সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার তাঁর বক্তব্যে বলেছেন ‘গত ৬ আগস্ট আমাদের একটি অভূতপূর্ব, অভাবনীয় ও অকল্পনীয় বিজয় অর্জিত হয়েছে। অনেকের মতে এটা আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। এ প্রেক্ষিতে মানুষের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা স্বাভাবিক। কারণ বিগত ১৫ বছর আমরা অনেকটা কারাগারের মধ্যে ছিলাম। এ সময় আমরা আমাদের বাক স্বাধীনতা ও অন্যান্য নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম।
গত ৬ আগস্ট মঙ্গলবার সুজন কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সুজন-এর আহ্বান’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে ড. বদিউল আলম মজুমদার এসব কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে এবং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে আমরা এই বিজয় অর্জন করেছি। আমরা সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। আমাদের তরুণরা হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের যোগ্য উত্তরসুরি। যারা প্রাণ বিজর্সন দিয়েছে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি ও তাদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। তারা আমাদের জাতীয় বীর।
তিনি বলেন, এই বিজয়ের মাধ্যমে আমাদের সামনে একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, রাষ্ট্রকে নতুন করে মেরামতের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, উন্নত ও বাসযোগ্য রাষ্ট্র নির্মাণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমরা যদি দায়িত্মশীললতার পরিচয় দিতে না পারি, তাহলে এই সম্ভাবনা রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। আমরা লক্ষ করেছি, বিজয় উদ্যাপনের নামে গত ৫ আগস্ট এমন কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, যা কাঙ্ক্ষিত ছিল না। আমরা হামলা ও ভাঙচুরের নিন্দা জানাই। আমরা এসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমাদেরকে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে হবে, যাতে কর্তৃত্ববাদী শাসন ফিরে না আসে এবং একটি গণতান্ত্রিক ও সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়।’
সহিংসতা, লুটপাট বা ধ্বংসযজ্ঞ না করা, নিজের হাতে আইন তুলে না নেওয়া এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্তদের রক্ষা করা ও তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে নাগরিক সংগঠন সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক। একইসঙ্গে প্রাণহানিসহ রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তিগত সম্পদ ধ্বংসের যে কোনো উদ্যোগ রুখে দাঁড়ানো ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন সুজন নেতৃবৃন্দ।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সুজন নির্বাহী সদস্য ড. শাহদীন মালিক ও অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, সুজন ঢাকা মহানগর কমিটির সম্পাদক জুবাইরুল হক নাহিদ প্রমুখ। লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন সুজন-এর কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।
ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘যে কোনো ধরনের সহিংসতা ও ধ্বংসধজ্ঞ কারও কাম্য নয়।যে ধ্বংসধজ্ঞ হয়েছে তা আমি সমর্থন করি না। কিন্তু আমি মনে করি অন্য দেশের তুলনায় এখানে খুব বেশি কিছু হয়নি। আর এটা সম্ভব হয়েছে ছাত্রদের দায়িত্বশীল আচরণের কারণে। আজকে ছাত্ররা আজ রাস্তা পরিষ্কার করছে, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে। অনেকে লুট করা মাল ফেরত দিচ্ছে। তাই আমি আশাবাদী হতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন রকম দুর্বলতা ছিল। আমাদের রাজনৈতিক দলের মধ্যে দায়িত্বশীলতা নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকে হালুয়া-রুটির লোভে বিবেক বিসর্জন দিয়েছে, নাগরিক সমাজেরও অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল, সাংবাদিকদেরও অনেক লজ্জাজনক পক্ষপাতদুষ্টুতা ছিল। এসব কারণেই আমাদের ওপর কর্তৃত্ববাদী শাসন গেড়ে বসেছিল। তাই ভবিষ্যতে যাতে আমাদের দেশে আর স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ফিরে না আসে সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।’
নতুন সরকারের ব্যাপারে ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিশ্চয়ই সবার সঙ্গে আলোচনা করে রাষ্ট্র মেরামতের চেষ্টা করবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে এটা রকেট সায়েন্স নয়। কিছু সংস্কার স্বল্পমেয়াদে করা যাবে, কিছু সংস্কার করতে সময় লাগবে। কিন্তু আমাদেরকে আশাবাদী হতে হবে।’
অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘ক্ষমতার একটি বৈশিষ্ট্য হলো কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা। সেজন্য নজরদারিত্বের কাঠামো ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, ব্যক্তিগত শাসনের পরিবর্তে জবাবদিহিতা সৃষ্টি করতে হবে। ব্যক্তি হাসিনার শাসনের হয়তো অবসান হয়েছে, কিন্তু কর্তৃত্ববাদী শাসন যাতে আর ফিরে না আসে, সেজন্য সরকারকে প্রতিনিয়ত পাহারা দিতে হবে, নজরদারিত্বের আওতায় আনতে হবে।’
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়েছে। এজন্য
আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দসহ জনগণকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। সেনাবাহিনী প্রধান কয়েকটি রাজনৈতিক দল এবং কয়েকজন নাগরিকের সঙ্গে বসার পর জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তব্যে একটি অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের কথা বলেছেন। আমরা তার অপেক্ষায় রয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘সরকার পতনের পর সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। এঅবস্থায় সুজন-এর পক্ষ থেকে আমরা দেশবাসীর প্রতি কিছু আহ্বান জানিয়ে বলা হয় কারো বিজয় উদ্যাপনের ভাষা যেন সহিংসতা, লুটপাট বা ধ্বংসযজ্ঞ না হয়; কেউ যেন নিজের হাতে আইন তুলে না নেয়; ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্তদের রক্ষা করুন ও তাঁদের পাশে দাঁড়ান; প্রাণহানিসহ রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তিগত সম্পদ ধ্বংসের যে কোনো উদ্যোগ রুখে দাঁড়ান; মন্দিরসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষা করুন।’