০৩ অক্টোবর ২০২৫, শুক্রবার, ০৩:০০:৩৪ পূর্বাহ্ন


দেশকে সাবিনা ইয়াসমীন
আমাদের দেশে শিল্পীদের কদর কোনোদিন ছিল না
আলমগীর কবির
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৪-০৯-২০২৫
আমাদের দেশে শিল্পীদের কদর কোনোদিন ছিল না সাবিনা ইয়াসমীন


বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমীন। দীর্ঘ সংগীতজীবনে উপহার দিয়েছেন শত শত কালজয়ী গান। কিছুদিন অসুস্থতা কাটিয়ে আবারও গান করছেন নিয়মিত। তবে গানের মানুষ হিসেবে তাঁর মনের ভেতরে রয়েছে কিছু না বলা কথা শিল্পীদের প্রতি রাষ্ট্রের অবহেলা, সংগীতের প্রতি অবজ্ঞা, এবং রয়্যালটির অভাব। মগবাজারের তানপুরা রেকর্ডিং স্টুডিওতে নতুন গান রেকর্ড শেষে এসব বিষয় নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির

প্রশ্ন: কেমন আছেন, এখন কী ধরনের কাজ নিয়ে ব্যস্ত?

সাবিনা ইয়াসমীন: কিছুদিন শারীরিক অসুস্থতার কারণে গানের বাইরে ছিলাম। কিন্তু যেহেতু গানই আমার জীবন, তাই সুস্থ হওয়ার পর আবার গানে ফিরেছি। এখন নিয়মিত গাইছি, বিভিন্ন রেকর্ডিংয়ে অংশ নিচ্ছি। নতুন প্রজন্মের সুরকার, গীতিকারের সঙ্গে কাজ করছি, যা আমার জন্য খুবই আনন্দের। সব সময় চেষ্টা করি ভালো কথা, ভালো সুরে গাওয়া গান শ্রোতাদের উপহার দিতে।

প্রশ্ন: নতুন গান ‘অতীত গল্পগুলি’ সম্পর্কে কিছু বলবেন?

সাবিনা ইয়াসমীন: গানটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এটি সুর করেছেন তরুণ সুরকার সম্রাট আহমেদ। ওর সঙ্গে এটাই আমার প্রথম কাজ। সে দারুণভাবে সুরটি তৈরি করেছে। গানটির কথা লিখেছেন ফারুক আনোয়ার, খুব গভীর আর নান্দনিক কথা। গানটিতে একটা নস্টালজিক আবহ আছে ৭০-৮০ দশকের মেলোডির মতো, কিন্তু আধুনিক আয়োজনে। এমন গান এখন খুব কমই তৈরি হয়। আমি সত্যিই খুশি হয়েছি এমন একটা গানে কণ্ঠ দিতে পেরে। মনে হয়েছে, এতদিন পর এমন একটা গান গেয়ে নিজের ভেতরের শিল্পীসত্তা আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গন সম্পর্কে আপনার বর্তমান মূল্যায়ন কী?

সাবিনা ইয়াসমীন: খুব কষ্ট নিয়ে বলতে হয়, আমাদের দেশে শিল্পীদের কখনোই সেভাবে সম্মান বা মূল্য দেওয়া হয়নি। আগে যেমন ছিল না, এখনো তেমনটাই চলছে। রাষ্ট্রের যারা নেতৃত্বে আছেন, তাঁদের যদি সংগীত বা সংস্কৃতি সম্পর্কে হৃদয়ের টান না থাকে, তাহলে শিল্প-সংস্কৃতি কখনোই জায়গা পাবে না রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার তালিকায়। গানবাজনা শুধু বিনোদন নয়, এটি একটি জাতির আত্মার প্রকাশ। অথচ আমাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সে জাগরণ কখনোই আসেনি। আমরা যারা গান করে বেড়ে উঠেছি, দীর্ঘ জীবন দিয়েছি এই শিল্পকে, তারা তা হাড়ে হাড়ে টের পাই।

প্রশ্ন: পাশের দেশের সঙ্গে তুলনা করলে আপনি কী পার্থক্য দেখেন?

সাবিনা ইয়াসমীন: ভারতের উদাহরণ যদি দেই, লতা মঙ্গেশকর যখন জীবিত ছিলেন, তাঁর প্রতি সম্মানটা চোখে পড়ার মতো ছিল। আমরা দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পর্যন্ত তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করছেন। এ থেকে বোঝা যায়, ওখানে শিল্পকে কতটা শ্রদ্ধা করা হয়। তাঁরা জানেন, শিল্পীরা জাতির গর্ব, তাঁদের সম্মান দিলে জাতিও সম্মানিত হয়। অথচ আমাদের দেশে এমন কিছুর উদাহরণ নেই বললেই চলে। সরকারিভাবে কখনো মনে হয়নি, সংগীত বা শিল্পচর্চাকে গুরুত্ব দিয়ে সম্মান জানানো হয়েছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং এক ধরনের সংস্কৃতিক দারিদ্র্য বলে আমি মনে করি।

প্রশ্ন: দেশে তো অনেক বড় বড় শিল্পী ছিলেন, তাঁদের নিয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ কীভাবে দেখেন?

সাবিনা ইয়াসমীন: হ্যাঁ, আমাদের দেশে অসংখ্য কিংবদন্তি শিল্পী জন্মেছেন সুবীর নন্দী, এন্ড্রু কিশোর, আব্দুল আলীম, আবদুর রহমান বয়াতি তাদের অনেকেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু তাদের গানের কোনো আর্কাইভ নেই। কেউ তাঁদের গানগুলো সংরক্ষণ করার কথা ভাবে না। একটা জাতির সাংস্কৃতিক ইতিহাস সংরক্ষণের দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের হওয়া উচিত। অথচ এখানে মনে হয়, এসব কোনো দায় নয়। এত বছর ধরে আমরা শুনে এসেছি “আর্কাইভ করা হবে,” কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হয়নি। ভাবুন, ফরিদা পারভীনের মতো একজন শিল্পী নিভৃতে চলে গেলেন, কোনো রাষ্ট্রীয় আয়োজন, সংরক্ষণ, স্বীকৃতি কিছুই ছিল না। এটা তো আমাদের দুর্ভাগ্য।

প্রশ্ন: রয়্যালটির প্রসঙ্গও তো অনেকদিন ধরেই আলোচনায় আছে। আপনি কী মনে করেন?

সাবিনা ইয়াসমীন: এই প্রসঙ্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের অনেক দেশেই রয়্যালটি একটা নিয়মিত ব্যবস্থা। একজন শিল্পী যতবার তাঁর গাওয়া গান বাজে, তার একটা অর্থনৈতিক প্রতিদান তিনি পান। এতে করে শিল্পী ও তাঁর পরিবার একটা আর্থিক নিরাপত্তা পান, যা তাঁদের ভবিষ্যতের জন্য খুব দরকারি। কিন্তু আমাদের দেশে এই ব্যবস্থা নেই। এখানে একজন শিল্পী গাইলেন, গানটি হিট হলো, কিন্তু সে গানের কোনো আর্থিক ফলোআপ তাঁরা পান না। কত গুণী শিল্পীর পরিবার আজ অসচ্ছল অবস্থায় আছেন। যদি রয়্যালটির মতো ন্যায্য ব্যবস্থা থাকত, তাহলে তাঁরা অনেক ভালো থাকতে পারতেন। আমি মনে করি, সরকারকে এ বিষয়ে খুব দ্রুত এবং কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রশ্ন: আপনি কি ব্যক্তিগতভাবে কোনো আক্ষেপ অনুভব করেন?

সাবিনা ইয়াসমীন: আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব বেশি কিছু নিয়ে ভাবি না। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ, যে আমাকে এতদিন গাওয়ার শক্তি দিয়েছেন, শ্রোতারা আমাকে ভালোবেসেছেন। কিন্তু শিল্পীদের সম্মান, ভবিষ্যৎ সুরক্ষা এই জায়গাগুলো নিয়ে ভাবি। আমাদের পরের প্রজন্ম যেন সম্মান পায়, নিশ্চিন্তে গানের চর্চা করতে পারে, সেই পথটা তৈরি করে যেতে চাই। আমি আজ আছি, কাল থাকব না। কিন্তু দেশের সংস্কৃতি ও সংগীতচর্চা যেন টিকে থাকে, তার জন্য রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। এটা শুধু শিল্পীর দাবি নয়, জাতির ভবিষ্যতের জন্যই জরুরি।

শেয়ার করুন