১১ ডিসেম্বর ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১১:০৮:৩৩ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ত্রোয়েদশ জাতীয় নির্বাচন ও গনভোট ফ্যাক্টচেকিং ও কনটেন্ট মডারেশন কর্মীদের ভিসা নিষেধাজ্ঞা ৮ ডিসেম্বর থেকে এফ ও এম সাবওয়ে লাইন সপ্তাহের দিনে রুট পরিবর্তন উইন রোজারিওর খুনি পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনে লেটিকেয়ার অস্বীকৃতিতে জাপানের প্রথম রাজধানী নারা অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া পদত্যাগ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঘোষণা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বয়কট নিষিদ্ধ করে অ্যাডামসের বিতর্কিত আদেশ হোয়াইট হাউস প্রেস সেক্রেটারির ভাতিজার মাকে মুক্তির নির্দেশ বিশ্বকাপ ফাইনালে টিকেটের দাম ৬ হাজার ডলার


নতুন নীতি : অভিবাসীদের জীবন অনিশ্চয়তার মুখে
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ১০-১২-২০২৫
নতুন নীতি : অভিবাসীদের জীবন অনিশ্চয়তার মুখে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির নতুন নীতি-ঝুঁকিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১১ মিলিয়ন অনথিভুক্ত অভিবাসী


ওয়াশিংটন ডিসিতে গত সপ্তাহে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ন্যাশনাল গার্ডের দুই সদস্যের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনার পর মার্কিন রাজনীতিতে ঝড় উঠেছে। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে ট্রাম্প প্রশাসনের নেওয়া নতুন অভিবাসন সিদ্ধান্তগুলো। ন্যাশনাল গার্ড সদস্যদের একজন নিহত এবং অপরজন আহত হওয়ার ঘটনাকে যুক্তি হিসেবে সামনে এনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় অভিবাসনবিরোধী কঠোর অবস্থান প্রকাশ করেছেন। ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি থার্ড ওয়ার্ল্ড অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশ বা গ্লোবাল সাউথ থেকে সব ধরনের অভিবাসন বন্ধ করে দেবেন। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সেক্রেটারি ক্রিস্টি নোয়েম প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, যে দেশগুলো আমাদের দেশে খুনি, পরজীবী এবং সুবিধাভোগী পাঠাচ্ছে, সেসব ‘সমস্যা সৃষ্টিকারী’ দেশের ওপর অবিলম্বে নিষেধাজ্ঞা জারি করা উচিত। নোয়েমের এ বক্তব্য মার্কিন রাজনীতিতে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, প্রশাসনের এসব বক্তব্য শুধু অমানবিক ও বিভাজনমূলকই নয়, বরং কঠোর নীতির আড়াল তৈরি করছে-যা ইতোমধ্যেই কার্যকর হতে শুরু করেছে এবং মার্কিন অভিবাসন ব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তন আনছে।

গত সপ্তাহের প্রথম দিক থেকেই ন্যাশনাল গার্ড সদস্যদের নিহত হওয়ার আগেই ট্রাম্প প্রশাসন ধারাবাহিকভাবে এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে থাকা শতসহস্র অভিবাসীর ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রশাসন শুধু নতুন আবেদন স্থগিত করেনি; এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পূর্বে অনুমোদিত আবেদনের সম্ভাব্য পুনর্মূল্যায়ন, যা গত চার বছর বা তারও পূর্বের অনুমোদিত অভিবাসন সুবিধাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস (ইউএসসিআইএস)-এর বিভিন্ন নীতি নির্দেশনা থেকে জানা গেছে, কীভাবে প্রশাসন এই কঠোর নীতি প্রয়োগ করতে চায়।

প্রশাসনের জারি করা সর্বশেষ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় থাকা ১৯টি দেশের নাগরিকদের অভিবাসন সুবিধার সব ধরনের আবেদন প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে। এই সুবিধার মধ্যে রয়েছে গ্রিন কার্ডের আবেদন, নাগরিকত্বের আবেদন, কাজের অনুমতি, এমনকি অস্থায়ী ভিসাধারীদের স্ট্যাটাস নবায়ন বা স্ট্যাটাস পরিবর্তনের আবেদনও। ইউএসসিআইএস কর্মীরা নির্দেশ পেয়েছেন যে এসব আবেদন আপাতত কোনোভাবেই প্রক্রিয়াকরণ করা যাবে না। ইতোমধ্যে বহু আবেদনকারীর নির্ধারিত সাক্ষাৎকার, এমনকি নাগরিকত্ব প্রদানের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের তারিখও বাতিল করা হয়েছে। প্রশাসনের দাবি, এই স্থগিতাদেশ সমগ্র নিরাপত্তা নীতিমালা পর্যালোচনার জন্য প্রয়োজন।

স্থগিতাদেশ কতদিন চলবে তা স্পষ্ট নয়। মেমোতে উল্লেখ করা হয়েছে, ইউএসসিআইএস ৯০ দিনের মধ্যে অপারেশনাল নির্দেশনা দেবে। তবে স্থগিতাদেশ এই সময় শেষে উঠে যাবে নাকি আরো বাড়বে-তা অনিশ্চিত। আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, থ্যাংকসগিভিংয়ের দিন যে নীতি পরিবর্তন আনা হয়েছে, তার ফলে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা-আবদ্ধ দেশের নাগরিকত্ব বা দেশীয় পরিচয় এখন থেকে ‘উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক উপাদান’ হিসেবে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ আবেদনকারীর ব্যক্তিগত যোগ্যতা নয়, বরং তিনি কোন দেশ থেকে এসেছেন, সেটি তার অনুমোদনের সম্ভাবনাকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পারে।

অ্যাসাইলাম বা আশ্রয় প্রার্থীদের ক্ষেত্রেও নতুন নির্দেশনা জারি করেছে ইউএসসিআইএস। এখন থেকে কোনো আশ্রয় আবেদনেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে না। অর্থাৎ অনুমোদন, প্রত্যাখ্যান, এমনকি প্রশাসনিক বন্ধ-সবই স্থগিত। তবে সাক্ষাৎকার গ্রহণ অব্যাহত থাকবে। অর্থাৎ ইউএসসিআইএস আংশিক প্রক্রিয়া বজায় রেখে সিদ্ধান্ত প্রদান অংশটি পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে। এ স্থগিতাদেশও একইভাবে ৯০ দিনের পর্যালোচনার ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে ইউএসসিআইএসের সামনে ১৫ লাখেরও বেশি মুলতবি আশ্রয় আবেদন রয়েছে। এপ্রিল থেকে জুন, এই তিন মাসে প্রায় ১ দশমিক ৩৫ লাখ সিদ্ধান্ত দেওয়া হলেও তার বেশির ভাগ ছিল প্রশাসনিক বন্ধ; প্রকৃত অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান ছিল মাত্র প্রায় ১০ হাজার। নতুন স্থগিতাদেশে এই জট আরো বাড়বে।

আফগানিস্তান ইতোমধ্যেই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা-আবদ্ধ দেশের তালিকায় ছিল। নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সব আফগান নাগরিকের ভিসা আবেদন আইএনএ ২২১ (জি) ধারায় আপাতত প্রত্যাখ্যান করতে হবে। শুধু তাই নয়, যেসব ভিসা ইতোমধ্যেই ছাপা হয়েছে, কিন্তু আবেদনকারীর হাতে পৌঁছেনি, সেগুলোও ধ্বংস করতে হবে। বিশেষ অভিবাসী ভিসার মাধ্যমে যেসব আফগান মার্কিন সেনাদের সহায়তা করেছিলেন, তাদের জন্যও এই বাধা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এ পদক্ষেপটি সবচেয়ে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। এখানে দুটি গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করা হয়েছে। ১) বাইডেন প্রশাসনের চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসিত দুই লক্ষাধিক শরণার্থী। ২) ২০২১ সালের ২১ জানুয়ারির পর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে যে কোনো অভিবাসন সুবিধা পাওয়া নিষিদ্ধ দেশের নাগরিক।

ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, বাইডেন প্রশাসন শরণার্থীদের ক্ষেত্রে যথেষ্ট কঠোর মানদণ্ড প্রয়োগ করেনি এবং অনেক আবেদন ‘অতিরিক্ত দ্রুত’ অনুমোদিত হয়েছে। তাই প্রতিটি শরণার্থী আবেদনই পুনরায় মূল্যায়ন করা হবে। যারা মানদণ্ড পূরণ করতে ব্যর্থ হবে, তাদের শরণার্থী মর্যাদা বাতিল হবে, ফলে তারা সরাসরি অবৈধ অভিবাসীর পর্যায়ে পড়বে। যদি না তারা অন্য কোনো বৈধ স্ট্যাটাস ইতোমধ্যেই পেয়ে থাকে। চার বছরে বাইডেন প্রশাসন প্রায় ২ লাখ শরণার্থীকে দেশে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিল এখন তাদের সব আবেদনই পুনরায় খোলা হতে পারে। ২০২১-২০২৩ সালে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা-আবদ্ধ দেশগুলোর নাগরিকদের ৩ লাখেরও বেশি গ্রিনকার্ড ইস্যু করা হয়েছে। এর বাইরে রয়েছে হাজার হাজার ছাত্র ভিসা, কর্ম ভিসা, পারিবারিক ভিসা, আশ্রয় সিদ্ধান্ত, স্ট্যাটাস নবায়ন বা পরিবর্তন। আফগানিস্তান থেকে বিশেষ অভিবাসী ভিসায় আসা হাজার হাজার মানুষও এ পর্যালোচনার আওতায় পড়তে পারেন। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে বৈধভাবে অবস্থানরত অন্তত ৬-৮ লাখ মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এ নীতির আওতায় পড়তে পারেন, যা সাম্প্রতিক মার্কিন অভিবাসন ইতিহাসে নজিরবিহীন।

ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, এসব পদক্ষেপ জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু অভিবাসন বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার সংস্থা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই নীতি বাস্তবে বৈধ অভিবাসীদের ওপর চাপ সৃষ্টি এবং ট্রাম্পের রাজনৈতিক ভিত্তিকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে। অনেকের মতে, এটি শুধু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং অভিবাসন ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করার চেষ্টা, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এদিকে বিপুলসংখ্যক অভিবাসী পরিবার এখন গভীর উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছে। তারা জানে না তাদের ভবিষ্যৎ কোথায় ঝুলে আছে। বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে বসবাস করলেও হঠাৎ করে তাদের জীবনে অনিশ্চয়তার মেঘ নেমে এসেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এ নীতি কেবল অভিবাসীদের জীবনেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। মার্কিন ইতিহাসে অভিবাসন একসময় শক্তি ও বৈচিত্র্েযর প্রতীক ছিল, বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটিই বড় প্রশ্নের মুখে।

শেয়ার করুন