৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ১০:০৯:৩৪ পূর্বাহ্ন


জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ, হার্ডলাইন না অন্যকিছু
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩১-০৭-২০২৪
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ, হার্ডলাইন না অন্যকিছু


বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধীতাকারী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সংগঠন জামায়াত ও শিবির নিষিদ্ধ হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের বৈঠকে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আইনমন্ত্রী ৩০ জুলাই মঙ্গলবার বলেছেন, ৩১ জুলাই বুধবারের মধ্যেই এ বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। কারণ বিষয়টা জুলাইয়ের মধ্যেই শেষ করতে চায়। টেনে নিতে চায় না আগস্টে। 

সিদ্ধান্তের কারণ?

২৯ জুলাই সোমবার বৈঠক শেষে গণভবনের ফটকে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এব্যাপারে বিস্তারিত তুলে ধরেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, তাদের বৈঠকে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। এ সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৪ দলীয় জোটের নেতারা মনে করেন, বিএনপি-জামায়াত, ছাত্রদল, শিবির ও তাদের দোসর উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দেশকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্র করছে। অতি সম্প্রতি চোরাগোপ্তা হামলা করে এবং গুলিবর্ষণ করে সরকারের ওপর দায় চাপাতে তারা দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আরো কিছু কারণ

স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধীতাকারী জামায়াত ও শিবিরকে এবারে নিষিদ্ধ করার মতো হার্ডলাইনে যাওয়া নিয়ে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, এর আগে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার দায়ভার অনেক ক্ষেত্রে বিএনপি’র না থাকলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনো না কোনোভাবে তাদেরকে (বিএনপি) দায়ী করতো। কিন্তু এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাখ-ঢাক না রেখে শুরতেই হার্ড লাইনে চলে গেছে। পরিষ্কারভাবে দায়ী করেছে তারা জামায়াত-শিবিরকে। এধরনের ঘটনার পেছনে স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধীতাকারী জামায়াত ও শিবিরের হাত বেশ সক্রিয়ই ছিল বলে মনে করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র এই প্রতিনিধিকে জানান, ১৯ জুলাই রাতে শেখ হাসিনার সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকের কথা। কোটা সংস্কার আন্দোলনে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশে কারফিউ জারি এবং সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ওই বৈঠকে। আওয়ামী লীগ নেতা জানান, সেই বৈঠকের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত পরিস্কারভাবে ১৪ দলের নেতাদের জানিয়ে দেন যে, কোটা সংস্কার আন্দোলনে উদ্ভূত পরিস্থিতির পেছনে শিবিরের হাত আছে। এবং তিনি এবার শিবিরকে কোনোভাবেই ছাড় দেবেন না, সেটা স্পষ্ট করে দেন। ১৯ জুলাই রাতে সেই বৈঠকে শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার আন্দোলনে বেশ কয়েকজন নিহত ও বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেয়ার রাজনৈতিক পরিচয়ও তুলে ধরেন। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে তো আমাদের ছেলেরা জড়িত ছিল। কিন্ত ওরা (শিবির) ঢুকলো কিভাবে? ওরা তো শিবির করে। এসব তথ্য দিয়ে ওই বৈঠকেই তিনি আভাস দেন যে, একাত্তরের পরাজিত এই শক্তিকে কঠোরভাবে দমন করবেন। আর ওই বৈঠকের ১০ দিনের মাথায় আবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের জোটের জরুরি বৈঠক ডাকেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর সেখানেই শিবির ও জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হয়।

কতটা কঠোর হবে সরকার?

কারো কারো মতে, অতীতে স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধীতাকারী জামায়াত ও শিবিরকে নিষিদ্ধ করার আওয়াজ তুলে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ময়দানে নানান ধরনের খেলা খেলেছে। তাই এবারের সিদ্ধান্তটি নিয়ে চলে নানান ধরনের কানা-ঘুষা। আর সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে সোমবার ১৪ দলের এই বৈঠকেই জানানো হয় যে, আগামী দু-এক দিনের মধ্যে দলটির নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে সরকার এবারে জামায়াত ও শিবির ইস্যুতে কতটা হার্ডলাইনে আছে। আর তা-রই আরো প্রতিফলন ঘটেছে মঙ্গলবারের আরেক ঘটনায়। মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান সরকারের নির্বাহী আদেশে বুধবার (৩১ জুলাই) মধ্যেই নিষিদ্ধ ঘোষণা হচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির।

হার্ডলাইন না অন্যকিছু

কারো কারো মতে, স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধীতাকারী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সংগঠন জামায়াত ও শিবির নিষিদ্ধ করার ঘটনাটিতে এই দলটির ওপর তেমন প্রভাব ফেলবে না। কারণ হলো স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট এক রায়ের মাধ্যমে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ বলে রায় দেন। এরপর ২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত আপিল করলেও ২০২৩ সালে ১৯ নভেম্বর তা সর্বোচ্চ আদালতে খারিজ হয়ে যায়। কিন্তু এরপরও দলটি বেশ কয়েকবার রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে মিছিল মিটিং করেছে। অভিযোগ আছে এর পেছনে ক্ষমতাসীন মহলের সমর্থন। এমনকি ২০২৩ সালে বিএনপি’র ডাকে পল্টনে মহাসমাবেশ আহ্বান করা হয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে একদফা আন্দোলনে। সেই ২৮ অক্টোবরে জামায়াতকে প্রকাশ্যে মাঠে নামতে দেয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠে। যদিও বিএনপি স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধীতাকারী সংগঠন জামায়াত ও শিবিরের সাথে গাটছড়া বাঁধেনি এক দফা ইস্যুতে।

কিন্তু সেই ২৮ অক্টোবরে পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপি’র সমাবেশ করার বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যতটা হার্ড লাইনে ছিল, ততটা জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে দেখা যায়নি। ফলে অতীতে জামায়াত ও শিবির নিষিদ্ধ করার কথা বলা হলেও এরা ভবিষ্যতে আবার কোন ধরনের প্লাটফরম ব্যবহার করে আওয়ামী কৌশুলী আনুকল্য পায় সেটি দেখার বিষয়। আপাতত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল জামায়াত ও শিবির নিষিদ্ধ করার মতো ঘটনাকে দলটির বিরুদ্ধে নেয়া পদক্ষেপকে রাজনৈতিক চমক হিসাবেই দেখছেন, হার্ডলাইন নয়।

কেননা স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধীতাকারী সংগঠন জামায়াত ও শিবিরকে সত্যিকারভাবে নিষিদ্ধ করা হলেও ভবিষ্যতে এদলটির সাথে সম্পৃক্ত থিংক ট্যাংকসহ আরো প্রভাবশলীরা কোনো না কোনো দলের আশ্রয়-প্রশ্রয় নেবেই। অতীতে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রশ্রয়ই বেশি পেয়েছে এরা। যদিও এব্যাপারে আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড বিশেষ করে খ্দো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই কঠোর আপত্তি ছিল। কিন্তু দলের সভাপতির ইচ্ছাকে খোদ আওয়ামী লীগই সম্মান দেয়নি। আর তাই সেক্ষেত্রে জামায়াত-শিবির ভবিষ্যতে আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিলে তা ঠেকাতে কি পদক্ষেপ নেয়া হবে সে বিবেচ্য বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়নি সোমবারে ১৪ দলের সেই বৈঠকে। বলা হয়নি যে, স্বাধীনতা বিরোধী দলটির নেতাকর্মীদের কোনো দলেই আর আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। আর তা পরিষ্কার না করা পর্যন্ত জামায়াত ও শিবির নিষিদ্ধ করার মতো ঘটনাকে দলটির বিরুদ্ধে নেয়া পদক্ষেপকে রাজনৈতিক চমক হিসাবেই দেখবেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা, হার্ডলাইন হিসাবে নয়। 

যদিও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী ও দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করার আইনি দিক দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এর পাশাপাশি তিনি আশ্বস্ত করে বলেছেন, জামায়াত নিষিদ্ধের জন্য আইনি বিষয়টি ভালভাবে দেখে সরকার পরবর্তী পদক্ষেপ শিগগিরই নেবে যাতে কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে এই অপশক্তি স্বাধীন বাংলাদেশে আর কোনো সুযোগ না পায়। কেননা ইতোমধ্যে গত সোমবার রাতে ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদও জানিয়েছে। মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়ে দলটি বলেছে, জামায়াত নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত বেআইনি। 

আর এক্ষেত্রে দলটি সংবিধানের দোহাই দিয়েছে। বলেছে এটা এখতিয়ার বহির্ভূত ও সংবিধান পরিপন্থী। তবে অন্যদিকে স্বাধীনতা বিরোধিতাকারী জামায়াত ও শিবিরকে নিষিদ্ধ করে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নির্মমভাবে নিহত-আহতদের ক্ষোভ বা বিক্ষুব্ধ অবস্থা কতটা নিরসন করা যাবে তা-ও দেখার বিষয়। কেননা কোটা সংস্কার আন্দোলনকে স্বাধীনতা বিরোধীতাকারী জামায়াত ও শিবিরের আন্দোলন বলে চালিয়ে দেয়ার রাজনৈতিক কৌশল কি-না সেটি দেখার বিষয়। তবে স্বাধীনতা বিরোধীতাকারী জামায়াত ও শিবিরকে নিষিদ্ধ করার ঘটনাটি যদিও সত্যিকারার্থে কার্যকর করে ফেলে, সেক্ষেত্রে শুধু আওয়ামী লীগই নয় পুরো দেশবাসী অবশ্যই বাড়তি রাজনৈতিক সুবিধা পাবে। আর তা হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধীতাকারী মৌলবাদি সাম্প্রদায়িক সংগঠন জামায়াত ও শিবির নিয়ে আর কেউ রাজনীতি করতে পরবে না-এমনটাই মনে করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

শেয়ার করুন