তিস্তার পানি বন্টনের দাবি থেকে কী সরে আসছে বাংলাদেশ? এ প্রশ্ন এখন সর্বত্র। ঢাকা ও দিল্লিতে যে আলোচনা বিদ্যমান তাতে তিস্তার পানি বন্টন চুক্তির চেয়ে তিস্তায় বাংলাদেশ অংশে যে পানি সংরক্ষণের যে মহা পরিকল্পনা তাতে আগ্রহ বেশি বলে মনে হচ্ছে। মহা পরিকল্পনার ব্যাপারে হঠাৎ দিল্লির যে আগ্রহ সেটা চীনের দেয়া প্রস্তাবনা। কেননা তিস্তার পানি অভাবে বাংলাদেশ জীবন মরণ সমস্যা, দেশ যখন মরুভুমিতে রূপ নেয়ার পথে সে সময় চীন এগিয়ে এসে তিস্তা বাংলাদেশ অংশে একটি নতুন মহা পরিকল্পনা করেছিল পানি আটকিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা তৈরিত। যাতে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘ এক যুগে ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তির পানে চাতক পাখির মত চেয়ে থাকতে হতো না। পাশাপাশি পনি বন্টন দাবি ঠিকই থেকেই যেত। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ভারত এখন সে মহাপরিকল্পনাটাই করে দিতে আগ্রহী।
অথচ ভারত দীর্ঘদিন তিস্তার পানি না দেয়া তথা বন্টন ঝুলিয়ে রাখার জন্যই চীন এগিয়ে এসে বাংলাদেশকে সেভ করতে ওই মহা পরিকল্পনা তৈরি করে। ভারত এ কাজটি করে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করায় বাংলাদেশও এখন খুশি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে ২৫ জুন সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, তাঁর সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশ ও জনগণের জন্য যে প্রস্তাব সবচেয়ে বেশি লাভজনক তা গ্রহণ করবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা তিস্তা প্রকল্প নিয়েছি। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীন ও ভারত আলাদা আলাদা প্রস্তাব দিয়েছে। আমাদের দেশের জনগণের জন্য কোন প্রস্তাবটি অধিক লাভজনক ও উপযোগী হবে সেটাই আমরা গ্রহণ করবো। তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে চীন আমাদের প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতও দিয়েছে। আরও প্রস্তাব এসেছে। অবশ্যই আমরা বিবেচনা করবো, কোন প্রস্তাবটি গ্রহণ করলে তা আমার দেশের মানুষের কল্যাণে আসবে সেটাই আমি গ্রহণ করবো। কোন প্রস্তাবটা নিলে কতটুকু ঋণ নিলাম এবং কতটুকু আমাদের পরিশোধ করতে হবে, কতটুকু দিতে পারবো-এসব কিছু বিবেচনা করেইতো আমাদের করতে পরিকল্পনা নিতে হবে।’
সরকার প্রধান বলেন, সে ক্ষেত্রে ভারত যেহেতু বলেছে তারা করতে চায় এবং টেকনিক্যাল গ্রুপ বানাবে, তারা অবশ্যই আসবে। আমরা যৌথভাবে সেটা দেখবো। চীন একটা সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। ভারতও একটা করবে এবং এটার পর আমাদের কাছে যেটা সবচেয়ে বেশি প্রহণযোগ্য ও লাভজনক মনে হবে আমরা সেটাই করবো।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেহেতু ভারতের কাছে আমাদের তিস্তার পানির দাবিটা অনেক দিনের, সেক্ষেত্রে ভারত যদি আমাদের তিস্তা প্রকল্পটি করে দেয় তবে আমাদের সব সমস্যারই সামাধান হয়ে যায়। তাহলে সেটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে সহজ হলো-আপনারা নিজেরাই বিবেচনা করে দেখেন।
শেখ হাসিনা বলেন, কাজেই ভারত যখন এগিয়ে এসেছে আমরা এটাই মনে করি যে ভারতের সাথে যদি আমরা এই তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করি তাহলে আমার দেশের পানি নিয়ে প্রতিদিন সমস্যায় পড়তে হবে না। আমরা সেই সুবিধাটা পাব। ভারত বাংলাদেশের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তারাও বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সমস্যা রয়েছে। তিনি বলেন,“সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে।” গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি ২০২৬ সালের শেষ হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যদি চুক্তিটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নবায়ন নাও করা হয় তাহলেও তা অব্যাহত থাকবে। তিস্তা ও গঙ্গা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে ভারত সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আপত্তি উত্থাপন সংক্রান্ত অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না। কেননা এটা তাদের (ভারত) অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু ভারতের সকল রাজনৈতিক দল এবং প্রধানমন্ত্রী নেরেন্দ্রে মোদী এবং মূখ্য মন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক রয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, “আমার সঙ্গে সবার সম্পর্ক ভালো। মমতা ব্যানার্জির সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো, আবার প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও। অন্যান্য সব দলের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ভালো। ভারতের দল মত নির্বিশেষে সবার সঙ্গে আমার একটা সুসম্পর্ক আছে।”
উল্লেখ্য, তিস্তার পানি প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে যে কোনো চুক্তি মমতা মেনে নেবেনা বা বাংলার জনগণ মেনে নেবে না বলে হুমকি দিয়ে চিঠি দেয় দিল্লিকে। সেখানে তিনি আরো বলেন, তিস্তার পানি বন্টন সংক্রান্ত কোনো কিছু হলে সেখানে তার এলাকার মানুষের জন্য ভীষন ক্ষতিকারক। এটা তিনি ও তার রাজ্যের মানুষ মানবে না।
দিল্লিকে লেখা চিঠিতে মমতা লেখেন, পশ্চিমবঙ্গকে ‘পাশ কাটিয়ে’ ফারাক্কা চুক্তি নবায়ন ও তিস্তার পানি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া ‘অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রত্যাশিত’। দিল্লিতে শেখ হাসিনার সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, তার সরকার ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি নবায়নের বিষয়ে কারিগরি পর্যায়ের আলোচনা শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আলোচনার জন্য ভারতের একটি কারিগরি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে।
দিল্লিতে শেখ হাসিনা ও মোদীর তিস্তা আলাপের পরপরই চটেছেন মমতা ব্যানার্জি। ২০১১ সালে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি আটকে দেওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবারও দিল্লির আগ্রহ ভালোভাবে নেননি। এর পরপরই মোদীকে পাঠানো এক চিঠিতে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশকে ‘কোনোভাবেই’ তিস্তার পানি দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ পানি ভাগাভাগি করতে হলে পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষ পানীয় জল ও সেচের পানি থেকে ‘বঞ্চিত’ হবে। গঙ্গার বণ্টন চুক্তি নবায়নের ক্ষেত্রেও মমতার প্রবল আপত্তি রয়েছে। তিনি বলেছেন, ফারাক্কা বাঁধের কারণে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন নদী শুকিয়ে যাওয়ায় কৃষি ক্ষেত্রে সমস্যা বেড়েছে, মানুষ পানীয় জলের সংকটেও ভুগছে। মোদীকে লেখা চিঠি মমতা বলেছেন, “বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরে তিস্তা ও গঙ্গার পানি বণ্টন প্রশ্নে আলোচনা হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সঙ্গে সলাপরামর্শ না করে, মতামত না নিয়ে এককভাবে কেন্দ্রের এমন আলোচনা-পর্যালোচনা অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রত্যাশিত।”
সম্প্রতি আলোচিত এসব ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে গেছে তিস্তার পানি বন্টনের যে বাংলাদেশের এক যুগের যে দাবি সেটা আড়ালে পড়ে গেছে। এখন আলোচনা বাংলাদেশের অর্থে বা বাংলাদেশকে ঋণ দিয়ে সে অর্থদিয়ে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পান সংরক্ষণে একটা বিকল্প তৈরি করা। যে অর্থ বাংলাদেশের কোষাগার থেকেই পরিশোধ করতে হবে, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় নির্মিত করতে হবে এমন মহাপরিকল্পনা। কারো দয়ার দানে হবে না এটা। সে যদি চীন করে দেয় তবুও। অথচ বাংলাদেশের ন্যয্য দাবি তিস্তার পানি, সম্ভবত সেটা বঞ্চিতই থাকবে।
নজরুল ইসলাম খান
এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন সরকার ভারতকে ট্রানজিট নয়, করিডোর দিয়েছে সরকার। আর তিস্তা প্রকল্পের কাজে ভারতের সঙ্গে রাজি হলে পানি বণ্টন প্রসঙ্গ থেকে সরকার সরে আসবে। সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবের আব্দুস সালাম হলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আয়োজিত জাতীয় সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিষয়ে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা প্রতিবেশী বদলাতে পারব না। প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক থাকবে, কিন্তু সেটা হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও স্বার্থের ভিত্তিতে। যখনই আমাদের সরকার রাজি হবে, তিস্তা প্রকল্পে আমরা ভারতের সহযোগিতা নিব, তাহলে বুঝতে হবে সরকার তিস্তার পানিবণ্টনের যে প্রসঙ্গ, সেখান থেকে সরে এসেছে।’
সবশেষ
আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে তিস্তার পানির ন্যয্যা অধিকার বাংলাদেশেরও আছে। কিন্তু ভারত সেটা দীর্ঘদিন উপেক্ষা করে চলছে। যার অন্তরালে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের কিছুটা ক্ষতি সাধন হবে সে জন্য। অথচ এ পানির অভাবে বাংলাদেশের নদনদী মৃতপ্রায়। কৃষক প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছেনা চাষাবাদে। ব্যহত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন। নদ নদী শুকিয়ে যাওয়ায় সে অঞ্চলের শিল্প কলকারাখানাও বিলুপ্তপ্রায়। তাছাড়া নদনদী শুকিয়ে চর পড়ে যাওয়া মানে বর্ষা মওসুমে যখন তিস্তায় পানি বেড়ে যায় তখন আচমকা পানি ছেড়ে দেয় ভারত। সে পানি ধারনের আর ক্ষমতা থাকে না নদীর। পানি প্লাবিত হয় গ্রামাঞ্চলের জনপদে। হঠাৎ আসা ওই পানিতে আবার যেটুকু বিকল্প উপায়ে পানি দিয়ে চাষাবাদ হয় তা তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক। তলিয়ে যায় শত শত কোটি টাকার মৎস্য প্রজেক্ট, খামার। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর। বিনষ্ট হয় ফসল। যার অর্থ বিপুল ক্ষতি। কৃষকসহ গ্রামের সাধারণ মানুষ হয়ে পড়েন দিশেহারা। এভাবেই চলে আসছে যুগ ধরে। ন্যায্য পানিটুকু পেলে বাংলাদেশ এ সমস্যা থাকতো না।
বলার অপেক্ষা রাখেনা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দেশ ভারত অকৃতিম বন্ধু। কিন্তু বন্ধুত্বের উৎকৃষ্ট উদহরন বন্ধুর প্রয়োজনে সারা দেয়া। বন্ধু যাতে কষ্ট না পায় সে দিকটাও খেয়াল রাখা। বাংলাদেশ অন্তত এ দিক থেকে ভারতের কাছ থেকে উপেক্ষিত হচ্ছে বছরের পর বছর।