২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০১:৩৪:৫৯ অপরাহ্ন
শিরোনাম :


কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার আন্দোলন
মাঠ রক্ষার আন্দোলনেও সরকারের লেজে গোবরে অবস্থা
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-০৪-২০২২
মাঠ রক্ষার আন্দোলনেও সরকারের   লেজে গোবরে অবস্থা তেতুলতলার আন্দোলন নিয়ে এনজিও ও অধিকার সংগঠনসমুহের সাংবাদিক সম্মেলন,ছবি /সংগৃহীত


কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার আন্দোলনে নিয়ে পুলিশের বাড়াবাড়ির পাশাপাশি নাগরিক সমাজের মাঠে নেমে পড়াসহ উদ্বেগ-উৎকন্ঠা আবোরো সরকারের ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মহলে অস্বস্তির পাশাপাশি ক্ষুদ্ধও করেছে। মাঠ রক্ষার আন্দোলন রুখতে গিয়েও হয়েছে সরকারের লেজে গোবড়ে অবস্থা। 

রাজধানীর পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালের উল্টো দিকের খোলা জায়গাটি তেঁতুলতলা মাঠ হিসেবে পরিচিত। সেখানে স্থানীয় শিশুরা খেলাধুলা করে। পাশাপাশি মাঠটিতে ঈদের নামাজ, জানাজাসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান হয়। আর এই মাঠে কলাবাগান থানার স্থায়ী ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর প্রতিবাদ করছেন স্থানীয় লোকজন। 

সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন এর প্রাতবাদ। সর্বশেষ মাঠটি রক্ষার দাবিতে এলাকাবাসী গত ৪ ফেব্রুয়ারি পান্থপথের কনকর্ড টাওয়ারের সামনে মানববন্ধন করেন। কলাবাগান এলাকাবাসীর ব্যানারে আয়োজিত ওই কর্মসূচিতে স্থানীয় শিশু-কিশোর ও স্থানীয় বাসিন্দারা অংশ নেন। এতে মানববন্ধনের সংগঠকদের অন্যতম ছিলেন সৈয়দা রত্না। এরপর ঘটনা ঘটে গত ২৪ এপ্রিল। ঘটনার বিবরণে জানা যায় সকালে কলাবাগানের ওই মাঠটিতে ইট-সুরকি ফেলা হয়। 

রোববার সকালে সৈয়দা রত্না ফেসবুক লাইভে গিয়ে ওই মাঠটি দখল হয়ে যাওয়া নিয়ে সবার দৃষ্টি কামনা করছিলেন। এক পর্যায়ে সকাল ১১টার দিকে সৈয়দা রত্না ও ছেলেকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। আর এর পর থেকে শুরু হয়ে যায় তোলপাড়। খেলার মাঠ রক্ষার জন্য প্রতিবাদে নেমেছিলেন মা। সে কারণে মায়ের সঙ্গে তাঁর কিশোর ছেলেকে আটক করে দিনভর রাখা হয় থানাহাজতে-এমন খবরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হতেই সবমহলে উঠে সমালোচনার ঝড়। এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠে খেলতে যাওয়া কয়েক শিশুকে কান ধরে ওঠবস করায় পুলিশ। এর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়।

প্রতিবাদে নাগরিক সমাজ

কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার আন্দোলনে নেমে ১৬ ঘণ্টা থানায় আটক ছিলেন সৈয়দা রত্না ও তাঁর কিশোর ছেলে। এমন ঘটনায় নেমে পড়ে নাগরিক সমাজ। বিবৃতির আর নানান মন্তব্যে ঝড় বইতে থাকে দেশব্যাপী। সংবাদ সম্মেলন করে লিখিত বক্তব্যে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, তেঁতুলতলা মাঠটি উন্মুক্ত স্থান ও মাঠ হিসেবে রাখতে হবে। মাঠে থানা ভবন বা অন্য কোনো স্থাপন করা যাবে না। মাঠটি রক্ষায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও রাজউককে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।

পাশাপাশি সৈয়দা রত্না, তাঁর পরিবার ও আন্দোলনে যুক্ত এলাকাবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ইকবাল হাবিব দাবি করেন, এ ঘটনায় ১০টি আইনের লঙ্ঘন হয়েছে। মা-ছেলেকে আটক রেখে হয়রানির ঘটনায় কোনো আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। এতে সংবিধান ও আইনের ন্যাক্কারজনক লঙ্ঘন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী একনেকের সভায় মাঠ সংরক্ষণের কথা বললেও সে নির্দেশ মানা হচ্ছে না। সংবাদ সম্মেলনে বেলার নির্বাহী সভাপতি সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, অভিযোগ ছাড়া নাগরিককে তুলে নেওয়ার ঘটনা আবার শুরু হয়েছে। 

বলা হয়েছে, সরকারি কাজে বাধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইন প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে অভিযোগ ছাড়া এক নারীকে তুলে নেওয়া হলো। মাঠ রক্ষার আন্দোলন করা যাবে না মুচলেকা নিয়ে সৈয়দা রত্না ও তাঁর ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাহলে কী নিয়ে আন্দোলন করা যাবে, তার একটি তালিকা দেওয়া হোক। নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশি কবির বলেন, যাঁরা মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন, তাঁরাই আইনি সহায়তা পাবেন। 

এই দেশে কী সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার নেই? আইন কি নিজের মতো চলে না? সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সহসভাপতি মাহমুদ সেলিম, সহসাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমাম, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান লিটন, ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এস এম রেজাউল করিম প্রমুখ। এদিকে তেঁতুলতলা মাঠের ঘটনাপ্রবাহে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইনস্টিটিউট ফর প্লানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)।

প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলেন, তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার আন্দোলনকর্মী সৈয়দা রত্না ও তাঁর ছেলেকে পুলিশের আটক ও মুচলেকা নিয়ে মুক্তি দেওয়ার ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত।

এদিকে মা-ছেলেকে ধরে নিয়ে যাবার ঘটনার পেয়ে দুপুর ২টার দিকে স্কয়ার হাসপাতালের উল্টো দিকের ওই মাঠে যান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ মানবাধিকারকর্মীরা।পরে রাতে স্থানীয়দের সঙ্গে কলাবাগান থানার সামনে অবস্থান নিয়ে মা-ছেলের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেন তাঁরা। তাঁদের বিক্ষোভের মুখে রাত সাড়ে ১২টার দিকে থানা থেকে মুক্তি পান সৈয়দা রত্না ও তাঁর ছেলে। মুক্তির পর সৈয়দা রত্নাকে জড়িয়ে ধরেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। রাতে কলাবাগান থানার সামনেই সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, শিশুদের খেলার জায়গা না দিলে মাঠে ভবন করতে দেওয়া হবে না। 

এমন ঘটনায় কার লাভ হলো?

সম্প্রতি নিউমার্কেটের ঘটনায় পুলিশের গাফিলতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা হয়েছে। এর আগে গত ডিসেম্বর মাসে আমেরিকা র‌্যাব ও এর কয়েকজন কর্মকর্তার উপর একটি নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনা নিয়ে সরকার খুবই বিব্রতকর অবস্থায় আছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যার যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর তদন্তের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

 মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চার মাস পর ফের র‌্যাবের কথিত 'বন্দুকযুদ্ধ', এক জন নিহত হবার ঘটনাটি আলোড়িত করেছে তাদের। আর এমনিই সময়ে আবার তেঁতুলতলা মাঠের ঘটনা ঘটল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা যে বাহিনীর কাজ, তারা নাগরিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করছে। প্রশ্ন হচ্ছে এসব ঘটনা বারবার ঘটছে কেন? এপ্রসঙ্গে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন একটি গণমাধ্যমে বলেছেন বেশ খোলাখুলি ভাবে। 

তিনি বলেন, পুলিশ বাহিনীর মধ্যে খন্দকার মোশতাকের চেলাচামুন্ডারা ঢুকে গেছে। নিউমার্কেটের ঘটনা তো তাদের গাফিলতির একটি উদাহরণ। এরও আগে আপনারা দেখেছেন টিপ পরার জন্য এক নারীকে হেনস্থা করা হয়েছে। পুলিশের ভেতরে এরা কারা? এরা সরকারের অর্জনগুলো নষ্ট করে দিতে চায়। সামনে নির্বাচন, তাই এরা আরও সক্রিয় হচ্ছে। 

এর আগে এই তেঁতুলতলা মাঠে খেলার অপরাধে স্থানীয় কয়েক শিশুকে কানধরে ওঠবস করায় পুলিশ। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু এবারের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা ন্যাক্কারজনক। পুলিশ বলে তারা জনগণের বন্ধু। কিন্তু তেঁতুলতলা মাঠে যে ঘটনা ঘটল, এই কি তাদের বন্ধুত্বের নমুনা? আটকের ঘটনার পর আমাদের একজনের তরফ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁকে জানিয়েছিলেন, তিনি এই আটকের ব্যাপারে কিছুই জানেন না। তাঁকে জানানো হয়নি। বোঝা যাচ্ছে এই চক্র কতটা শক্তিশালী।’


শেয়ার করুন