৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৩:১৬:৫৩ অপরাহ্ন


হাসিনা সরকার পতন আন্দোলন পরিকল্পিত?
খন্দকার সালেক
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-১০-২০২৪
হাসিনা সরকার পতন আন্দোলন পরিকল্পিত? বক্তব্য রাখছেন সমন্বয়ক নাহিদ


ছাত্র-জনতার বৈপ্লবিক আন্দোলন আপাতদৃষ্টিতে কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পটভূমি তৈরি করলেও এর নেপথ্যে একটি বিশেষ শক্তির দীর্ঘদিনের সাজানো পরিকল্পনা ছিল বলেই মনে হচ্ছে। যতদিন যাচ্ছে সেই পরিকল্পনার স্বরূপ উন্মুক্ত হচ্ছে। আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের প্রতিবাদ কর্মসূচি দিয়ে। একপর্যায়ে সরকার আদালতের মাধ্যমে সেই দাবি পরিপূর্ণভাবে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে ভুল পরামর্শে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন (এখন দেখা যাচ্ছে বৈরী সংগঠন থেকে অনুপ্রবেশকারী) এবং দেখা যাচ্ছে, পুলিশি পোশাকে ভিনদেশি নাগরিক ছাত্র-জনতাকে নির্মমভাবে হত্যা করায় আন্দোলন আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে পরিণত হয়। 

অনেকের ধারণা সরকারবিরোধী একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠায় আন্দোলন দাবানলে রূপান্তরিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শুরুতে সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকলেও একপর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ এবং হলগুলো খালি করে দেওয়ায় আন্দোলনে সাময়িক ভাটা পড়ে। এ পর্যায়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ, সমগ্র স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীসহ অভিভাবক-ছাত্র-জনতা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শেষ পর্যায়ে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হলেও পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে। ব্যাপক হানাহানি, নির্মম হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিকাণ্ড, সরকারি সম্পদ ধ্বংস হয়। ছাত্র-জনতা ঢাকা ঘেরাও ঘোষণা দেওয়ায় ৫ আগস্ট তৎকালীন সরকারের পতন ঘটে। সরকারপ্রধান প্রতিবেশী দেশ ভারতে পলায়ন করলে সেনাবাহিনীর সহায়তায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। দেশে কনস্টিটিউশন বহাল আছে। অথচ সেই কনস্টিটিউশন অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি ছাড়া কেউ বৈধ নয় বলে অনেকের ধারণা। সাধারণত বিপ্লব বা আন্দোলনে কোনো সরকারের পতন ঘটলে কনস্টিটিউশন স্থগিত করে জরুরি ব্যবস্থা অথবা সামরিক শাসন জারি করা হয়। বাংলাদেশেও এর নজির আছে। এবার কিন্তু সেটি হয়নি। এমতাবস্থায় বর্তমান সরকারের সব কার্যক্রম পরবর্তী সময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার জাতীয় সংসদে বৈধতা দেবে এ মর্মে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য প্রয়োজন। তবে সরকার পতনের নেপথ্যে কোন রাজনৈতিক দলের মুখ্য ভূমিকা ছিল সেটি সরকার পদত্যাগ বিষয়ে সেনাপ্রধানের ঘোষণা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধানের নানা বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে।

পূর্ববর্তী তথা পতিত সরকারের কুশাসন, দুর্নীতি, অবাধ সম্পদ লোপাট, বিদেশে পাচার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, আপামর জনসাধারণ সরকার পতনকে স্বাগত জানায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ শুরু করে বিধ্বস্ত অর্থনীতি, ভেঙেপড়া ব্যাংকিং ব্যবস্থা, বিপর্যস্ত ব্যবসা-বাণ্যিজ্য, জ্বালানি-বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে। একটি সরকার এবং সরকার সমর্থক বেসামরিক প্রশাসনের অনেক সদস্য বিদেশে পলায়ন অথবা দেশে গা ঢাকা দেওয়ায় সরকার পরিচালনায় ব্যাপক সংকট দেখা দেয়। সরকার ইতিমধ্যে বেশকিছু সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করায় অর্থনীতিতে শুভ পরিবর্তনের অভ্যাস পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, জ্বালানি, বিদ্যুৎ প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে পরিবর্তন করা সম্ভব না হওয়ায় এখনো সরকার পরিচালনায় নানা চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

পুলিশ প্রশাসন আগের অবস্থায় ফিরে আসেনি, স্থানীয় প্রশাসন, বেসামরিক প্রশাসনে এখনো স্থবিরতা বিরাজ করায় জনমনে এখনো ভয়, আতঙ্ক পুরোপুরি দূর হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা নিঃসন্দেহে স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিজ্ঞজন হলেও বাংলাদেশের মতো জটিল দেশে রাষ্ট্র পরিচালনায় অভ্যস্ত না হওয়ায় নানা ক্ষেত্রেই জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক সংস্কার পরিকল্পনা গৃহীত হয়নি।

দুটি প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার করা জরুরি হলেও এখনো শুরু করা হয়নি। শিল্পকারখানাগুলোর ক্ষেত্রে নানা প্রচেষ্টায় শৃঙ্খলা ফিরে এলেও জ্বালানি-বিদ্যুৎ সংকট অব্যাহত আছে. জ্বালানি ক্ষেত্রে কিছু সংস্থায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলছে। বিভিন্ন পর্যায়ে দ্রুত পরিবর্তন এনে সংস্কার করা না হলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে।

ইতিমধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচনের পথনকশা ঘোষণার তাগিদ দিয়েছে। যতদিন যাবে এই দাবি গতি পাবে। কিছু মানুষ কনস্টিটিউশন সংশোধন এবং পরিত্যক্ত করে নতুন করে লেখার তাগিদ দিলেও বিষয়টি রাজনৈতিক বিষয় সম্পৃক্ত বিধায় এতো সহজ কাজ নয় সবাই বুঝতে পারছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পরিবর্তনসমূহ এখন পর্যন্ত কার্যকর পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হওয়ায় সেনাবাহিনীকে অগত্যা ম্যাজিস্ট্রেসি দেওয়া হয়েছে। 

সেনাবাহিনী জরুরি অবস্থা ঘোষণার পক্ষে নয়। কারণটাও বোধগম্য। সেনাপ্রধান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস প্রদান করে দেড় বছরের সময়সীমায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইঙ্গিত দিয়েছে। ইতিমধ্যে নানাভাবে সরকারের নেপথ্যে থাকা সহায়ক শক্তির রাজনৈতিক পরিচয় মিলছে। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় রেখে যত শিগগিরই দেশকে নির্বাচনমুখী করা যায়, ততই মঙ্গল। অনেক কাজ অনির্বাচিত সরকার করতে পারবে না। আর প্রতিক্রিয়াশীল দেশবিরোধী চক্র নানা অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড চালাতেই থাকবে। পূর্ববর্তী সরকারের সুবিধাভোগীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাতারাতি অবস্থান পরিবর্তন করে সরকারের বেশকিছু পরিবর্তন বুমেরাং হয়েছে। সে যাই হোক ছাত্র-জনতার মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছে সেটি কাজে লাগাতেই হবে। তবে প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হলে হতাশা বাড়বে।

সরকার ডিসেম্বর ২০২৪ নাগাদ নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে ২০২৫ শুরু থেকেই অতি প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ বাস্তবায়ন শুরু করতে পারবেন। এরই মধ্যে হত্যাকা-ের বিচার, শীর্ষস্থানীয় দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনা, বাজার ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা সৃষ্টি এবং জ্বালানি-বিদ্যুৎ সংকট উত্তোলন বিষয়ে সমস্যাগুলো জটিল হতে শুরু করেছে।

সরকারসংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সম্পৃক্ত করে যেগুলো সংস্কার অপরিহার্য সেগুলো প্রাধিকার ভিত্তিতে সম্পাদন করে দ্রুত দেশকে নির্বাচনমুখী করবে।

অনেকের ধারণা হাসিনা সরকারের পতনের বিষয়টি কাকতলীয় ছিল না। একটি মহল নেপথ্যে থেকে সুপরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সরকার পতন সুনিশ্চিত করেছে।

শেয়ার করুন