২৭ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৮:২৯:৫৬ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


কূটনীতিকদের ‘না’ বললো সব বিরোধী দল
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-০৭-২০২৩
কূটনীতিকদের ‘না’ বললো সব বিরোধী দল ইইউ প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠকে বিএনপি


বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যতোই নিরপেক্ষতার কথা বলুক না কেনো এদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সেই নির্বাচনে কোনো বিরোধী দলের পক্ষেই জয়লাভ করা সম্ভব না। আর এজন্য দেশে একটি সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে সরকারকে পদত্যাগ করে সরে দাঁড়াতে হবে। এরপরে নির্দলীয় বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা জাতীয় সরকার যা-ই বলা হোক না কেনো তার অধীনেই বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হতে হবে। সে-ই নির্বাচনেই বিএনপি’র নেতৃত্বে মাঠে আন্দোলনরত ৩৬টি রাজনৈতিক দলসহ ক্ষমতার বাইরে থাকা বাকি বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেবে- এমন বার্তাই দেয়া হয়েছে গত সপ্তাহে বাংলাদেশে আসা কূটনীতিকদের। মোট কথা কূটনীতিকদের না বলে দিলো সব বিরোধী দল। এমন খবর মিলেছে মাঠে আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলির সাথে কথা বলার পাশাপাশি বিভিন্ন বক্তৃতা বিবৃতিতে নজর দিয়ে। 

গত সপ্তাহ জুড়ে ছিল ঢাকায় এক ঝাক কূটনৈতিকের পদচারণা। এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র, মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া  ও তাঁর সঙ্গে আসা প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বাংলাদেশ সফর করেন। উজরা জেয়ার সঙ্গে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং ইউএসএআইডির উপসহকারী প্রশাসক অঞ্জলি কৌর। এই শক্তিশালি কূটনীতিক বহরটি ঢাকায় এসে সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, শ্রম অধিকার, মানবাধিকার, মানব পাচার ও রোহিঙ্গা-সংকট, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে আলোচনা করেন। সফরের দ্বিতীয় দিনে ১২ জুলাই বুধবার তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির পরিদর্শনে যান। অন্যদিকে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি কেমন তা জানতে ঢাকায় এসেছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক । তারা এসেই নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে সক্ষম কিনা সেটাও জানতে চেয়েছে।  তারা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানো এবং নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চায়।

এদিকে এক ঝাক কূটনৈতিকের পদচারণার পাশাপাশি ছিল উত্তপ্ত অবস্থা বাংলাদেশের রাজনৈতিক মাঠ। সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই শোডাউন করে নিয়েছে কর্মসূচির নামে। রাজনৈতিক মাঠ চষে দেখা গেছে, কূটনীতিকদের আগমনে দেশের দু’টি বড়ো রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র নেতৃত্বে বিরোধী দল মাঠ দাবড়িয়ে জানান দিতে মরিয়া হয়ে উঠে। উভয়ই জনগণকে বাদ দিয়ে কূটনীতিকদেরই পরস্পর পরস্পরের শক্তি প্রর্দশনে মাঠে নামে। বিএনপি’র ছিল ১২ জুলাই একদফা কর্মসূচির ঘোষণা। আর এমন একটি ঘোষণা দিতেই তারা বলা চলে রাজপথ বেছে নেয়। দেখা গেছে, বিএনপি’র এই ধরনের কর্মসূচি বিপরীতে আওয়ামী লীগ ডাক দেয় শান্তি সমাবেশ। মাঠের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমনই ছিল যে অনেকেই ধরে নিয়েছিল সেদিন কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেও যেতে পারে। 

কূটনীতিকদের কে কি বললেন

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অনুসন্ধানী দলটি বৈঠক করেছে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। ঢাকা সফরে এসে বিএনপির, জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং এবি পার্টির সঙ্গে বৈঠক করেন ইইউ প্রতিনিধিরা। 

কি বললেন বিএনপি’র নেতারা

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অনুসন্ধানী দলটিকে বিএনপি’র পক্ষ থেকে কি কি বলা হয়েছে তা তুলে ধরা হয় বৈঠকের পরে উপস্থিত সাংবাদিকদের। এতে বিএনপি সাফ জানিয়ে দেয় যে সরকারের অধীন নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। বলা হয় আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন হলে মানুষ ভোট দিতে পারবে না। এ-সময় বিএনপি নেতারা বিগত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। বলেন, এই দুই নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। আর এর থেকে জঘণ্য উপায় বের করে ক্ষমতাসীনরা এবারও আরেকটা যেন-তেন নির্বাচন করিয়ে ফেলতে। বিএনপি নেতারা বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়তেই নারাজ। তাদের রেখেই সব কিছু করতে চায়। কিন্তু দেশের মানুষ এখন বিএনপি’র নেতৃত্বে ঐকবদ্ধ। বিএনপি’র নেতারা এসময় আরো বলেন, দেশের সব বিরোধী দলই এসরকারের অধীনে নির্বাচন চায় না। এই দাবিতে বিএনপি’র নেতৃত্বে যে প্রায় অর্ধশত দল মাঠে যে সক্রিয় তা-ও তুলে ধরেন বিএনপি নেতারা। তারা বলেন, ক্ষমতাসীন এই আওয়ামী লীগকে এখন আর বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। এ জন্য জনগণ এখন রাজপথে আন্দোলন করছে। তবে অহিংস আন্দোলনে মাধ্যমেই দাবি আদায় করে নেবে বলেও বিএনপি কূটনীতিদের আশ্বস্ত করেন কূটনীতিকদের।  বিএনপির বৈঠকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্ব দেন। 

কি বলেছে জাতীয় পার্টি

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টি সরাসরি কিছু না বললেও তারা ইঙ্গিত দিয়ে সফররত কূটনীতিকদের বুঝিয়ে দিয়েছেন সুষ্ঠু নির্বাচন চায় জাতি। আর সেটা যে এই সরকারের অধীনে হচ্ছে না তা তারা কূটনীতিকদের ভালোভাবে বলেছেন বলে বৈঠকের বিভিন্ন সূত্র জানায়। আর বৈঠক শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথাই জানাল জাতীয় পার্টি। ইইউ প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠকে নেতৃত্ব দেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। ইইউ প্রতিনিধি দলটি জাতীয় পার্টির কাছে কী জানতে চেয়েছে প্রশ্নের জবাবে গণমাধ্যমে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক বলেন, ‘আমরা বলেছি, নির্বাচন আমরা চাই, দেশের মানুষ চায় একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন। সে নির্বাচনটা যদি করতে হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের সবচেয়ে বড় ভূমিকা দরকার। এখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, এটা আলোচনার মাধ্যমে সম্ভব। আসলে মূল পদক্ষেপটা সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া প্রয়োজন।

কি বললো জামায়াত

অনেক জল্পনা-কল্পনা ছিল জামায়াত নিয়ে। জামায়াতের বিরুদ্ধে মাঠে চাওর আছে তারা ক্ষমতাসীনদের সাথে যেমন যোগাযোগ রেখেছে তেমনি বিএনপি’সহ অন্যসব বিরোধী দলকে বোঝাতে চেয়েছে চাচ্ছে যে, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনরত দলগুলি সাথেই আছে। আলোচনা সমালোচনা নিয়ে সেই জামায়াতও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলটিতে জানিয়ে দিয়েছে যে, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বৈঠক শেষে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের দলীয় সরকারের একদলীয় ভোটে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি না সেটা তাদের বিষয়। অতীতে সংলাপের কোনো ফল আসেনি। বৈঠকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও জামায়াতের নিবন্ধন নিয়েও কথা হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রমাণ করে বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। দেশ বাঁচাতে হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্দলীয় সরকারের মাধ্যমে ভোট হতে হবে। কেয়ারটেকার সরকার কিংবা নির্দলীয় সরকার, যে নামেই হোক না কেন, একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। এর বাইরে বাংলাদেশের মানুষ দলীয় সরকারের অধীনে, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না।

এবি পার্টি কি বলল

এদিকে ইইউ পর্যবেক্ষক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) নেতৃবৃন্দ  লিখিত ব্রিফিং দেন। এতে এবি পার্টি প্রতিনিধিগণ দেশের নির্বাচনী ইতিহাস তুলে ধরেন। এতে তারা বলেন, রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য গায়ের জোরে বাতিল করা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আবার ফিরিয়ে এনে বাংলাদেশের গণআকাঙ্খার বাস্তবায়ন করতে হবে। এবি পার্টির প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিষ্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ ও ব্যারিষ্টার যুবায়ের আহমেদ ভূইয়া, সিনিয়র সহকারী সদস্য সচিব আমিনুল ইসলাম এফসিএ এবং সহকারী সদস্য সচিব  ব্যারিষ্টার নাসরীন সুলতানা মিলি।

শেষ কথা

গত সপ্তাহে চলা এমন লাগাতার কূটনীতিকদের বৈঠকে আসন্ন নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাশা জানতে চেয়েছেন ইইউ মিশনের কর্মকর্তারা। রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরাও নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। পুরো সফরে একটাই বিষয় স্পস্ট হয়ে গেছে যে, ক্ষমতাসীন ছাড়া বাকি রাজনৈতিক দলগুলি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে পরিবেশ চায়। তবে এটি যে এই ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে সম্ভব না তা স্পস্ট হয়ে গেছে কূটনীতিকদের। যদিও ইইউ এর সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বৈঠকে নেতৃবৃন্দ অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকার করবে বলে সাফ জানিয়ে দেয়। বৈঠকে নেতৃত্বে দেন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এই বেঠকে জানিয়ে দেয়া হয় পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। এখানে পার্লামেন্ট বিলুপ্তি, সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রশ্ন ওঠে না। এতোসব পরেও ক্ষমতাসীনদের এমন আশ্বাস ইইউ প্রতিনিধি দলটিকে কতটা আশ্বস্ত করতে পেরেছে তা হয়তো সময় বলে দেবে। তবে তাদের ঢাকায় এসে রাজনৈতিক মাঠ সরাসরি দেখে কি মেসেজ নিয়ে গেলো স্পস্ট হয়ে উঠতে কিছুটা সময় নেবে। তবে এসরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না এবং এর পাশাপাশি এদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে ক্ষমতার বাইরে থাকা সবকটি বিরোধী দল যে না’ এর পক্ষেই আছে এমন বার্তা পেয়ে গেছে ঢাকায় আসা এই কূটনৈতিকদের বহরটি-এমনটাই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

শেয়ার করুন