২৬ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ১১:০২:২৭ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


দেখার যেন কেউ নেই
মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসীরা ন্যূনতম চিকিৎসাটুকুও পায় না
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-১২-২০২২
মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসীরা ন্যূনতম   চিকিৎসাটুকুও পায় না মধ্যপ্রাচ্যের কর্মরত বাংলাদেশের কিছু শ্রমিক/ছবি সংগৃহীত


 নাছিমা আকতার। সৌদি আরবে গিয়েছিলেন রুজি রোজগারের আশায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারণ তাকে বলা হয়েছিলো এক পরিবারের কাজেই সেখানে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু তার সাথে সে কথা রাখেনি নিয়োগকর্তা। সৌদিতে নিয়োগকর্তার ৬ ছেলের বাসায় রাতদিন কাজ করতে হয়েছে তাকে। পর্যাপ্ত খাবার-তো দেয়নি উপরন্ত নানা ধরনের খারাপ আচরণ করা হতো। অর্ধাহার আর সময়মত খাবার না পেতে পেতে একপর্যায়ে নাছিমা আকতার অসুস্থ হয়ে পড়ে। এসময় নিয়োগকর্তার কাছে চিকিৎসাতো দূরে থাক তাকে বিনা চিকিৎসায় মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেয়া হয়। এমনকি বলা হয় বহু বাংলাদেশী এভাবে সেখানে মারা গেছে। কেউ কিছুই করতে পারেনি।


এসময় নিয়োগকর্তার হাতে পায়ে ধরে নাছিমা আকতার তাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থার অনুরোধ করেন। বলে তার সন্তানদেরকে যেনো এতিম না করা হয়। নিয়োগকর্তা কোনো কিছুতেই শোনেনি। বরং তাকে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া ছাড়া গতি নেই বলে সাফ সাফ জানিযে দেয়। এমনকি নিয়োগকর্তা নাছিমা আকতারকে বলে দেয় যে তার লাশও দেশে পাঠানো হবে না। সৌদি আরব থেকে লিভারের অসুস্থতা নিয়ে গত বছর দেশে ফিরে এসেছেন ঢাকার মাদারটেকের  নাছিমা আকতার। বাড়ি থেকে ঋণ করে টাকা নিয়ে দেশে ফিরে চিকিৎসা করাচ্ছেন কংকালসার নাছিমা আকতার। 

এমন আরেক ভুক্তভুগী হলেন কুমিল্লার তাজুল ইসলাম।  ১১ বছর ওমানে ছিলেন নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে। কাজের সময় ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে দুই পা ভেঙে যায় তাঁর। নিয়োগকর্তা চিকিৎসা করাতে রাজি হননি। এমনকি বাংলাদেশের দূতাবাসে যোগাযোগ করেও কোনো সহায়তা পাননি তাজুল। নিজের টাকায় জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়েছেন। এরপর ধারদেনা করে ২১ দিন পর দেশে ফিরে এসে চিকিৎসা করান।এখন বিদেশ নয় দেশের ছোট্ট ব্যবসা করে দিন পার করছেন। বিদেশে চাকরি করে জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর এমন অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন তারা গত সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে। এতে ‘উপসাগরীয় অঞ্চলে অভিবাসী কর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি: ভাইটাল সায়েন্স রিপোর্ট-২’ শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদনে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক যৌথ গবেষণা জোট ভাইটাল সায়েন্স। এ জোটের বাংলাদেশি অংশীদার রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন রামারু’র নির্বাহী পরিচালক সি আর আবরার। ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতি সৈয়দ সাইফুল হক, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি রশীদ-ই-মাহবুব, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকীম, নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম এসময় উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন। 

প্রতিবেদন বলা হয় গত মে থেকে জুলাই পর্যন্ত কাতারের ১ হাজার ১০১ জন কর্মীর ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, প্রয়োজনীয় নথিপত্রের অভাবে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে অক্ষম স্বল্প বেতনের অভিবাসীরা। তাঁদের মধ্যে ২৫ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা জাতিগত বৈষম্যের শিকার এবং পুরোপুরি চিকিৎসা বঞ্চিত হন। সৌদি আরবে সাক্ষাৎকার নেওয়া অভিবাসীরা বলেছেন, স্বাস্থ্য সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে অনেকটা নিয়োগকর্তার ওপর। কুয়েতে ৬৫ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই তাঁরা ব্যাথানাশক ওষুধ খেয়েছেন নিয়মিত। মনমোহন কার্ডিয়াক সেন্টারের একজন নেপালি চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছেন, সময়মতো স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারলে অনেক মৃত্যু প্রতিরোধ করা যাবে। এর আগে গত বছর প্রকাশিত প্রথম প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রতিবছর গড়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় ১০ হাজার কর্মী মারা যান। তাঁদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ জানা যায় না। সনদে স্বাভাবিক মৃত্যু ও হৃদরোগ কারণ হিসেবে দেখানো হয়।

প্রতিবেদনে আরো উঠে আসে যে কিভাবে নিম্ন আয়ের প্রবাসী শ্রমিকেরা মধ্যপ্রাচ্যে সহজে চিকিৎসা পান না। কোনোভাবেই যে নিয়োগকর্তারা (কফিল) চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে চায় না। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে স্থানীয় নাগরিক ও অভিবাসীদের চিকিৎসা সুবিধার মধ্যে যে বিরাট বৈষম্য তা-ও প্রতিবেদনে উঠে আসে। আর কোনো কর্মী অবৈধ হয়ে পড়লে তাঁদের চিকিৎসা পাওয়া যে কত কঠিন তা এ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে উঠে আসে অনেকেই অসুস্থ হয়ে শুধু চিকিৎসার জন্য দেশে ফিরে আসেন নিজ খরচেই। 

গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি হয়েছে শুধু সংখ্যাগত দিক নয়। সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বিশ্লেষণের মাধ্যমে। এতে বলা হয়, প্রবাসী কর্মীরা কর্মক্ষেত্র ও থাকার জায়গার অবস্থা, পরিবেশ, উচ্চ তাপ ও আর্দ্রতা, দূষণ, অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়াই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণের কারণে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকেন। এর পাশাপাশি নারীরা যৌন নির্যাতনের শঙ্কার মধ্যে থাকেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চিকিৎসা ব্যয় বেশি, ফলে স্বল্প আয়ের কর্মীরা এটা মেটাতে পারেন না।

গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে সি আর আবরার বলেন, প্রবাসীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিকে একদমই গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অথচ এরা দেশের রেমিটেন্স পাঠান। ডলার, রেমিট্যান্সের কথা প্রতিদিন শোনা যায়, কিন্তু যাঁরা এটা আয় করেন, তাঁদের জীবনের কান্না কেউ শোনে না। তাঁরা স্বাস্থ্যসেবা পান না। এটা শুধু অবহেলা নয়,এ খাতে দুর্নীতিও থাকতে পারে। এটা ঠিক, তাঁরা অন্য দেশে থাকেন। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা সরকারেরদায়িত্ব। সংশ্লিষ্ট দুই দেশ, নাগরিক সমাজ ও বহুপক্ষীয় আলোচনাতেও এটা গুরুত্ব পায় না। প্রবাসী কর্মীদের স্বাস্থ্যসংকট কতটা ভয়াবহ, করোনা মহামারি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। বৈধভাবে বিদেশে গিয়েও চিকিৎসা না পাওয়ার দায় সবাইকে নিতে হবে। 

সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, কাজের বৈধ অনুমতিপত্রের (ইকামা) সঙ্গে প্রতিটি কর্মীকে একটি করে স্বাস্থ্য কার্ড দিয়ে দিলেই চিকিৎসা নিশ্চিত হবে।

রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, চিকিৎসায় আগের মতো মানবতা নেই। এতে ব্যবসা ঢুকে গেছে। বাংলাদেশেও এটি দেখা যায়। আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চিকিৎসকদের অধিকাংশ বিভিন্ন দেশের। সেখানে প্রবাসীদের চিকিৎসা পাওয়া কঠিন। এটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকীম বলেন, প্রবাসীরা ঋণ করে বিদেশে যান। মানসিক চাপ থাকে, বাড়তি পরিশ্রম করেন। তাই হৃদ্রোগের ঝুঁকি থাকে। প্রচুর ব্যাথানাশক ওষুধ খান। এতে কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। রাষ্ট্র এদিকে গুরুত্ব দেয় না। তারা ডলার চেনে, রেমিট্যান্স চেনে, রিজার্ভ চেনে। প্রবাসীরা স্বাস্থ্য বোঝেন না, অধিকার বোঝেন না।

নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে একজন নারী গৃহকর্মীকে দিনে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হয় না। এতে তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েন।

গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে আলোচক গৃহকর্মীদের নিয়মিত ও বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা চালু করা এবং কর্মী উপস্থিত হতে না পারলে তাঁর বাসায় স্বাস্থ্যকর্মীর ভিজিট বাধ্যতামূলক করাসহ বিভিন্ন সুপারিশ করেন। এতে আরো বলা হয় উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগের সতর্কতায় নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যাথানাশক ওষুধ সেবন বন্ধে প্রচার করা। প্রয়োজনীয় সেবাসমূহ সহজলভ্য এমন ক্লিনিক এবং জরুরি সেবা কেন্দ্রসমূহ, যারা সেবার বিষয়ে যত্নবান এবং সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণে সক্ষম, তা স্বল্প বেতনের অভিবাসীকর্মীদের এলাকার কাছাকাছি থাকাটা নিশ্চিত করা।


সে সব আইন বা বিধান বাতিল করা যার জন্য চিকিৎসকদের অনথিভূক্ত অথবা গর্ভবতী অভিবাসীকর্মীদের জন্য কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট করতে হয় এবং এটি করা থেকে চিকিৎসকদের স্পষ্টভাবে বিরত করা। গৃহকর্মীদের জন্য নিয়মিত এবং বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা চালু করা এবং গৃহকর্মী উপস্থিত হতে ব্যার্থ হলে স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিয়োগকর্তার বাড়িতে ফলো-আপ ভিজিট পরিচালনা বাধ্যতামূলক করা। উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগের সতর্কতায় নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যাথানাশক ওষুধ সেবন বন্ধে প্রচার করা।


শেয়ার করুন