লং আইল্যান্ডে থাকেন একজন প্রবাসী। তিনি অন্যান্য প্রবাসীর মতোই বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। হঠাৎ করেই তিনি তার ফোন বের করলেন এবং দেখালেন তার বাড়ি পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘিরে ফেলেছে। বাসার গেটে পুলিশ টোকা দিলে। দারোয়ানকে গেট খুলতে তাকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করা হলো। এক পর্যায়ে পুলিশ দারোয়ানের গালে থাপ্পড় মারলেন। এরপর দারোয়ান পুরো গেট খুলে দেয়। দেখা গেল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় সাতটি গাড়ি। পুলিশ দারোয়ানকে সঙ্গে নিয়েই সাততলা বাড়ির প্রতিটি রুম চেক করলেন এবং কলেজপড়ুয়া একজন ছাত্রকে ধরে নিয়ে গেল। তিনি প্রশ্ন রেখে বললেন, ভাই কোন দেশে আমরা বসবাস করছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও এই ভয়াবহ চিত্র দেখেনি। তাকে প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, আমাদের পরিবারে কেউ সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করে না। আমি নিজেও সরকারি দলের সমর্থক। কিন্তু এ চিত্র দেখে আমি অবাক হয়েছি। থানায় কল দিয়েছি। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বললেন, এটা রুটিন ওয়ার্ক। আপনাদের পরিবারের কাউকেতো গ্রেফতার করা হয়নি। এ চিত্র এখন বাংলাদেশের শহর থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত।
জ্যাকসন হাইটসে বসবাস করেন একজন বিএনপি সমর্থক। তাকে মাঝেমধ্যেই বিএনপির মিছিল মিটিংয়ে দেখা যায়। গত সপ্তাহে এ প্রতিনিধিকে জানালেন, ভাই কোন দেশে আমার পরিবার-পরিজনকে রেখে এসেছি। আমি এখানে রাজনীতি করি। রাজনীতি করার কারণে বাংলাদেশে আমার ভাইদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। তাদের পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। তারা দেশ থেকে ফোন করে আমাকে প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছে, আমি যেন মিছিল মিটিংয়ে না যাই। কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না।
এ চিত্র এখন পুরো বাংলাদেশে। আরো কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি জানিয়েছেন, রাজনীতি করার কারণে তাদের বাড়িতে পুলিশ প্রতি নিয়ত হামলা করছে এবং আমার আত্মীয়স্বজনকে গ্রেফতার করছে। তারা বলেন, দেশ ছেড়ে আসার পরও এই ফ্যাসিস্ট সরকারের রোষানল থেকে আমরা মুক্তি পাচ্ছি না, কারো কারো বৃদ্ধ বাবা-মাকেও হয়রানি করা হচ্ছে। তবে কেউ কেউ ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, এ সরকারের পতন এখন সময়ের ব্যাপার। আমরা ছাত্রদের আন্দোলনকে অবশ্যই সমর্থন দিয়ে যাবো।
অন্যদিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে দেশব্যাপী সংঘাত ও সহিংসতা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ জারিসহ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্বের নানা প্রান্তে বিক্ষোভ হয়েছে। কেন ও কারা সব বিক্ষোভ করেছেন, এসব জানতে বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোয় চিঠি পাঠিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা গত ২৫ জুলাই বৃহস্পতিবার এই প্রতিবেদককে জানান, বিশ্বের নানা প্রান্তে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনের কূটনীতিকেরা সেখানকার সরকারের কাছ থেকে বিক্ষোভের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করবেন। এরপর ওই তথ্য ঢাকায় পাঠাবেন।
মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি কয়েকটি পশ্চিমা দেশ, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) বাংলাদেশ মিশনের আশপাশে বিক্ষোভ হয়েছে।
এ ব্যাপারে সরকারের কাছে তথ্য আছে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন ২৫ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকালে বলেন, ‘কোথাও কোথাও বিক্ষোভ হয়েছে, এমন খবর আমরা জেনেছি। তাই বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোয় চিঠি পাঠিয়েছি। আমরা জানতে চেয়েছি কারা, কী বিষয়ে বিক্ষোভ করছে। এ নিয়ে মিশনগুলো যে দেশে কাজ করে, সেখানকার সরকারের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে আমাদের জানাবে।’
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘এতো দিন আমরা আমাদের মিশনগুলোর মাধ্যমে এখানকার পরিস্থিতি তাদের অবহিত করেছি, যাতে তারা তাদের দেশের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত গুজব ও অসত্য তথ্যে বিভ্রান্ত না হয়। এবার আমরা তাদের সহায়তা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছি।’ তিনি জানান, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশি বাংলাদেশ মিশনগুলোয় অন্তত ছয়টি চিঠি পাঠিয়েছে।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, দূতাবাসগুলোর সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার থেকে মূল যোগাযোগ বন্ধ ছিল (ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন থাকায়)। দিল্লির মাধ্যমে বা বিভিন্ন জায়গা হয়ে মিশনগুলোকে অবহিত করা হয়েছে। দেশের শেষ সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মিশনগুলোকে নিয়মিত হালনাগাদ তথ্য জানানো হচ্ছে। মিশনগুলোর প্রতি প্রধান নির্দেশনা হচ্ছে, প্রবাসীরা যাতে গুজব ও বিভ্রান্তির শিকার না হন। প্রায় প্রতিটি চিঠিতেই মিশনগুলোকে দায়িত্ব পালনরত দেশের সরকারের সঙ্গে যুক্ততার পাশাপাশি সেখানকার চিন্তক প্রতিষ্ঠান, গবেষক ও বিদেশি গণমাধ্যমের সম্পাদকদের সঙ্গে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মাধ্যমেও পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদন এসেছে। সেই প্রতিবেদনের পাল্টা হিসেবে আমাদের বক্তব্য যাতে তুলে ধরে, সেটি চিঠিতে বলা হয়েছে।’