০২ অক্টোবর ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১০:৪০:১২ অপরাহ্ন


দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
সূর্যোদয়ের দেশ জাপান
টোকিও থেকে হাবিব রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০৯-২০২৫
সূর্যোদয়ের দেশ জাপান হানিদায় লেখক


জাপানি বিমান সংস্থা নিপ্পন এয়ারের বিমানটা আকাশ থেকে ক্রমেই নেমে আসছিল হানিদা এয়ারপোর্টে। টোকিওর আকাশে তখন ফুটে উঠছিল ভোরের আলো। নিচে তাকাতেই দেখি সোনালি আভায় ঝলমল করছে হানিদা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বিমানের জানালা দিয়ে তাকাতেই মনে হচ্ছিল মহানগরীর হৃদয়ে নামছি আমি, যেখানে প্রতিটি শ্বাসে মিশে আছে শৃঙ্খলা আর সৌন্দর্য। জানালার কাচ দিয়ে চোখে পড়ছিল নিচে নক্ষত্রখচিত এক শহর। ওপর থেকে আলো ঝলোমলো শহরটা দেখে মনে হচ্ছিল আকাশের তারাগুলো যেন নেমে এসেছে মাটিতে, প্রতিটি আলো একেকটি গল্প, একেকটি স্বপ্ন। চোখে পড়ছিল টোকিও শহরের উঁচু টাওয়ার, উজ্জ্বল রাস্তা, নদীর ধার ঘেঁষা সেতু-সব মিলেমিশে যেন জীবন্ত আলোকচিত্র। প‍্যারিস, নিউইয়র্কের মতো এ শহরটিও ঘুমোয় না কখনো। রাতের বুকেও জেগে থাকে উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা আর ছন্দ। বিমানের ডানা কাঁপতে কাঁপতে নিচে নামতে থাকে। মনে হচ্ছিল শহরের হৃৎস্পন্দন যেন কানে ভেসে আসছে। আলো-অলংকৃত রানওয়ে পথ দেখায় ক্লান্ত পাখির মতো নামতে থাকা বিমানটিকে। চোখে ভেসে উঠছিল কবিতার মতো এক শহর টোকিও। যার প্রতিটি পঙক্তি লেখা হয়েছে আলো দিয়ে। এই উজ্জ্বল নগরীর বুকে, ক্রমেই ভেসে উঠতে থাকে হানিদা বিমানবন্দর-আলোকরেখায় আঁকা এক বিশাল দ্বার, যেখানে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মানুষ নামে, আবার নতুন পথে উড়ে যায়। হানিদা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি জাপানের রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে। এ এয়ারপোর্টকে বলা হয় ‘টোকিওর দরজা’। একজন পর্যটকের চোখে হানিদা শুধু একটি এয়ারপোর্ট নয়, বরং টোকিওর প্রথম স্বাদ। পরিচ্ছন্নতা, সময়নিষ্ঠা ও সেবার মান-সবকিছু মিলিয়ে এটি ভ্রমণকারীর মনে জাপান সম্পর্কে প্রথমেই ইতিবাচক ধারণা তৈরি করে। তাই বিশ্বব্যাপী অনেক পর্যটক একে পৃথিবীর অন্যতম আরামদায়ক ও সুবিধাজনক বিমানবন্দর বলে অভিহিত করেন। জানা যায়, হানিদা বিমানবন্দর প্রথম যাত্রা শুরু করে ১৯৩১ সালের ২৫ আগস্ট, নাম ছিল হানেদা এয়ারপোর্ট। মূলত জাপানি পরিবহন মন্ত্রণালয় এটি নির্মাণ করে। শুরুতে এটি ছিল সামরিক ও সীমিত আকারের বেসামরিক বিমান চলাচলের কেন্দ্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন সামরিক বাহিনী কিছু সময় এটি ব্যবহার করে। পরে ১৯৫২ সালে এটি আবার জাপানের হাতে ফিরে আসে এবং বেসামরিক বিমান চলাচলের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। শুরুতে নির্মাণ খরচ ছিল তুলনামূলক কম, কারণ বিমান চলাচলও সীমিত ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক বিনিয়োগ হয়। বিশেষ করে টার্মিনাল ১ (১৯৯৩ সালে), টার্মিনাল ২ (২০০৪ সালে) এবং আন্তর্জাতিক টার্মিনাল (২০১০ সালে, বর্তমানে টার্মিনাল ৩) নির্মাণে হাজার হাজার কোটি ইয়েন খরচ করা হয়েছে। সর্বশেষ সম্প্রসারণে খরচ হয়েছে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ইয়েনেরও বেশি, যা এটিকে বিশ্বমানের একটি আকাশদ্বারে পরিণত করেছে। বলা হয় হানিদা বিমানবন্দর শুধু যাত্রী বহনের স্থান নয়, বরং এটি জাপানের প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির প্রতীক। নিকটতম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর- টোকিওর কেন্দ্র থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, তাই দ্রুত যাতায়াতের সুবিধা। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রানওয়ে, এখানে চারটি আধুনিক রানওয়ে আছে, যা একসঙ্গে হাজার হাজার ফ্লাইট পরিচালনা করতে সক্ষম। শপিং ও সংস্কৃতি, টার্মিনাল ভবনের ভেতরে ঐতিহ্যবাহী এডো-স্টাইল মার্কেট স্ট্রিট, রেস্তোরাঁ, শপিংমল-এমনকি অবজারভেশন ডেকও রয়েছে। প্রযুক্তিনির্ভর সেবা- রোবটিক সহকারী, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর চেক-ইন সিস্টেম, দ্রুত ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া। স্কাইট্র্যাক্সসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জরিপে এটি বারবার ‘বিশ্বের সেরা বিমানবন্দরগুলোর’ মধ্যে স্থান করে। প্রতিদিন গড়ে লাখ লাখ যাত্রী হানিদা থেকে উড়ে যায় বিশ্বের নানা প্রান্তে। বিশেষ করে ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের কাছে এর জনপ্রিয়তা অপরিসীম, কারণ টোকিও শহরে দ্রুত পৌঁছানোর সহজ সুযোগ এখানে রয়েছে। টার্মিনালের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়লো এডো-স্টাইল কাঠের গলি যেন ইতিহাসের মঞ্চে হেঁটে যাচ্ছি। দোকানের শেলফে সাজানো স্যুভেনির, জাপানি চা আর নাজুক কিমোনো আমাকে ডাকছিল বারবার। পাশেই এক রেস্টুরেন্ট থেকে ভেসে আসছিল রামেনের গন্ধ, অন্যদিকে তাকাতেই দেখা গেল তাজা সুসির কারুকাজ। মনে হলো, জাপান আমার স্বাদে আর ঘ্রাণে ঢুকে যাচ্ছে। হানিদায় নামার সঙ্গে সঙ্গেই যে জিনিসটি একজন পর্যটককে মুগ্ধ করে, তা হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নীরবতা ও সুসংগঠিত পরিবেশ। ব্যস্ততম আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট হয়েও এখানে কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। যাত্রী নামার পর কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন পেরোতে সময় লাগে খুবই কম, কারণ জাপানি দক্ষতা ও প্রযুক্তি মিলিয়ে প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুত। এয়ারপোর্টে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে শিল্পকর্ম, ডিজিটাল ডিসপ্লে, আর জাপানি আতিথেয়তার ছোঁয়া। টার্মিনাল-৩ মূলত আন্তর্জাতিক যাত্রীদের জন্য। এখানে রয়েছে-ডিউটি ফ্রি শপিং, আধুনিক গ্যাজেট থেকে শুরু করে ঐতিহ্যবাহী কিমোনো, স্যুভেনির, জাপানি চা ও স্ন্যাকস পাওয়া যায়। এয়ারপোর্ট রেস্টুরেন্টে সুসি, রামেন, টেম্পুরা থেকে শুরু করে পাশ্চাত্য খাবারের বিশাল ভান্ডার। পর্যটক সহায়তা কেন্দ্রে ইংরেজিভাষী গাইড, ট্যুর বুকিং ও ভ্রমণ তথ্য সহজেই পাওয়া যায়। টার্মিনালে মাঝেমধ্যে চোখে পড়ছিল হিউম্যানয়েড রোবট, যারা দিকনির্দেশনা দিচ্ছিল। রাতের ফ্লাইট মিস করলেও আতঙ্কের কিছু নেই, কারণ টার্মিনালের ভেতরেই আরামদায়ক ক্যাপসুল হোটেল ও লাউঞ্জ আছে। পুরো এয়ারপোর্ট জুড়ে শক্তিশালী ইন্টারনেট সংযোগ। প্রথমবার জাপানে পা রেখেই মনে হলো, আমি শুধু একটি এয়ারপোর্টে নামিনি, বরং টোকিওর আত্মার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ করেছি। হানিদা আমাকে স্বাগত জানিয়েছে এক শান্ত অথচ প্রাণবন্ত আলিঙ্গনে, যা যাত্রার শুরুতেই ভ্রমণকে করে তুলেছে স্মরণীয়। পর্যটকের জন্য সবচেয়ে বড় স্বস্তি হলো হানিদা শহরের একদম কাছাকাছি। মোনোরেলে হানিদা থেকে সরাসরি হামামাতসুচো স্টেশনে পৌঁছতে মাত্র ১৫ মিনিট লাগে। কেইকিউ লাইনে সরাসরি শিনাগাওয়া বা ইয়োকোহামা যাওয়া যায়। বাস সার্ভিস যোগে শহরের বড় হোটেল ও শপিং জোনে সহজে পৌঁছানো যায়। ট্যাক্সি করেও এয়ারপোর্ট থেকে ৩০ মিনিটে টোকিওর কেন্দ্রে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। একজন পর্যটকের চোখে হানিদা কেবল ভ্রমণের শুরু নয়, এ যেন টোকিওর আত্মার সঙ্গে প্রথম দেখা। পরিচ্ছন্নতা, সৌজন্য আর প্রযুক্তির সমন্বয়ে এ এয়ারপোর্ট বিশ্বকে জানিয়ে দেয়, আপনি এখন জাপানে। হানিদা এয়ারপোর্ট থেকে একটা ট‍্যাক্সি নিয়ে রওয়ানা হলাম টোকিও শহরের দিকে। সকালের সূর্য বিমানবন্দরের কংক্রিট রানওয়ে ও টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের কাচে সোনালি আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিলো। ট্যাক্সির জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিলো শহরের দিকে ধীরে ধীরে এগোতে থাকা রাস্তা, যেখানে প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি মোড় যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। নদীর ওপর সূর্যের কিরণ পড়ে পানির গায়ে স্বর্ণালি ছায়া তৈরি করছে, আর রাস্তার ধারে ছোট ছোট ক্যাফে থেকে কফির ঘ্রাণ বয়ে যাচ্ছে। মানুষেরা তাদের কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত, অফিসের দিকে হাঁটছে, সাইকেলে যাচ্ছেন, কখনোবা শিশুদের সঙ্গে স্কুলের পথে। গাড়ির হর্নের ছোট ছোট শব্দ, মানুষের কথার আওয়াজ আর পাখিদের কুহক মিশে সৃষ্টি করছে এক স্বপ্নিল শহরের সিম্ফনি। রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা আকাশচুম্বী বিল্ডিংগুলোর কাচের দেওয়ালগুলোতে প্রতিফলিত হচ্ছে সকালের রোদ। দূরে সকালের রোদে ঝলমল করছে টোকিও টাওয়ার। সূর্যোদয়ের সঙ্গে মিলেমিশে শহরের ভোরকে আরো রঙিন করে তুলছে। ট্যাক্সির ধীরে ধীরে চলা, রাস্তার আলো আর চারপাশের দৃশ্য একত্র হয়ে তৈরি করছে এক কবিতার মতো সকাল, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত শহুরে জীবনের গল্প বলছে। আমি ততক্ষণে পৌঁছি গেছি টোকিও শহরের প্রাণকেন্দ্র শিনজুকু এলাকায় আমার হোটেলের সামনে। পকেটে ১ লাখ ইয়েনের কড়কড়ে নোট নিয়ে যখন টোকিওর হানিদা বিমান বন্দরে অবতরণ করি তখন নিজের মধ্যে একটা বড়লোক বড়লোক ভাব ছিল। বিমানবন্দর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে মিডটাউন টোকিওর আমার হোটেলে যেতে যখন ১০ হাজার ইয়েন ট‍্যাক্সি ভাড়া দিতে হলো তখন ভাবের বেলুনটা একটু চুপসে গেল। পৃথিবীর সব হোটেলেই চেক-ইন হয় বেলা ৩টায়। কিন্তু বিশ্বের অনেক হোটেলেই দেখেছি কনসিডার করতে। কারণ শতভাগ রুম বুকিং সাধারণত হয় না। ফ্রন্ট কাউন্টারে যারা তাকে তাদের ইচ্ছার ওপরই আর্লি চেক-ইন হবে কি না তা নির্ভর করে। কিন্তু জাপানে আমার হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্কের কর্মরত মেয়েটি জানালো তাদের রুম খালি নেই। আমাকে ৩টার আগে রুম দেওয়া সম্ভব হবে না। চাইলে আমি লাগেজ রেখে এদিক সেদিক ঘুরে আসতে পারি। কি আর করা, আমি তাতেই রাজি হলাম। ট্যুর করতে দিয়ে এরকম মাঝেমধ্যেই ঘটে আমার জীবনে। সেবার পর্তুগালের লিসবনে এবং পরে একসময় আমার ঘরের কাছে ফ্লোরিডায় এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। সকালে গিয়ে রুম পাইনি। হয়তো থাকলেও তারা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। হোটেল থেকে বেড়িয়েই দেখলাম একটা ট‍্যাক্সি অপেক্ষমাণ। উঠে বললাম, মিটার অন করে দিন। আমি টোকিও শহরটা ঘুরবো। আপনার পছন্দমতো বা দর্শনীয় সব জায়গায় নিয়ে যান। আগামীকাল আমার স্থানীয় ট্যুর কোম্পানির সঙ্গে টোকিও পরিদর্শন আছে। আজ না হয় স্বাধীনভাবে ঘোরার একটা মহড়া দিই। ঘুরে ফিরে বেলা ২টায় হোটেলে ফিরে এলাম। মিটারে বিল হলো ৩১ হাজার ৫০০ ইয়েন। বিল মিটিয়ে হোটেল রুমে গেলাম। কাউন্টার থেকে জেনে কাছেই একটা হালাল হোটেলে গেলাম। মালিক জাপানিজ। তবে সব স্টাফ নেপাল এবং ভারতীয়। খাবারের দাম জানলাম। বললো প‍্যাকেজ আছে। ভাতের সঙ্গে ডাল বা চিকেন যে কোনো একটা নিন। দাম পড়ে ১ হাজার ইয়েন। খাবার শেষে এককাপ মাসালা চা নিলাম। দেখলাম, বিল হলো ১ হাজার ৫৬০ ইয়েন। জিজ্ঞেস করলাম এতো কেন। বললো ভাতের প‍্যাকেজ ১ হাজার ইয়েন। আর চা এককাপ ৬৬০ ইয়েন। তথাস্তু বলে বিল পরিশোধ করে হোটেলে ফিরে এলাম। কোনো এক গল্পে শুনেছিলাম, যে দেশে তেল-ঘি একদাম সে দেশ বিপজ্জনক। কিন্তু জাপানের মতো উন্নত দেশে ডালভাত অথবা চিকেন-ভাত কীভাবে একই দাম হয়, তা বুঝতে না পারলেও এতটুকু বুঝেছি এ দেশে ইচ্ছে থাকলেও বেশিদিন থাকা যাবে না। জাপান দেশটা বিপজ্জনক না হলেও নেপাল আর ভারতীয়রা তাদের ট্যুরিস্টদের জন‍্য দেশটাকে বিপজ্জনক করে রেখেছে। (চলবে)

# টোকিও, জাপান ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

শেয়ার করুন