পালান্টির
ইউএস ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস) তাদের অভিবাসন প্রয়োগ ও নজরদারি ব্যবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহারে নতুন করে সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে। যদিও সরকারি নথিতে একে সীমিত বা পুনর্গঠনের আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট (ডিএইচএস) প্রকাশিত হালনাগাদ এআইয়ের ব্যবহার কেস ইনভেন্টরিতে একাধিক এআই প্রোগ্রামকে নিষ্ক্রিয় বা ইনঅ্যাকটিভ দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে এআই ব্যবহারের সংকোচন নয়, বরং আরো বড় ও জটিল নজরদারি ব্যবস্থার দিকে রূপান্তরের দিকে চলছে। আলাদা সফটওয়্যার বাদ দেওয়ার বদলে আইস এখন বড় বেসরকারি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের তৈরি সমন্বিত প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আরো গভীর, নিরবচ্ছিন্ন ও সর্বব্যাপী নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তুলছে। এ পরিবর্তন অভিবাসীদের গোপনীয়তা, নাগরিক অধিকার এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
চলতি বছরের গ্রীষ্মে প্রকাশিত ডিএইচএসের এআই ইউজ কেস ইনভেন্টরির হালনাগাদ সংস্করণটি প্রথমে সাধারণ প্রশাসনিক পরিবর্তনের মতোই মনে হয়। কিছু সফটওয়্যারকে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে, আবার একটি নতুন পরীক্ষামূলক এআই টুল যুক্ত করা হয়েছে। তবে দ্য গার্ডিয়ান, ওয়ার্ড এবং এনপিআরের মতো প্রভাবশালী গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সঙ্গে এই পরিবর্তনগুলো মিলিয়ে দেখলে একটি ভিন্নচিত্র সামনে আসে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আইসিই এখন আলাদা আলাদা এআই প্রোগ্রামের পরিবর্তে বড় বেসরকারি প্রযুক্তি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের তৈরি সমন্বিত প্ল্যাটফর্মের ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠছে।
ডিএইচএসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাসে আইস অভিবাসন প্রয়োগের কাজে ২৩টি সক্রিয় এআই সফটওয়্যার ব্যবহার করছিল। কিন্তু জুলাই মাসে দেখা যায়, এর মধ্যে চারটি প্রোগ্রামকে নিষ্ক্রিয় হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এবং একটি প্রোগ্রাম ইমেইল অ্যানালিটিক্স ফর ইনভেস্টিগেটিভ ডেটা পুনরায় মূল্যায়ন ও পুনর্বিন্যাসের জন্য ইমপ্লিমেন্টেশন অ্যান্ড অ্যাসেসমেন্ট পর্যায়ে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কাগজ-কলমে এটি এআই ব্যবহারে একটি পিছিয়ে আসার ইঙ্গিত দিলেও বাস্তবচিত্র ভিন্ন। নিষ্ক্রিয় ঘোষিত প্রোগ্রামগুলোর মধ্যে ছিল জব্দ করা মোবাইল ফোন ও ডিভাইস থেকে তথ্য বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহৃত মোবাইল ডিভাইস অ্যানালিটিক্স, পরিচয়পত্র ও ভ্রমণ নথি স্ক্যান করার আইডেনটিফিকেশন কার্ড অ্যান্ড ট্রাভেল ডকুমেন্ট কোড ডিটেকশন, অডিও রেকর্ডিং থেকে কণ্ঠস্বর শনাক্ত ও অনুবাদ করার ভয়েস অ্যানালিটিক্স এবং ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে মুখ বা নির্দিষ্ট দৃশ্য শনাক্ত করার ভিডিও অ্যানালাইসিস টুল। এই প্রোগ্রামগুলো নিষ্ক্রিয় হলেও সংশ্লিষ্ট কার্যকারিতা যে বন্ধ হয়ে গেছে এর এমন কোনো প্রমাণ নেই।
অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আইসিই বর্তমানে পালান্টির, ক্লিয়ারভিউ এআই, বিএআই ২, প্যারাগন এবং সেলেব্রাইটের মতো বেসরকারি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের তৈরি বড় প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে। এসব প্ল্যাটফর্মে পরিচয়পত্র স্ক্যান, মোবাইল ফোন হ্যাকিং ও ডেটা এক্সট্রাকশন, মুখ ও চোখের আইরিস শনাক্তকরণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যবেক্ষণ এবং বিভিন্ন সরকারি ও বাণিজ্যিক ডেটাবেসের তথ্য একত্রে বিশ্লেষণ করার সুবিধা রয়েছে।
পালান্টিরের তৈরি অভিবাসন-সংক্রান্ত সিস্টেমগুলো আইসিই-র অন্যতম প্রধান প্রযুক্তিগত ভিত্তি হয়ে উঠেছে। এসব সিস্টেমের মাধ্যমে ড্রাইভিং লাইসেন্স স্ক্যান, ভ্রমণ রেকর্ড, ট্যাক্স সংক্রান্ত তথ্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্ট, এমনকি জব্দ করা ফোন থেকে পাওয়া ব্যক্তিগত তথ্য একত্র করে একটি ইউনিফায়েড ইনভেস্টিগেটিভ ফাইল তৈরি করা হয়। ওয়্যার্ডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ধরনের প্ল্যাটফর্ম তদন্তকারীদের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ড্যাশবোর্ড তৈরি করে, যেখানে একজন ব্যক্তির জীবনের বিভিন্ন দিক এক নজরে দেখা সম্ভব হয়।
এনপিআরের প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, আইসিই মাঠপর্যায়ে মোবাইল ফেসিয়াল রিকগনিশন অ্যাপ এবং আইরিস স্ক্যানার ব্যবহার করছে। এগুলোর মাধ্যমে অভিবাসন কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ব্যক্তির পরিচয় যাচাই করতে পারেন। ফলে আগে যেসব কাজ আলাদা আলাদা সফটওয়্যার দিয়ে করা হতো, এখন সেগুলো একীভূত প্ল্যাটফর্মের মধ্যেই সম্পন্ন হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখানেই মূল উদ্বেগের জায়গা। যখন বহু আলাদা এআই টুল একত্রিত হয়ে একটি বড় ব্ল্যাক বক্স সিস্টেমে পরিণত হয়, তখন নজরদারি ও জবাবদিহি আরো কঠিন হয়ে পড়ে। কোন তথ্য কোথা থেকে আসছে, কীভাবে তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, কোন অ্যালগরিদম কীভাবে ঝুঁকি নির্ধারণ করছে-এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে ভুল তথ্য বা পক্ষপাতমূলক ডেটার প্রভাব শনাক্ত করা কঠিন হয় এবং সেই ভুল সিদ্ধান্তের ফল ভোগ করতে হয় সাধারণ মানুষকে।
ডিএইচএসের হালনাগাদ ইনভেন্টরিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংস্থাটি তিনটি বাণিজ্যিক জেনারেটিভ এআই সেবা ব্যবহার বন্ধ করেছে, যেগুলো মূলত কোড লেখা, ছবি তৈরি ও চ্যাটবট সেবার জন্য ব্যবহৃত হতো। এর পরিবর্তে লাইগার জেনএআই টুলকিট নামে একটি নতুন পরীক্ষামূলক প্রোগ্রাম যুক্ত করা হয়েছে। এই টুলটি মূলত ফেডারেল কর্মীদের প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করার জন্য তৈরি, যেমন চুক্তির খসড়া তৈরি বা বড় নথির সারসংক্ষেপ লেখা।তবে অনেকের মতে, প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত এআই এবং নজরদারি বা আইনপ্রয়োগে ব্যবহৃত এআইয়ের মধ্যে স্পষ্ট সীমারেখা টানা সব সময় সম্ভব হয় না। একবার কোনো সংস্থা বড় আকারের এআই অবকাঠামো গড়ে তুললে, সেটি কীভাবে এবং কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার হবে, সে বিষয়ে স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
এই প্রেক্ষাপটে আরো উদ্বেগজনক একটি তথ্য সামনে এনেছে ওয়ার্ড। তাদের হাতে পাওয়া সরকারি নথি অনুযায়ী, আইসিই প্রায় ৩০ জন ঠিকাদার নিয়োগের পরিকল্পনা করছে, যাদের কাজ হবে ফেসবুক, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি চালানো। এসব ঠিকাদার অনলাইন পোস্ট, ছবি ও প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য লিড তৈরি করবেন, যা পরে আইসিইয়ের এনফোর্সমেন্ট অ্যান্ড রিমুভাল অপারেশনস বিভাগ ব্যবহার করবে।
এই পরিকল্পনা আইসিইয়ের কৌশলে একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। আগে যেখানে এআই টুলগুলো মূলত বিদ্যমান তথ্য বিশ্লেষণে ব্যবহৃত হতো, এখন সেখানে বাস্তব সময়ে মানুষের অনলাইন কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণের দিকে ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি একটি কন্টিনিউয়াস সারভেইলেন্স পাইপলাইন বা নিরবচ্ছিন্ন নজরদারি ব্যবস্থার সূচনা, যেখানে এআই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি চিহ্নিত করবে।অধিকারকর্মীরা বলছেন, এই ধরনের নজরদারি ব্যবস্থা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ন্যায্য প্রক্রিয়ার মৌলিক অধিকারকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করা একটি পোস্ট বা ছবি কীভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হবে, এবং সেই সিদ্ধান্তের ভিত্তি কী,এসব বিষয়ে স্পষ্ট নিয়ম না থাকলে অপব্যবহারের আশঙ্কা থেকে যায়।
বিশ্লেষকদের মতে, এআই-চালিত এই সিস্টেমগুলোকে প্রায়ই নিরপেক্ষ বা কারিগরি সমাধান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এগুলো নীতিগত সিদ্ধান্তেরই ফল। কোন ডেটা ব্যবহার করা হবে, কোন আচরণকে সন্দেহজনক ধরা হবে, কোন ঝুঁকিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এসবই মানুষের তৈরি সিদ্ধান্ত। ফলে এই প্রযুক্তিগুলো রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বহন করে। সব মিলিয়ে, জুলাই মাসের ডিএইচএস এআই ইউজ কেস ইনভেন্টরির হালনাগাদ সংস্করণটি কেবল কয়েকটি সফটওয়্যারের নাম বদল বা অবস্থান পরিবর্তনের বিষয় নয়। এটি যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন প্রয়োগ ব্যবস্থায় একটি গভীর পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। যেখানে আলাদা আলাদা এআই প্রোগ্রামের পরিবর্তে বড়, সমন্বিত এবং ক্রমাগত নজরদারি চালানো সক্ষম প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝোঁক বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলোর মতে, এই পরিস্থিতিতে স্বাধীন অডিট, বেসরকারি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা চুক্তির স্বচ্ছতা এবং শক্তিশালী কংগ্রেসীয় তদারকি অত্যন্ত জরুরি। নইলে এআই-নির্ভর এই নজরদারি ব্যবস্থা এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যেগুলো প্রভাবিত মানুষের পক্ষে বোঝা বা চ্যালেঞ্জ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে।