পকারখানা।  বিভিন্ন ক্ষেত্রে গ্যাস রেশনিং করেও কাজে লাগছে না।

এফবিসিসিআই, বিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিটিএমএ সবাই বলছে বর্তমান অবস্থা আরো এক-দুই মাস বজায় থাকলে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। শিল্পকারখানাসমূহ বন্ধ হয়ে যাবে পর্যায়ক্রমে। সম্প্রতি এফবিসিসিআই কর্তৃক আযোজিত একটি সেমিনারে বুয়েটের প্রাক্তন অধ্যাপক জ্বালানিবিশারদ ডক্টর ইজাজ হোসেন বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এমনকি মার্কিন ২৫-৩০ ডলার -এমএমবিটিইউ মূল্যে হলেও স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি ক্রয় শিল্পকে বাঁচানোর জন্য অপরিহার্য। 

শিল্প মাইলকরাও সুপ্রিম করেছে গ্যাসের মূল্য কিছুটা বাড়ালেও তাদের আপত্তি নেই। অথচ প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ডক্টর তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ব্যাড বিচার না করেই এলএনজি ক্রয় প্রস্তাবে অসম্মতি গোপন করেন। তিনি বলেন, প্রয়োজনে দিনে বিদ্যুৎ ব্যবহার পরিহার করে গ্যাস সাপ্লাই দেয়া হবে। অনেকেই উপদেষ্টাকে বর্তমান জ্বালানি সংকটের জন্য দায়ী করে থাকেন। 

পরিস্থিতি সংকটময়। দ্রুত সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে দেশের স্বার্থে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাশাপাশি যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে গ্যাস চুরি বন্ধ করতে হবে। ব্যবস্থাপনায় আমলাদের পরিবর্তে কারিগরি বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব দিতে হবে।

শেয়ার করুন