১২ জানুয়ারী ২০২৫, শুক্রবার, ০১:৩০:৪৯ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
মির্জা ফখরুলের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটা এক-এগারো সরকার গঠনের ইঙ্গিত নজিরবিহীনভাবে পরিবারের সদস্যসহ কর্মকর্তাদের ক্ষমা করে গেলেন বাইডেন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে কঠোর চাপ পশ্চিমাদের বিএনপির ভাবমূর্তি নষ্টে অপপ্রচার খালেদা জিয়ার লিভার প্রতিস্থাপন সম্ভব হচ্ছে না ন্যূনতম সংস্কার করে নির্বাচন দাবি বিএনপির চীনে গুরুত্বপূর্ণ সফরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ জার্মান চ্যান্সেলর ও প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক : গণতান্ত্রিক উত্তরণে সহায়তার আশ্বাস জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল : অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিসে’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে লন্ডন ক্লিনিকের চিকিৎসকরা


ভ্রমণ কাহিনি
বাংলাদেশকে নতুন করে চেনা
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৩-১০-২০২৪
বাংলাদেশকে নতুন করে চেনা চিত্রকর্ম দেখছেন প্রধান উপদেষ্টা


জুলাই-আগস্ট ২০২৪ বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দাফতরিক কাজ এবং পারিবারিক প্রয়োজনে বাংলাদেশ সফর করেছি ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত। প্রধান কাজ ছিল একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের জন্য পরামর্শক হিসেবে বাংলাদেশের জ্বালানিব্যবস্থা কার্বনমুক্ত করার পথনকশা বিষয়ে ওয়ার্কশপে যোগদান। বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জ্বালানি ব্যবস্থাপনাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি এলোমেলো হয়ে পড়ায় সংগত কারণে ওয়ার্কশপ স্থগিত হয়ে যায়।

আমি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপান্তর এবং পর্যায়ক্রমে সরকার পরিবর্তনের আন্দোলনের ঘটনাক্রম প্রবাস থেকেই মিডিয়ায় নিয়মিত দেখেছি, পড়েছি। বিশেষত তরুণ-যুবকদের নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং বিশেষ শ্রেণির দুর্বৃত্তকারীদের ধ্বংসযজ্ঞ বিষয়ে মর্মাহত হয়েছি। ইতিহাসের পটপরিবর্তনের বিষয়গুলো নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত নানা ঘরানার প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হয়ে নিজে জানতে চেষ্টা করেছি। আমার পরিবারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সফরে সমর্থন ছিল না। দেশে থাকা ছোট ভাই, আত্মীয়স্বজন অনুরোধ করেছিল বাংলাদেশে না যেতে। আমি একজন জ্বালানি পরামর্শক। বাংলাদেশে অবস্থানকালে জিয়াউর রহমান সরকার, এরশাদ সরকার, খালেদা জিয়া সরকার, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে জ্বালানি সেক্টরের মাঠে-ময়দানে দেশের হয়ে কাজ করেছি। কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর কোনো বিশেষ সুবিধা গ্রহণ করিনি। তবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি নিবেদিত থেকে চেষ্টা করেছি গ্যাস সেক্টরকে একটি শক্ত অবকাঠামোর ওপর দাঁড় করতে। বিশ্বাস ছিল এবং আছে জ্বালানি-বিদ্যুৎ সেক্টরের আমার অনুজরা আমাকে সাদরে গ্রহণ করবে। আসলে হয়েছেও তাই।

চায়না সাউদার্ন বিমানযোগে গুয়াংজু হয়ে ১৩ অক্টোবর মধ্যরাতে ঢাকা পৌঁছি। সুপরিসর এবং সুসজ্জিত বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতিতে বাংলাদেশের ২৫ জন টেবিল টেনিস খেলোয়াড় দলের সঙ্গে আলাপ করে সময় কাটে। ওরা দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষণে চীনে এসেছিল। তরুণ-যুবক, তরুণীদের চোখমুখে আমি বিজয়ের দ্যুতি দেখতে পাই। রাতে উত্তরায় আমার বড় ভাইয়ের ছেলে সোহান তারাক্কীর রূপায়ণ সিটি অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছলে নাতি ও নাতনি তাহেরা উল্লসিত হয়ে আমাকে বরণ করে। আধুনিক রূপায়ণ সিটি কমপ্লেক্সে এবারের যাত্রায় সময় কেটেছে নাতি-নাতনির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে।

জেট লাগ থাকায় রাতের ঘুম শেষে পরদিন সকালে উঠে টেলিফোন পেলাম একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার গাড়ি নিচে অপেক্ষা করছে। সকাল সকাল আশায় কিছু বিলম্বে প্রস্তুত হয়ে স্টুডিওতে পৌঁছার পর ৫০ মিনিটের একটি অনুষ্ঠান ধারণ করা হলো নতুন বাংলাদেশে জ্বালানি-বিদ্যুৎখাত সংস্কার নিয়ে। দুইজন রিপোর্টার দুটি পৃথক বিষয়ে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার নিলো। পরিশ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরলাম। শনিবার ছুটির দিন, ঢাকার পথঘাট যানজটমুক্ত ছিল। সন্ধ্যায় আরেকটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার রিপোর্টার এসে রূপায়ণ সিটি কমপ্লেক্সে ক্রিকেট এবং জ্বালানি বিষয়ে সাক্ষাৎকার রেকর্ড করলো। পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমানোর আগে গ্যাস সেক্টর, বিদ্যুৎ সেক্টর থেকে অনেক ফোন পেলাম। ভারত সফররত বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অসহায় অবস্থা নিয়েও কয়েক জন জানতে চাইলো।

উত্তরার প্রান্তিক এলাকায় রূপায়ণ সিটি কমপ্লেক্স একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ এলাকা হিসেবে গড়ে উঠছে। এখনো পূর্ণাঙ্গ রূপ না নেওয়ায় ভাতিজা ছেলেমেয়েদের স্কুল এবং নিজের কর্মস্থলে যাতায়াত নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কাছাকাছি গ্যাস সেক্টরের অনেক সহকর্মী থাকায় আমার যাতায়াতে কোনো সমস্যা ছিল না। আমি যাদের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করি, তারাও গাড়ি পাঠায় আমার ব্যবহারের জন্য। কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতার জন্য আমি এবারের সফরের সময় অনেকবার মেট্রো ব্যবহার করেছি। উত্তরা উত্তর থেকে কাওরান বাজার স্টেশনে নেমে তিতাস গ্যাস, পেট্রোবাংলা এবং বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে কাজের সুযোগ ছিল। আবার সচিবালয় স্টেশনে পৌঁছে সচিবালয়, প্রেস ক্লাবেও অনেক কাজ সেরেছি।

সফরের দ্বিতীয় দিনে বারকে যাবো নিযুক্ত পূর্বপরিচিত এবং জ্বালানি সেক্টরের প্রাক্তন সহকর্মী জালাল আহমেদকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তার সঙ্গে দেখা করি। নিজের দেশ, বিদেশে লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে জ্বালানি সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট নিয়ে একটি আলোচনা সভায় কিনোট পেপার উপস্থাপনের সম্মতি প্রদান করি।

ইতিমধ্যে জানতে পারি, আমার চাকরি জীবনের প্রথম কোম্পানি দেশের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম গ্যাস কোম্পানি তিতাস গ্যাসের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ নিয়ে পেট্রোবাংলা এবং তিতাস গ্যাসের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পেট্রোবাংলা সদর দফতরে সংঘর্ষ এবং ভাঙচুর হয়েছে। শুনলাম, সিস্টেম লস নিয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্তের জেরে আমার বাংলাদেশে কাজ করা সর্বশেষ কোম্পানি জিটিসিএলে আন্দোলন চলছে। আমার অতি প্রিয় গ্যাস সেক্টর সহকর্মীদের সংকটে আমি পিছিয়ে থাকিনি।

জিটিসিএল থেকে তিতাস গ্যাস কোম্পানিতে যোগদানকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক একজন চৌকষ কর্মকর্তা। আমার পরিচিত এবং প্রিয় সহকর্মীদের অন্যতম। তবে কোম্পানিতে তার থেকে সিনিয়র কয়েকজন কর্মকর্তা থাকায় সহজ কারণে সেখানে কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। আমি তিতাস গ্যাস ব্যবস্থাপনা কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করি। আমার কাছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তাদের ধারণায় পেট্রোবাংলার বৈষম্যমূলক আচরণের কথা বলে। আমার নিজের কাছেও তিতাস গ্যাসের পরিচালকম-লীর সভায় অনুমোদিত অরগানোগ্রাম দীর্ঘদিন পেট্রোবাংলায় আটকে থাকা, পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কর্তৃক তিতাস গ্যাস কর্মীদের ঢালাওভাবে ‘চোর’ বলা অযাচিত মনে হয়েছে।

আমি তিতাস গ্যাস কার্যালয় থেকে জিটিসিএল পৌঁছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানববন্ধনের মুখে পড়ি। সেখানে ওদের মতে, সরকারি সিদ্ধান্তের পরিপন্থী জিটিসিএলের ওপর পেট্রোবাংলা থেকে অযাচিতভাবে ৩ শতাংশ সিস্টেম লস চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই। আমি জানাই, স্বাভাবিকভাবে সঞ্চালন ব্যবস্থায় কোনো অকারিগরি সিস্টেম লস থাকার কারণ নেই। তবে আন্তর্জাতিকভাবে ১-১.৫ শতাংশ কারিগরি লস স্বীকৃত জাতির দায়বদ্ধতা ট্রান্সমিশন কোম্পানির ওপর বর্তায় না। জিটিসিএল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের বোর্ড অনুমোদিত অরগানোগ্রাম পেট্রোবাংলায় আটকে থাকা এবং জ্বালানি সেক্টরে বেতন বৈষম্য নিয়ে ঊর্ধ্বতন মহলে কথা বলতে আমাকে অনুরোধ করে।

আমি পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের (আমার পূর্বপরিচিত) দফতরে ওনার সঙ্গে মিলিত হয়ে তিতাস গ্যাস এবং জিটিসিএল নিয়ে ওনার ঢালাও মন্তব্যে হতাশা প্রকাশ করি। দ্রুত দুই কোম্পানির অরগানোগ্রাম অনুরোধ করে বিতর্কের অবসান ঘটাতে অনুরোধ করি। সিস্টেম লস বিষয়টি কারিগরিভাবে সমাধানের সুপারিশ করি। উল্লেখ্য, আমি তিতাস গ্যাস, জিটিসিএল থেকে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে গ্যাস সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন কার্যালয়ে একটি উপস্থাপনা করার যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করলেও অনুমেয় কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। সিস্টেম লস নিয়ে পেট্রোবাংলা এবং কোম্পানিগুলোর বিতর্ক এবং মতবিরোধের সমাধান হয়নি। কারিগরি বিষয়ের কারিগরি সমাধান আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হওয়া সংগত। (চলবে)

শেয়ার করুন