০৩ মে ২০১২, শুক্রবার, ১১:১৮:৫৪ পূর্বাহ্ন


নির্বাচনের প্রাক্কালে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি: এমএসএফ
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-০৯-২০২৩
নির্বাচনের প্রাক্কালে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি: এমএসএফ


বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজপথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলোর তৎপরতা বেড়েছে। প্রতিদিনই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি থাকছে। ফলে এসব রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে হামলা-মামলা ও সংঘাতের ঘটনা চলেছে। বেড়েছে সহিংসতা, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলাও। গায়েবি মামলায় অজ্ঞাতনামা হিসেবে বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিকে আসামি করা হচ্ছে, যার মুখ্য উদ্দেশ্য আপাতভাবে মনে হচ্ছে গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ও সংগঠকদের ভীত-সন্ত্রস্ত্র ও আতঙ্কের মধ্যে রাখা, যাতে তারা সভা-সমাবেশ করতে না পারে। কোনো সহিংসতা ঘটলেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে পাইকারি হারে মামলা করছে এবং অজ্ঞাতনামা অসংখ্য ব্যক্তিকে আসামি করছে। আবার সেই অজ্ঞাতনামাদের স্থলে সুবিধামতো ক্ষমতাসীনদের হাতে আক্রান্ত নেতাকর্মীদের নাম বসিয়ে হয়রানি করার দৃষ্টান্ত পাওয়া যাচ্ছে। এইসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মানুষের রাজনীতি করার যে সাংবিধানিক অধিকার তা বাধাগ্রস্থ করা হচ্ছে, ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে যা রাজনৈতিক অঙ্গনকে বিপন্ন করছে।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)’র পক্ষ থেকে এই মাসের এক প্রতিবেদন তুলে ধরা হয় এসব তথ্য। মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদন আগস্ট ২০২৩ শীর্ষক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী আগস্ট ২০২৩ এ ২৮ টি হয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহত, মামলা ও সমাবেশে যোগদানে বাধা প্রসঙ্গে বলা হয় পুলিশ বাদী হয়ে ২৫ টি এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীরা ৩ টি মামলা করেছে । ২৮টি রাজনৈতিক মামলার মধ্যে ১৪টি বিএনপির, ১০টি জামায়াতে ইসলামী বাংলদেশ ও ৪টি মামলা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বাংলদেশ বিরুদ্ধে যুক্তভাবে করা হয়েছে। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী বাংলদেশের বিরুদ্ধে করা ১ টি মামলায় আসামি করা হয়েছে বগুড়া থেকে ঢাকায় ইলেকট্রনিক সামগ্রী কিনতে আসা ২ জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক  হয়রানিমূলক ২৮টি মামলায় ৪২২৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। যাদের মধ্যে নাম উল্লেখ করা হয়েছে ৭৬৭ জনের এবং অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৩৪৫৯ জনকে। এ সকল মামলার মধ্যে সংবাদমাধ্যমে ৫টি মামলার  সম্পূর্ণ  তথ্য পাওয়া যায়নি।

আগস্ট মাসে গণমাধ্যমে সূত্র অনুযায়ী, রাজনৈতিক সহিংসতা ও সভা সমাবেশে বাধার ৩৪ টি ঘটনায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৫৮৩ জন। তাদের মধ্যে ৫৭৯ জন আহত ও ৪ জন নিহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে ৪ জন গুলিবিদ্ধ। নিহতদের মধ্যে ৩ জন ক্ষমতাসীন দলের কর্মী এবং ১ জন বিএনপির কর্মী।

এদিকে বাংলাদেশে আগস্ট মাসেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড অব্যাহত ছিল বলেও মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)’র পক্ষ থেকে এই মাসের এক প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। বলা হয় যে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী এবছরের আগস্ট মাসেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। মানবাধিকার লংঘনের এই ঘটনাগুলো ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এসব ঘটনা রোধে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার তীব্রনিন্দা জানাচ্ছে। পাশাপাশি মানবাধিকার লংঘনকারীদের বিচার ও ভূক্তভোগীদের জন্য সুবিচারের দাবি জানাচ্ছে। 

এতে বলা হয় দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু নির্যাতন, তাদের পরিচয়ে অপহরণ, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, গায়েবি মামলা, পুলিশি বলপ্রয়োগের ঘটনা বন্ধ হয়নি। রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা বেড়েই চলেছে। প্রাপ্ত তথ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ধর্ষণসহ নারী ও শিশুদের উপর সহিংসতার ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটছে এবং তা উদ্বেগজনক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে  সাংবাদিকসহ অন্যদেরও পেশাগত দায়িত্ব পালনে হুমকি, শারীরিক নির্যাতন ও হামলা তথা সাংবাদিকতা এবং মত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মত ঘটনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। কারা-হেফাজতে মৃত্যু বেড়েছে, সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংসতা ও সীমান্তে হতাহতের মতো ঘটনা বন্ধ হয়নি বরং উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনার ধারাবহিকতা রয়েই গেছে। অপরদিকে গণপিটুনির মত আইন হাতে তুলে নেয়ার ঘটনা ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধ-গোলাগুলি প্রসঙ্গে বলা হয় দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী আগস্ট এ বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন একজন। এ ঘটনায় অপর পাঁচ জন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গুরুতরভাবে আহত হন। 

পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেয়া অপহরণ বা নিখোঁজ প্রসঙ্গে বলা হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী আগস্ট মাসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়ার ৬টি ঘটনায় ১৫ জনকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ৯ জন বিএনপি নেতাকর্মী, ২ জন জামাত শিবিরের কর্মী ও ৪ জন চিকিৎসক রয়েছেন। তুলে নেয়ার পর তাদেরকে কোন না কোন মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। 

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু প্রসঙ্গে বলা হয় আগস্ট এ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে আসামির মৃত্যুর বিষয়টি অনাকাঙ্খিত ও অগ্রহণযোগ্য। আর এজন্য এমএসএফ মনে করে প্রতিটি হেফাজতে মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া আবশ্যক।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার-অপব্যবহার প্রসঙ্গে বলা হয়, দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সরকার সকল পেশাজীবী সংগঠনের আলোচনার, দাবি উপেক্ষা করে নিজেদের মতো করে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম পরিবর্তন ও কিছু ধারার সংশোধনী এনে জামিনযোগ্য ও কিছু সাজার মেয়াদ কমিয়ে সাইবার নিরাপত্তা আইনের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সংশোধিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা গেছে  ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দমনমূলক বিধিগুলো রয়ে গেছে। বিশেষ করে সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে তুলনায় দেখা গেছে, এই অনুচ্ছেদে একটি ছাড়া সব অপরাধের বিষয় একই আছে। শুধু একটি পরিবর্তন আনা হয়েছে- অপরাধের ধরণে নয়, শাস্তির ক্ষেত্রে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারা সাইবার নিরাপত্তায় ৪২ ধারা হিসেবে একই রয়েছে। এ ধারায় পুলিশ কর্মকর্তা কোনো অফিসে তল্লাশি, কম্পিউটার বা এ-জাতীয় যেকোনো যন্ত্র জব্দ, কোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশি; এমনকি পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার করতে পারবে। সাইবার নিরাপত্তা  আইনে সাংবাদিকসহ মুক্তচিন্তার মানুষকে তাঁর মতামত প্রকাশে বাধাগ্রস্থ করা, ভয় দেখানো, হয়রানি, নির্বিচার গ্রেফতার ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য এই আইনটি ব্যবহার করা হতে পারে। যেহেতু অনুমোদিত আইনের অনেক ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে, সেহেতু সেসব ধারায় আগের আইনে আটক ব্যক্তিরা ন্যায়সংগতভাবেই জামিন পাওয়ার অধিকার রাখে।

সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের অধিকারের লংঘন প্রসঙ্গে বলা হয় সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে যেভাবে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং তাদের যেভাবে শারীরিকভাবে আক্রমণ, হয়রানি, হুমকি ও লাঞ্ছিত করা হচ্ছে তা শুধুমাত্র অনাকাঙ্ক্ষিতই নয় বরং বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতার কন্ঠরোধ করার সামিল। স্বাধীন সাংবাদিকতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকেরা নানাভাবে হুমকি, হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যা ছিল উদ্বেগজনক। 

দেশে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী আগস্ট মাসে ৪০ জন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে প্রকাশিত সংবাদের জন্য ২ সাংবাদিকের নামে বরগুনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা, ১ জন সাংবাদিকের নামে মানহানির মামলা করা হয়েছে যিনি দৈনিক যুগান্তরের কক্সবাজার প্রতিনিধি, জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর গায়েবানা জানাযা নিয়ে কক্সবাজারে সংঘর্ষের ঘটনায় ৪ সাংবাদিককে পুলিশের কাজে বাঁধা ও  বিশেষ ক্ষমতা আইনে মোট দুইটি মামলায় আসামি করা হয়েছে, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর গায়েবানা জানাযাকে কেন্দ্র করে  বগুড়ায় ২ জন সাংবাদিককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে। এছাড়াও ১ জন সাংবাদিককে হত্যার হুমকি, গাইবান্ধা, রাজবাড়ী দৌলতদিয়ার, শায়েস্থাাগঞ্জ ট্রেনে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য স্থানে মোট  ১৯ জন সাংবাদিক স্বার্থান্বেষী মহলের দ্বারা আক্রমণে আহত হয়েছেন, ১১ জন সাংবাদিককে হয়রানি করা হয়েছে। 

যেভাবে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে তা শুধুমাত্র অনাকাঙ্খিতই নয় বরং বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতার কন্ঠরোধ করার পাশাপাশি স্বচ্ছতা, গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ।

শেয়ার করুন