২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৭:১৫:৫৮ পূর্বাহ্ন


দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ১২তম : টিআইবি
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-০২-২০২৩
দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ১২তম : টিআইবি


বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কতৃর্ক প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২২এর বাংলাদেশের স্কোর ২০২১ এর তুলনায় এক পয়েন্ট কমে ২৫ এবং নিম্নক্রম অনুযায়ী অবস্থানের ১ ধাপ অবনতি হয়ে ১২তম এবং উচ্চক্রম অনুযায়ী ২০২১ এর মতো ১৪৭তম। বৈশ্বিক গড় স্কোরের (৪৩) তুলনায় এবারও বাংলাদেশের স্কোর অনেক কম এবং গত এক দশকের মতো দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্কোর ও অবস্থানে আছে। অথচ এসময়কালে এ অঞ্চলে স্কোর ও অবস্থান বিবেচনায় সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকা আফগানিস্তানের স্কোর (২৪) ২০২১ এর তুলনায় আট পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে এবং উচ্চক্রম অনুযায়ী গত বছরের তুলনায় অবস্থানের ২৪ ধাপ উন্নতি হয়েছে। টিআইবি মনে করে, দেশে গত এক দশকে সরকারি সর্বেচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতির প্রতি শুন্য সহনশীলতার ঘোষণা সত্ত্বেও  কার্যকর কৌশল ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে না পারায় সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ও অবস্থানের অবনমন ঘটেছে। এ প্রেক্ষিতে পরিচয় ও অবস্থান নির্বিশেষে দুর্নীতির দায়ে সকল অভিযুক্তের কার্যকর জবাবদিহি নিশ্চিতসহ ছয় দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।  

গত ৩১ জানুয়ারি মঙ্গলবার সকালে সিপিআই ২০২২ এর বৈশ্বিক প্রকাশের অংশ হিসেবে টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, “সিপিআই অনুযায়ী ০-১০০ স্কেলে টানা চার বছর স্কোর অপরিবর্তিত ২৬ থাকার পর ২০২২ এর সূচকে আরো এক পয়েন্ট কমে ১২তম সর্বনিম্ন ২৫ স্কোর করেছে বাংলাদেশ, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। ২০১২ সাল থেকে দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে এবারও বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বনিম্ন এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে চতুর্থ সর্বনিম্ন, যা অত্যন্ত বিব্রতকর। বিষয়টি আরো উদ্বেগজনক একারণে যে, ২০১২-২০২২ মেয়াদের দৃশ্যমান ধারা অব্যাহত থাকলেও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন অবস্থানে অবনমনের সম্ভাবনার সম্মুখীন।”

টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মন্জুর-ই-আলম এর সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির উপদেষ্টা নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২২ সালের সিপিআই অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৯০ স্কোর পেয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে আছে ডেনমার্ক। ৮৭ স্কোর নিয়ে যৌথভাবে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড এবং ৮৪ স্কোর পেয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে নরওয়ে। আর ১২ স্কোর পেয়ে তালিকার সর্বনিম্নে সোমালিয়া, ১৩ স্কোর পেয়ে যৌথভাবে তালিকার দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দক্ষিণ সুদান ও সিরিয়া এবং ১৪ স্কোর পেয়ে তৃতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে ভেনেজুয়েলা।

‘সংঘাত, শান্তি ও নিরাপত্তা’ এবারের সিপিআই-এর প্রতিপাদ্য উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতি তথ্য তুলে ধরেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, “এবারের সিপিআই অনুযায়ী সার্বিকভাবে বৈশ্বিক বিবেচনায় দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সাফল্যের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ১৮০টির মধ্যে ১০৯টি দেশ বৈশ্বিক গড় ৪৩ এর কম স্কোর করেছে। সূচকে অন্তর্ভূক্ত দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি- ১২২টি দেশের স্কোর ৫০ এর নিচে, যার অর্থ এসব দেশে দুর্নীতির মাত্রা উদ্বেগজনক। ২০২১ এর তুলনায় ৭৩টি দেশের স্কোর কমেছে, এরমধ্যে ২৬টি দেশ তাদের ইতিহাসের সর্বনি¤œ স্কোর করেছে। যাদের স্কোর কমেছে তাদের মধ্যে অনেক এমন দেশ রয়েছে যারা সূচকে তুলনামূলকভাবে উচ্চতর অবস্থানে রয়েছে। তদুপরি এদের মধ্যে এমন অনেক দেশ রয়েছে যেখানে আইনী ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এক ধরনের অসাধু চক্র বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশ থেকে অর্থ পাচারের মাধ্যমে সম্পদ আহরণ ও বিনিয়োগের সুযোগ করে দিচ্ছে এবং প্রকারান্তরে বৈশ্বিকভাবে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ”

সিপিআই উপস্থাপনায় বাংলাদেশের নিম্ন অবস্থানের ব্যাখ্যা তুলে ধরে ড. জামান বলেন, “নভেম্বর ২০১৯ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ছিলো সরকারের সবোর্চ্চ পর্যায় থেকে ঘোষিত ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা’র সবচেয়ে আলোচিত মেয়াদ। কিন্তু এই মেয়াদে এই ঘোষণাকে চর্চায় রূপ দেওয়ার যথাযথ কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি; উপরন্তু এই মেয়াদে দুর্নীতির ব্যপকতা আরো ঘনীভূত ও বিস্তৃত হয়েছে। কোভিড সংকট মোকাবেলায় সরকারি ক্রয় ও বিতরণ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমেও দুর্নীতির অসংখ্য তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এই সময়কালে বিদেশে অর্থ পাচারের আশঙ্কাজনক চিত্র উঠে আসলেও এর প্রতিরোধ ও প্রতিকারে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। ঋণ খেলাপী, জালিয়াতি ও অর্থপাচারে জর্জরিত ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায় নি, বরং এর জন্য যারা দায়ী তাদের জন্য বিচারহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক, প্রসাশনিক ও আর্থিকসহ বিভিন্নভাবে অর্জিত ক্ষমতার অবস্থানকে অপব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদ বিকাশের লাইসেন্স হিসেবে ব্যবহারের ব্যপকতা বৃদ্ধি পেয়ে স্বাভাবিকতায় রূপান্তর করা হয়েছে। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব ব্যপকতর হয়েছে।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, “কোনো কোনো ক্ষেত্রে গণমাধ্যমসহ যারা দুনীর্তির তথ্য বা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী তথ্য প্রকাশ, দুর্নীতিবিরোধী চাহিদা সৃষ্টি ও তা প্রতিরোধে যারা যুক্ত তাদের জন্য প্রতিকূল ও ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি  করা হয়েছে। অন্যদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে কঠোর ভূমিকা গ্রহণের জন্য দুদক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদেরও নাজেহাল হতে হয়েছে। এমনকি দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এমন কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রদানসহ বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে। যার ফলে দুর্নীতিসহায়ক ও বিচারহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।”

এবারের সিপিআই অনুযায়ীও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দুর্নীতির মাত্রা সবচেয়ে কম ভুটানে, সূচকে ৬৮ স্কোর পেয়ে সর্বোচ্চ থেকে গণনা অনুযায়ী অবস্থান ২৫তম। এ অঞ্চলের আটটি দেশের মধ্যে ছয়টি দেশ এবার ২০২১ এর তুলনায় অধিক স্কোর অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। এরমধ্যে ভুটান, মালদ্বীপ ও ভারতের স্কোর অপরিবর্তিত রয়েছে; বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার স্কোর এক পয়েন্ট কমেছে এবং নেপালের ১ পয়েন্ট ও আফগানিস্তানের স্কোর ৮ পয়েন্ট বেড়েছে।  

সিপিআই সূচকে দুর্নীতির ধারণার মাত্রাকে ০-১০০ এর স্কেলে নির্ধারণ করা হয়। ‘০’ স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত এবং ‘১০০’ স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বাধিক সুশাসিত বলে ধারণা করা হয়।  সূচকে অন্তভুর্ক্ত কোনো দেশই এখন পর্যন্ত  শতভাগ স্কোর পায়নি। অর্থাৎ, দুর্নীতির ব্যাপকতা সর্বনিম্ন- এমন দেশগুলোতে কম মাত্রায় হলেও দুর্নীতি বিরাজ করে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সিপিআই নির্ণয়ে টিআইবি কোনো ভূমিকা পালন করে না। এমনকি টিআইবির গবেষণা থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্য বা বিশ্লেষণ সিপিআইএ প্রেরণ করা হয় না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের টিআই চ্যাপ্টারের মতো টিআইবিও দুর্নীতির ধারণা সূচক দেশীয় পর্যায়ে প্রকাশ করে মাত্র। সিপিআই ২০২২ এর তথ্যসূত্র হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য সর্বমোট ১৩টি জরিপ ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গতবারের মতো ৮টি জরিপ ব্যবহৃত হয়েছে। জরিপগুলো হলো: বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট, ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে, গ্লোবাল ইনসাইট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস, বার্টেলসম্যান ফাউন্ডেশন ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল ইনডেক্স, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস এবং ভ্যারাইটিস অব ডেমোক্র্যাসি প্রজেক্ট ডেটাসেট এর রিপোর্ট।

শেয়ার করুন