(পর্ব ৩)
মধ্য সেপ্টেম্বর-মধ্য অক্টোবর ২০২৪ বাংলাদেশে সংক্ষিপ্ত সফরকালে যতটা পেরেছি তৃণমূলে জ্বালানি অনুসন্ধান, উন্নয়ন, সরবরাহ এবং বিতরণ ব্যবস্থা, ভবিষৎ পরিকল্পনা জানতে চেষ্টা করেছি, মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলা, গ্যাস কোম্পানিগুলোর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, প্রকল্প ব্যবস্থাপনাসহ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। গ্যাসফিল্ড, পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প এবং কিছু স্থাপনা পরিদর্শন করেছি। বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি জানা থাকায় দীর্ঘদিন থেকেই পরামর্শ দিয়েছি নিজেদের জ্বালানিসম্পদ উন্নয়ন ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করার। ভুল কৌশলে সেই পথে না হেঁটে জ্বালানি আমদানির দিকে ছুটে সংকটে পড়েছে দেশ। ৪০০০-৪২০০ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ৩০০০-৩১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ১০০০-১২০০ মিলিয়ন ঘনফুট ঘাটতি থাকায় বিদ্যুৎ, সার উৎপাদন বিঘ্নিত, শিল্পকারখানাগুলো আছে মারাত্মক সংকটে।
দেখলাম, পেট্রোবাংলা-বাপেক্স বিলম্বে হলেও নতুন গ্যাসকূপ খনন, কিছু কূপ উন্নয়নের উচ্চাভিলাষী প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৫ শেষ নাগাদ ৫০টি কূপ খননের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৫টি কূপ খনন কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৩৫ কূপ ২০২৫ শেষ হবে কি না শঙ্কা আছে। বাপেক্সের পাঁচটি খনন রিগ বর্তমানে চালু আছে। আলোচনাক্রমে জানতে পারি, সরকার থেকে প্রতিটি প্রকল্পের জন্য পৃথকভাবে ডিপিপি অনুমোদন করতে হয় একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ায়। আর একটি চ্যালেঞ্জ হলো, দ্রুত ভূমি অধিগ্রহণ। আমি প্রকল্প পরিকল্পনায় বা পেট্রোবাংলা-বাপেক্সের আন্তরিকতায় ঘাটতি দেখিনি। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতির কারণে প্রকল্পটির বাকি কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হবে বলে শঙ্কা আছে।
পেট্রোবাংলা-বাপেক্স আরো একটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প নিয়েছে জানুয়ারি ২০২৫- ডিসেম্বর ২০২৯ সময়ে ১০০ নতুন কূপ খননের। বাংলাদেশের বাস্তবতায় নিঃসন্দেহে অনেক অনেক চ্যালেঞ্জিং কাজ। তবে উদ্যোগকে শুভেচ্ছা জানাবো। ২ডি-৩ডি সাইসমিক সার্ভের ভিত্তিকে প্রাপ্ত ৪১০ লিড এবং প্রস্পেক্টরের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত এ প্রকল্পে ৬১ নতুন কূপ এবং ৩১ ওয়ার্ক ওভার করা হবে। এর মধ্যে বাপেক্স ৫২, বিজিএফসিএল ৯, সিলেট গ্যাসফিল্ডস লিমিটেড ৮টি নতুন কূপ খনন প্রস্তাব করেছে। ১৫টি পৃথক প্রকল্পের আওতায় কাজগুলো সম্পাদিত হবে। ৩৩ কূপ বাপেক্স নিজে খনন করবে, জনবলসহ রিগ ভাড়া করে সম্পাদন করা হবে ১০টি কূপ, ২৬টি কূপ খননের জন্য টেন্ডার করা হবে। ৩১টি ওয়ার্ক ওভার কূপের মধ্যে বাপেক্সের ১৬, বিজিএফসিএল ১২ এবং সিলেট গ্যাসফিল্ডের তিনটি। এখানেও মূল চ্যালেঞ্জ ডিপিপি অনুমোদন প্রক্রিয়া, ভূমি অধিগ্রহণ, উপকরণ এবং মালামাল ক্রয় এবং সরবরাহ। পেট্রোবাংলা একটি বিশেষ ব্যবস্থায় ভূমি অধিগ্রহণ এবং মালামাল সংগ্রহ কাজ ত্বরান্বিত করার জন্য টেন্ডারের মাধ্যমে বিশেষায়িত সংস্থা নিয়োগের পরিকল্পনা করেছে। এর পাশাপাশি সরকার কাজগুলোকে অগ্রাধিকারভিত্তিক জাতীয় প্রকল্প ঘোষণা করে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিলে হয়তো প্রকল্পের অধিকাংশ কাজ নির্দিষ্ট সময়সীমায় শেষ হতেও পারে। তবে পেট্রোবাংলা-বাপেক্স ব্যবস্থাপনা অনেক দক্ষ এবং গতিশীল হতে হবে।
এ সময়ে প্রতিবেদক জিটিসিএল কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন যমুনা রেলসেতু বরাবরে বিদেশি ঠিকাদার কর্তৃক নির্মাণাধীন আধুনিক প্রযুক্তির গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন পরিদর্শন করি। স্মরণে আছে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সড়ক সেতু বরাবরে গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ এবং চালু হওয়ার সময় জিটিসিএলে কর্মরত ছিলাম। পাইপ লাইন অংশটি নির্মাণ শেষে হাইড্রো টেস্টিংয়ের সময় দুর্ঘটনা ঘটে পাইপলাইন সাপোর্ট থেকে পড়ে গিয়েছিল। এবার নির্মাণকাজে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দেখলাম। জিটিসিএল অনুজ প্রকল্প ব্যবস্থাপক দক্ষতার সঙ্গে প্রকল্প পরিচালনা করছে। প্রকল্পটি শেষ হলে যমুনার পশ্চিমপাড়ে গ্যাস সঞ্চালন ব্যবস্থা আরো নির্ভরযোগ্য হবে। উল্লেখযোগ্য যে, সঞ্চালন ব্যবস্থা এখন রাজশাহী, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, অপরদিকে বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর পর্যন্ত বিস্তৃত।
এদিন পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস বিতরণ কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের ফ্রাঞ্চাইজ অঞ্চলে গ্যাস ব্যবহারের বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে অবহিত হই। যমুনা নদীর পশ্চিমপাড়ে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির কয়েকটি বড় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট পরিদর্শন করে দেখতে পাই গ্যাস সংকটে কেন্দ্রগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। গ্যাস সংকটে এলেঙ্গায় নির্মিত জিটিসিএলের কম্প্রেসার স্টেশনটি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়নি।
প্রতিবেদক আশুলিয়া, গাজীপুর, সাভার এলাকার গ্যাস সরবরাহ সংকট উপলব্ধি করার জন্য আশুলিয়ায় জিটিসিএলের সিটিগেট স্টেশন পরিদর্শন করি, স্টেশনের তথ্য-উপাত্ত দেখে বুঝতে পারি বিদ্যমান অবস্থায় গ্যাস উৎপাদন এবং সরবরাহ বৃদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত এ অঞ্চলে গ্যাস সংকট উত্তরণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ইতিপূর্বে ধানুয়া সিজিএস পরিদর্শনেও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে।
সব মিলিয়ে বলতে হয় দ্রুত অনুসদ্ধান, উন্নয়ন এবং ঘাটতি মিটানোর জন্য এলএনজি আমদানি প্রক্রিয়া বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ত্বরান্বিত না হলে জ্বালানি সেক্টর গভীর সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা এবং যোগ্য পেশাদারদের দায়িত্ব দিয়ে পরিকল্পিত বাস্তবায়ন। (চলবে)