২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৬:৫৬:০০ পূর্বাহ্ন


ফলের ঝুড়ি আর লাঞ্চের নেপথ্যে
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-০৮-২০২৩
ফলের ঝুড়ি আর লাঞ্চের নেপথ্যে গয়েশ্বর রায়কে আটকের পর ডিবি অফিসে লাঞ্চ করানো হয় এবং (ডানে) আমান উল্লাহ আমানের জন্য ফল নিয়ে হাসপাতালে যান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা


বিএনপির  স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে পুলিশ পিটুনি দিয়ে পরে ডিবিতে নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহবায়ক আমানউল্লাহ আমানকে হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রীর ফলের ঝুড়ি পাঠানোর সাদামাটা কোনো ঘটনা নেই। এর পেছনেও বাইরের চাপ যেমন কাজ করেছে, তেমনি সুকৌশলে রয়েছে আন্দোলনে মাত্রাকে বিভ্রান্ত করার ক্ষমতাসীন দলের কূটচাল। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন, ক্ষমতাসীন দল এমন পরিস্থিতি তৈরি করে সাময়িক লাভ পেয়েছে তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট করেছে। এমন তথ্যই পাওয়া গেছে পুরো ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করে। 

গত শনিবার ঢাকার নয়াবাজারে অবস্থান কর্মসূচি পালনে নেতৃত্ব দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাধায় সেখানে দাঁড়াতে না পেরে ধোলাইখালে তারা সড়কে নামলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এসময় দেখা যায় ঘটনাস্থলে কিছুইতে সরে যেতে চাইছিলেন না তিনি। এক পর্যায়ে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে আহত গয়েশ্বরকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। কিন্তু তাকে মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থাতেও বেশ কয়েকজন কয়েকদফা লাঠি পেটা করেছে। আরো অনেকে তাকে লাঠি পেটা করতে উদ্যত হতে দেখা যায়। পরে সেখা থেকে উদ্বার করে ডিবি অফিস এবং সেখান থেকে ৪ ঘণ্টা পর তাকে নয়াপল্টনে দিয়ে আসে পুলিশ।

কারা পেটালো তাহলে

প্রশ্ন হচ্ছে এমন নির্মমভাবে লাঠি পেটানোর পর গয়েশ্বর রায়কে হঠাৎ কেনো আইন শৃংখলা বাহিনীর মাত্র কয়েকজন সদস্যকে কর্ডন করে নিয়ে যাচ্ছে? কারা এই নির্দেশ দিয়েছেন গয়েশ্বর রায়কে রক্ষা করতে হবে? কেনোই বা তাকে রক্ষার করার গুরুত্ব সরকারের শীর্ষ মহল থেকে আসলো। এ ব্যাপারে জানা গেছে, গয়েশ্বর রায়ের আহত হবার ঘটনাটি আইন শৃংখলা বাহিনীর সমস্যরা দূর নিয়ন্ত্রিত ক্যামেরা থেকে পর্যবেক্ষণ করেন। তারা এমন নির্মমভাবে গয়েশ্বর রায়কে পেটানো হচ্ছে দেখে অবাক হয়ে যান। এটি যে আইন শৃংখলা বাহিনীর ওপর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ফেলবে যা থেকে কেউ কেনো কূটনৈতিক চাল দিয়ে রক্ষা করতে পারবে না - তা বুঝে ফেলেন শীর্ষ ব্যক্তিরা। এটা যে কতিপয় অতি উৎসাহী পুলিশের নির্মমতা তা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ধরা পড়ে। আর এজন্য এ ব্যাপারে তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেন। তবে গয়েশ্বর রায়ের সেদিন যদি অন্য কিছু ঘটে যেতো পুরো রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে টার্ণ নিতো বলেই আনেকের আশঙ্কা ছিল। কিন্তু  উদ্ধারকৃত সেই বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে খাওয়া-দাওয়ার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়াটাকে অনেক রাজনৈতিক কূটকৌশল বলে মনে করেন। তাদের মতে, সরকার একদিকে দেখানোর চেষ্টা করেছে যে তারা জানমাল সর্বোপরি গয়েশ্বর রায়ের মতো নেতাকে প্রোটেশান দিতে যথেষ্ট দক্ষতা ও আন্তরিকতা দেখিয়েছে। আর এটা করে ওই সময়ে পুরো রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে একটু অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয়া সরকারি চাল কাজে লেগেছে। কেননা গয়েশ্বর রায়ের ওপর লাঠি পেটা রাস্তায় ফেলে সাপের মতো মারার দৃশ্য সারা দেশে ভিন্ন প্রেক্ষাপট তৈরি করতে অনেক ভূমিকা রাখতো। বিষয়টিকে অন্য ভাবে ম্যানেজ করে তেমন ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে সরকার উদ্বার পেয়েছে ঠিকই কিন্তু গয়েশ্বর রায়ের ইমেজের পাশাপাশি সরকার বিরোধী আন্দোলনে বিএনপি’র গতি প্রকৃতিকে কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কেউ কেউ মনে করতে থাকেন নিশ্চয়ই সরকারের সাথে গয়েশ্বর রায়ের কোনো ধরনের বোঝাপড়া হয়েছে। আবার অবশ্য এমনটাও কেউ কেউ মনে করেছেন হয়তোবা সরকার আন্তর্জাতিক চাপেই এমন কৌশলী সহানুভূতি দেখিয়েছে। একিই রকম ঘটনা প্রধানমন্ত্রীর ফলের ঝুড়ি পাঠানো বিষয়টিতে রয়েছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। যদিও হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রীর ফলের ঝুড়ি পাঠানো প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহবায়ক আমানউল্লাহ আমান বলেছেন, ‘ওষুধ খাইয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল, ঘুম থেকে উঠে দেখি এই অবস্থা।’ তিনি বলেন, ‘এসব নাটক করে লাভ নেই, এই সরকারকে পদত্যাগ করতেই হবে।’ সোমবার বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আমরা এক দফা দাবিতে রাজপথে নেমেছি, প্রয়োজনে রাস্তায় পড়ে মরে যাবো। আপনারা রাজপথে নামুন। আমরা এক আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করি না। আমরা তারেক রহমানকে বিজয়ী ও বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করেই ঘরে ফিরবো।’

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন ঘটনার সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ভিন্ন খাতে নিয়ে দারুন কূটচাল দিয়েছে।  

কিন্তু শেষ বিচারে কি লাভ হয়েছে?

শেষ বিচারে সরকার যতই কূটকৌশল দেখাক না কেনো তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেক নজর থেকে আবারো বঞ্চিত হতে হয়েছে। কেননা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার প্রসঙ্গ ঠিকই উঠে আসে।  বাংলাদেশে গত সপ্তাহে রাজনৈতিক প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে সংগঠিত সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি সাফ সাফ বলে দিয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতার পরিবেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। অন্যদিকে বাংলাদেশে বিক্ষোভকারীদের ওপর বলপ্রয়োগ বন্ধ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থাটি এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানায়। বিবৃতিতে অ্যামনেস্টির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক অন্তর্বর্তীকালীন আঞ্চলিক পরিচালক স্মৃতি সিংহ বলেন, ‘বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আগামী মাসগুলোতে আরও সহিংসতা ও অস্থিরতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কর্তৃপক্ষের উচিত হবে উত্তেজনা কমানো। বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে শুধু সেসব আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ব্যবহার করতে হবে, যারা মানবাধিকার রক্ষা করে সভা-সমাবেশ ঘিরে পুলিশি সেবা দিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এসব সংস্থা প্রয়োজন ছাড়া বলপ্রয়োগ করতে পারবে না এবং তা অবশ্যই যৌক্তিক হতে হবে।’ 

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জোরালোভাবে বাংলাদেশি র্কর্তৃপক্ষের প্রতি সংযত থাকার আহ্বান জানাচ্ছে। সংস্থাটি বলেছে, অতিপ্রয়োজন হলেই কেবল ন্যূনতম শক্তি প্রয়োগ করা যেতে পারে। কোনোভাবেই সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে আগ্নেয়াস্ত্র ও রাবার বুলেট ব্যবহার করা যাবে না। গুটিকয় মানুষের সহিংস আচরণে এমন প্রতিক্রিয়া দেখানো যাবে না, যাতে পুরো বিক্ষোভ সহিংস হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, এধরনের বিবৃতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই যাচ্ছে। ফলে তারা যতোই কূটকৌশল করুক না কোনো দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অঙ্গনে এধরনের ঘটনা সরকারকে আবারো নানান ধরনের প্রশ্নের মুখেই পড়তে হলো।

শেয়ার করুন