৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:৪১:৪০ পূর্বাহ্ন


তৃণমূল বিভ্রান্ত
আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনই কি বিএনপির মূল উদ্দেশ্য
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-১১-২০২৪
আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনই কি বিএনপির মূল উদ্দেশ্য বক্তব্য রাখছেন রুহুল কবীর রিজভী


বিএনপি কী আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছে নাকি বিএনপির কতিপয় নেতা আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে- এ প্রশ্ন এখন বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। ক্রমশ বিএনপির কেন্ত্রীয় কতিপয় নেতাকর্মীর বক্তব্যে বিভ্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ নেতাকর্মী। তারা ভাবতে পারছেন না রাজনৈতিকভাবে তাদের কী ভূমিকা হওয়া উচিৎ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ক্ষমতা ত্যাগ করে ভারতের পালায়নের পর বিএনপি এটাকে তাদের দীর্ঘ ১৬ বছরের আন্দোলনের সুফল মনে করছেন। যা এসেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দের সহস্রাধিক ছাত্র জনতার জান প্রাণ ও রক্তের স্রোতের উপর দিয়ে। 

বিএনপি এভাবে পারেনি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে প্রতিরোধ করতে। একে একে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি ও লিফলেট বিতরণের মত কর্মসূচির উপর ভর করেছিল। এরবেশি শেখ হাসিনা ও তার আইনশৃংখলাবাহিনী সহ্য করেনি। সে অবস্থার মধ্যেই ২৪ এ ৭ জানুয়ারি একতরফা ও আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থী বানিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে আবারও পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় বসেছে। বিএনপি ছিল নীরব দর্শক। 

ছাত্র-জনতা তাদের প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে তার সুফল বিএনপি নিজেদের মনে করলেও সেটার কতটা তাদের প্রাপ্য সেটা দেশের মানুষ স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস না পেরুতে যে ভূমিকা এখন বিএনপির কতিপয় শীর্ষ নেতৃত্বের, এতে ব্যাপক কনফিউজ এখন তৃণমূল। কী করবেন তারা? এ নিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরে তোলপাড়। একরকম ভীতিকর অবস্থাও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে। বিগত সময়ে বিএনপির সকল অফিস তছনছ করে সেখানে খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, জিয়াউর রহমানে ছবি ভেঙে চুরমার করেছে। ফেলে পাড়িয়েছে। পুড়িয়েও দিয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। বিএনপির অফিস বলতে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে কোথাও ছিল সে সংখ্যা নগণ্য। এখন সে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিএনপি ক্ষোভ ঝাড়তে যেয়ে আওয়ামী লীগ অফিস ভাঙ্গচুর করেছে। শেখ হাসিনা, শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ভাঙচুর করেছেন। এটা এখন রীতিতে পরিণত বাংলাদেশে। যে দল ক্ষমতাচ্যুত হবে তাদের অফিস চুরমার হবে। বীরদের ছবিকে অসম্মান করা হয়। 

কিন্তু বঙ্গবভনে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরিয়ে ফেলার ইস্যু নিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী যেভাবে উপদেষ্টা মাহফুজুর রহমানের বিষাদাগার করছেন তাতে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ভয়ে। আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে বা মামলা করে তাহলে কী আওয়ামী লীগ অফিস ভাঙচুর করা নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দলীয় শাস্তি দেবেন কি না। এমনকি বিএনপির অফিসে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি লটকানোর মত নির্দেশনাও দেয়া হবে কিনা এ নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছেন তারা।

তৃণমূলের নেতাদের কয়েকজন নাম না প্রকাশ শর্তে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টাঙ্গানো যদি সংবিধানের বিধিবদ্ধ। তাহলে বিএনপির অফিসেও তো শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টানাতে হবে। কিন্তু সেটা কী সম্ভব হবে। তারা আশা করেন- এ ব্যাপারে একটা নীতিমালা ঘোষণা দেয়া উচিৎ বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। কারল সংবিধান আইন সবার জন্যই সমান। বঙ্গবভনে এক রীতি, আর দেশের অন্য সব স্থানে অন্যরীতি এটা তো হয় না। 

শেখ মুজিবের ছবি প্রসঙ্গে কথা বলতে যেয়েও রিজভী অসম্পূর্ণ কথা বলেছেন। কারণ শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সংবিধানে লেখা রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

রিজভী নিজেই সংবিধানসিদ্ধভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারণ না করে সংবিধানবহির্ভূত কাজ করেছেন বলেও বিএনপিকে বলতে শোনা যায়। এ ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তোলপাড়। আওয়ামী লীগ সমার্থিতরা বলেছেন, রিজভীর উচিৎ ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলে তাকে সম্মান দেয়া। সেটা না করে রিজভী শুধু শেখ মুজিবুর রহমান বলে তাকে কার্যত অসম্মান করেছেন। 

শুধু রিজভীই নন, জুলাই আগষ্টের ছাত্র জনতার নেতৃত্বদানকারী নেতা কর্মীদের অসম্মান করে বক্তব্য দেন ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। একই সঙ্গে কঠোর সমালোচনা করেন তিনি ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করণের। সেটা নিয়েও দলে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হওয়ার পর ইদানিং নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন বিএনপির এ নেত্রী। 

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে বিএনপি কঠোর অবস্থান সে শুরু থেকেই। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অনেক নেতাই প্রকাশ্যে এ নিষিদ্ধকরণের অলোচনাকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এমন সাপোর্ট বা আওয়ামী প্রীতিকে সাধুবাদ জানিয়ে প্রকাশ্যেও বক্তব্য দিয়েছেন দলের জয়েন সেক্রেটারী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি ভবিষ্যতে বিএনপির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গণতন্ত্র উত্তরণেরও বাসনা রেখেছেণ। 

যদিও গণতন্ত্র হত্যাকারীদের মুখে বিএনপির প্রশংসা এবং এক যোগে গণতন্ত্র উত্তরণের যে ইচ্ছাপ্রকাশ সেটা বিএনপিকে কতটা সন্তুষ্ট করছে সে ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা মেলেনি। যদিও তোপের মুখে মির্জা ফখরুল পাল্টা বক্তব্য দিয়েছেন। 

শীর্ষ নেতৃত্বের এমন আওয়ামী প্রীতি তৃণমূলেও কিছু কিছু স্থানে ছোয়া লেগেছে। অর্থের বিনিময়ে মামলা থেকে নাম কেটে দেয়ার প্রস্তাব, পুলিশের হাত থেকে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতাকে ছাড়িয়ে নেয়ার মত উদারতা পত্রিকার পাতায় খবর মিলছে। 

অথচ বিএনপির সামনে সবচে বড় ইস্যু লাখ লাখ নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহারে উদ্যোগ গ্রহণ। খোদ তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্যকরণ ও তাকে দেশে ফেরার পথ সুগোম করণ। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সকল মামলা প্রত্যাহার করার মত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। রিজভী তার বক্তব্য ভুল তুলে ধরে দুঃখ প্রকাশ করার এক স্থানে বলেছেন, “শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনে শেখ মুজিবের ছবি রাখার বাধ্যতামূলক আইন করা হয়েছে। ফ্যাসিবাদী আইনের কোন কার্যকারিতা থাকতে পারে না।” যদি এ বক্তব্য সঠিক হয় তাহলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা সকল মামলাও তো ফ্যাসিবাদ হাসিনা কর্তৃক। তাহলে সেগুলো প্রত্যাহারে অন্তর্বর্তীকে তটস্থ বা বাধ্য করা হচ্ছেনা অজ্ঞাত কারণে। 

কী বলেছিলেন রিজভী 

‘ইতিহাসে যার যতটুকু অবদান সেটা স্বীকার করতে হবে।’ মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে এ মন্তব্য করেন তিনি।

অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও মন্ত্রণালয়ের সচিব কারো গণতন্ত্রণের জন্য কোনো অবদান নেই মন্তব্য করে রিজভী বলেন, আজকে অহংকার করেন। আপনারা কেউ তো শেখ হাসিনার দুঃশাসন ঠেকাতে কিংবা মোকাবিলা করতে পারেননি। আমরা শেখ হাসিনাকে মোকাবিলা করেছি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাক বঙ্গভবন থেকে শেখ মুজিবুরের ছবি নামিয়েছিল উল্লেখ করে রিজভী বলেন, ৭ নভেম্বর সিপাহি বিপ্লবের পর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর আবার বঙ্গভবনে শেখ মুজিবের ছবি পূরণ করেন। আজকে যারা অন্তর্বর্তী সরকারে আছেন, আমি একটা সংবাদ দেখেছি, সেটা ধরেই বলছি- অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ ... শেখ মুজিবের ছবি নামিয়েছেন। এতোদিন বলেছেন ঠিক আছে। কিন্তু সবকিছু তো একরকম হয় না। আমি মনে করি তার (শেখ মুজিবুর রহমান) ছবি নামিয়ে ফেলাটা ঠিক হয়নি।

আমরা আওয়ামী লীগের মতো সংকীর্ণ নই, উল্লেখ করে রিজভী বলেন, এজন্যই বলছি, শেখ মুজিবের ছবি নামিয়ে ফেলা ঠিক হয়নি। তিনি বলেন, খন্দকার মোশতাক ছবি নামিয়েছে, জিয়াউর রহমান তুলেছেন। ইতিহাস বিচার করবে। সেই বিচারের ভার জনগণের। আমাদের জাতীয় জীবনে যার যতটুকু অবদান সেটা স্বীকার করতে হবে।

রিজভীর বক্তব্য প্রত্যাহার 

মঙ্গলবারই সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে বক্তব্য প্রত্যাহার করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। একই সঙ্গে তার দায়িত্বহীন বক্তব্যের জন্য দুঃখও প্রকাশ করেছেন। দলের মধ্যে প্রচন্ড সমালোচনার মধ্যে ওই বক্তব্য প্রত্যাহার করেছেন বলে জানা গেছে। কেননা বিএনপি উদারতা দেখালেও আওয়ামী লীগ কখনও সেটা করেনি। বরং জিয়াউ রহমানকে পাকিস্তানের গুপ্তচর। জিয়া মুক্তিযুদ্ধ করেনি। জিয়াউর রহমানের কবর চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে সরিয়ে দেয়ারও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। সেই আওয়ামী লীগের দাবীকে বিএনপি কিভাবে নিজেদের দাবি হিসেবে সমার্থন করে এ নিয়ে তোলপাড়। কারণ আওয়ামী লীগ বঙ্গবভন থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরানোর প্রতিবাদের আগেই যখন বিএনপির এ নেতা কঠোর প্রতিবাদ করে ফেললেন। 

বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী’র বিবৃতি

বক্তব্যের সংশোধনী

“আজ ১২ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার সকাল ১০-৩০ মিনিটে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নীচতলায় বিএনপি আয়োজিত ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও রক্তদান কর্মসূচির অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ‘বঙ্গভবন থেকে শেখ মুজিবের ছবি সরানো উচিৎ হয়নি’ মর্মে একটি সংবাদ অনলাইনে প্রকাশিত হচ্ছে।

আজ গণমাধ্যমে প্রকাশিত ‘বঙ্গভবন থেকে শেখ মুজিবের ছবি নামানো হয়েছে’ মর্মে একটি সংবাদের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ হয়। আমি মনে করেছিলাম, বঙ্গভবনের দরবার কক্ষে যেখানে সব রাষ্ট্রপতির ছবি থাকে সেখান থেকে শেখ মুজিবের ছবি নামানো হয়েছে। মূলত: ছবিটি সরানো হয়েছিল বঙ্গভবনের অন্য একটি অফিস কক্ষ থেকে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনে শেখ মুজিবের ছবি রাখার বাধ্যতামূলক আইন করা হয়েছে। ফ্যাসিবাদী আইনের কোন কার্যকারিতা থাকতে পারে না। অফিস-আদালত সর্বত্রই দুঃশাসনের চিহ্ন রাখা উচিৎ নয়। অনাকাঙ্খিত বক্তব্যের জন্য আমি দুঃখিত।”

শেয়ার করুন