নর্থ ক্যারোলিনার মেকলেনবার্গ কাউন্টি শেরিফ কার্যালয় হিজাব অপসারণের ঘটনায় এক মুসলিম নারীর সঙ্গে আদালতের বাইরে গত ২৬ সেপ্টেম্বর মামলার সমঝোতায় পৌঁছেছে। ২৭ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী লাইলা এল-আলি জানান, বুকিং ফটোগ্রাফের সময় তার হিজাব খুলে নেওয়া হয়েছিল। হিজাব খুলে নেওয়ার ঘটনায় তিনি তার মর্যাদাহানির চেষ্টা হিসেবে দেখছেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শেরিফ কার্যালয় তাদের নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে। লাইলা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তারা আমার মর্যাদা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার মর্যাদা কোনো প্রতিষ্ঠানের দান নয়, তা আমার স্রষ্টার পক্ষ থেকে। তিনি জানান, গত বছর শার্লটে ফিলিস্তিনপন্থী এক বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করার পর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। চার্জশিটে তার বিরুদ্ধে শব্দদূষণ ও যান চলাচলে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। যদিও পরবর্তী সময়ে আদালত সে অভিযোগ খারিজ করে এবং তার রেকর্ড মুছে ফেলা হয়।
২০২৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শার্লট সিটি কাউন্সিলের বৈঠকে ফিলিস্তিনে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাশের দাবিতে বিপুলসংখ্যক বিক্ষোভকারী উপস্থিত হয়। তারা কাউন্সিল চেম্বার দখল করে এবং অল্প সময়ের জন্য শহরের আপটাউন এলাকায় একটি সড়ক অবরোধ করে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে লাইলা এল-আলিসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। সমঝোতার অংশ হিসেবে মেকলেনবার্গ শেরিফ কার্যালয় ধর্মীয় মাথার আবরণ সম্পর্কিত নীতির পরিবর্তন করেছে। নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, যদি না কোনো নিরাপত্তাজনিত গুরুত্বপূর্ণ কারণ থাকে, তবে আটক ব্যক্তিরা হেফাজতে থাকার পুরো সময় তাদের ধর্মীয় মাথার আবরণ রাখতে পারবেন।
শেরিফ গ্যারি ম্যাকফাডেন এক বিবৃতিতে বলেন, এই মামলা তার জন্য একটি শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা। তিনি ইসলাম সম্পর্কে আরো জানতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ভবিষ্যতে সব ধর্মীয় অনুশীলনের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে মনোযোগী থাকবেন। তিনি আরো বলেন, আমরা সব সময় চেষ্টা করি, যাতে আমাদের হেফাজতে থাকা প্রতিটি ব্যক্তির ধর্মীয় বিশ্বাসকে যথাযথভাবে সম্মান করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক মামলা আমাদের দেখিয়েছে নীতিমালার উন্নয়ন কতটা জরুরি। লাইলা জানান, যখন তাকে ডিটেনশন সেন্টারে আনা হয়, তখন এক নারী কর্মকর্তা তার হিজাব সরিয়ে দেন। সে সময় তিনি হাতকড়া পরা অবস্থায় ছিলেন এবং পুরুষ কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বারবার অনুরোধ করেন, অন্তত বুকিং ছবির জন্য হিজাব খুলতে যেন তাকে বাধ্য করা না হয়। কিন্তু কর্মকর্তারা তার অনুরোধ উপেক্ষা করে হিজাবকে ‘নিষিদ্ধ বস্তু’ হিসেবে আখ্যায়িত করে খুলে দেন।
তিনি বলেন, তারা শুধু হিজাব খুলেই থামেনি, বরং জনসম্মুখে আমাকে তল্লাশি করেছে, এমনকি জামাও তুলেছিল। এটি আমার জন্য চরম অপমানের ছিল। লাইলা আরো জানান, হিজাব ছাড়া তোলা তার ছবি একটি মাগশট ওয়েবসাইটে চলে যায় এবং পরে তা সরানো হলেও তিনি সামাজিকভাবে গভীর লজ্জা ও মানসিক আঘাত পান। তার আইনজীবী ইসমাঈল কাইয়িম বলেন, এই ঘটনা শুধু ধর্মীয় স্বাধীনতা নয়, বরং একজন নারীর ব্যক্তিগত মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত।
মুসলিম নারীদের কাছে হিজাব কেবল একটি পোশাক নয়, বরং তা ধর্মীয় বিশ্বাস, ব্যক্তিগত মর্যাদা ও সামাজিক প্রতীক বহন করে। লাইলা বলেন, আমরা যারা হিজাব পরি, আমাদের প্রত্যেকের জন্য এর আলাদা মানে আছে। বিশেষ করে এমন একটি দেশে যেখানে ইসলামফোবিয়া বিদ্যমান, সেখানে হিজাব রাখা আমাদের মর্যাদার অংশ। শুধু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনে লাইলা ও অন্যান্য বক্তারা গাজায় চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়েও কথা বলেন। তারা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নীতির সমালোচনা করে বলেন, করদাতাদের অর্থ বিদেশে যুদ্ধের জন্য ব্যয় না করে স্থানীয় সম্প্রদায়ের উন্নয়নে ব্যয় করা উচিত।
লাইলা বলেন, আমরা কেন নিজের কমিউনিটিতে বিনিয়োগ না করে অন্য দেশে গণহত্যার জন্য অর্থ দিচ্ছি? আমাদের উদ্দেশ্য কী? জাতিসংঘের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণে প্রায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হওয়ার পর থেকে গাজায় ৬৫ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষ। শুক্রবার জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, তার দেশ হামাসের বিরুদ্ধে কাজ শেষ না করা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে যাবে। এর প্রতিবাদে বহু প্রতিনিধি সভা ত্যাগ করেন।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, মেকলেনবার্গের এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈষম্য ও ইসলামফোবিয়ার অংশ। আমেরিকান-ইসলামিক সম্পর্ক কাউন্সিল (কেয়ার ) এ মামলায় আইনি সহায়তা দিয়েছে। তাদের মতে, এমন ঘটনা শুধু একটি নারীর ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং মুসলিম নারীদের ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি সরাসরি হুমকি।
লাইলা এল-আলি ও মেকলেনবার্গ শেরিফ কার্যালয়ের এই সমঝোতা যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। এই মামলা প্রমাণ করেছে যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুশীলনকে উপেক্ষা করলে তা আইনি লড়াইয়ের মুখে পড়তে পারে। লাইলা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তারা আমাকে হেয় করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার মর্যাদা অটুট আছে। কারণ আমার মর্যাদা আমার স্রষ্টার পক্ষ থেকে। এ ঘটনার পর শুধু মেকলেনবার্গ নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কারাগার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার জন্যও ধর্মীয় অধিকার সুরক্ষার নীতিমালা হালনাগাদ করার দাবি জোরদার হচ্ছে।