রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সাহাবুদ্দিন আহমেদ চুপ্পুকে হটাতে গিয়ে ছাত্র-জনতা পারেনি রাজনৈতিক সমাঝোতার অভাবে। বিএনপি এতে বাধ সাধে। এরপরও সব চলছিল ঠিক ঠাক। কিন্তু সম্প্রতি তিন উপদেষ্টার মধ্যে দুইজনকে নিয়ে আপত্তি উঠেছে। এরা দুইজনই স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে মনে করেন ছাত্র-জনতা। প্রশাসনে সাবেক সরকারের সাজানো যে ছক সেটাও প্রায় বহাল অজ্ঞাত কারণে। কিছু অদল বদল, কিন্তু যা শেখ হাসিনার সাজানো ছকের উপর কোনো প্রভাব পড়েনি। এমন বিভিন্ন ইস্যুতে ছাত্ররা মনে করছেন তাদের প্রত্যাশার সঙ্গে মিল নেই- অন্তর্বর্তীর অনেক কাজকর্মে।
তবে এ ইস্যু প্রকট আকার ধারণ করেছে ওই দুই উপদেষ্টার নিয়োগে। যাদের একজন শেখ বশির আবার ছাত্র-জনতার হত্যাকাণ্ডের আসামি বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর বেড়িয়েছে। তিনি বিগত আওয়ামী সরকারের সুফলভুগিও বলে বলাবলি হচ্ছে। নাট্যকার ফারুকীকে নিয়েও অনেক প্রশ্ন।
এরপরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ তার ভেরিফাইড ফেসবুকের প্রোফাইল রক্ত লাল করেছেন এবং একস্থানে লিখেছেন, “রাজনীতিবিদরা হাত মেলাচ্ছে, আর বিপ্লবীদের ফাঁসির দড়ি এগিয়ে আসছে।”
তার এ কমেন্টস বা স্ট্যাটাসে ব্যাপক সাড়া পড়েছে।
৫ আগস্টের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে হাসনাত আব্দুল্লাহ ছাত্র-জনতার প্রয়োজনে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে গেছেন। সর্বদা ফ্যাসিবাদের পতনের লক্ষ্যে সোচ্চার। বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানকে সমুন্নত রাখতে দেশের এই কঠিন সময়ে সকলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার অসহনীয় পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
ফেসবুকে দেয়া তাঁর ওই স্ট্যাটাস মূলত মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী ও শেখ বশিরকে উপদেষ্টা করায় তিনি ইতোমধ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এবং এ দু’জনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় চট্টগ্রামে ৫ জনকে আটক করার ঘটনায়ও তিনি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানান। তারপরই তিনি দু’লাইনের একটি রহস্যময় স্ট্যাটাস দেন তাঁর ভেরিফাইড আইডিতে। হাসনাত আব্দুল্লাহ ওই দুই লাইন লিখেন।
অবশ্য দুই উপদেষ্টা কী প্রয়োজনে নেয়া হয়েছে তার বিশদ ব্যাখ্যা নেই। এ নিয়ে প্রায় সর্বমহলেই আলোচনা। এ ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মাহমুদুর রহমান মান্না।
তিনি একটি টেলিভিশনে তার দেয়া বক্তব্য হুবহু তুলে দেয়া গেল-
মাহমুদুর রহমান মান্না যা বললেন
‘চ্যানেল টুয়েন্টি ফোর’ নামক ওই টিভি’র ‘মুক্তবাক’ নামক এক অনুষ্ঠানে উপস্থাপক মান্নাকে প্রশ্ন করেছিলেন কিভাবে নিয়োগ হলো উপদেষ্টা? কারা আসলে দেশ চালাচ্ছে? কারা আসলে কলকাঠি নাড়ছে। যারা ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ছিল তাদেরও একটা অংশ রাস্তায় নেমে আলটিমেটাম দিচ্ছে। এ উপদেষ্টা কার সঙ্গে কলসালটেন্সন করে নেয়া হচ্ছে। কারা দেশ চালাচ্ছে?
উত্তরে মাহমুদুর রহমান বলেন, “যদি আপনি নির্মোহভাবে দেখেন তাহলে দেশে একটা সরকার আছে, এটা বোঝাই তো মুশকিল। কেন বলছি, এ গভমেন্ট একদম বিস্ময়করকম সর্বমহলের সমর্থন পেয়ে এখনও আছেন। সর্বমহলের। এ পর্যন্ত এমন তত্ত্বাবধায়ক টাইপের সরকার এসেছে সবাই ওই সমার্থনটা পেয়েছে। যেহেতু তাদের কোনো পার্টি ছিল না। সরাসরি কোনো মহলের সঙ্গে যুক্ত থাকার কোনো ইতিহাস ছিল না। মানুষ মনে করেছে এসকল ভালো লোকদের তো কোনো স্বার্থ নেই। এখনও এদের ব্যাপারেও এটা আছে। কিন্তু গঠন (উপদেষ্টা) করার প্রণালীর কথা যদি বলেন তাহলে আগে হয়েছে কি রকম, হয়তো কেউ একজন বা স্টেক মহলের সঙ্গে কথা বলেছে। বলেছেন, আপনারা নাম দেন। কাকে কেয়ারটেকারের চীফ করা যেতে পারে। আর উপদেষ্টা কারা কারা হতে পারে। পাঁচজন পাঁচজন করে নাম দেবেন। সবার কাছে হয়তো চায়নি। বড় বড় দলগুলোর কাছে হয়তো চেয়েছে। এবং সেগুলোর মধ্যে থেকে (বাছাই করে) হয়তো হয়েছে।
কিন্তু এইবারের বিষয়টা একেবারেই আলাদা। এমনিতেই যদি বলেন মাস্টারমাইন্ড বা এগুলো কিছু না স্বতঃস্ফূর্ত একটা আন্দোলন, চার (৪ আগস্ট) তারিখে অনেকেই বুঝে নাই, যে পাঁচ তারিখে এমন ঘটনা ঘটছে। পাঁচ তারিখে যখন পতন হয়ে গেল, আমাকে একজন আমাদের জোটের নেতা গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা বললেন, যে সেনাবাহিনী প্রধান ডেকেছেন, সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের। কই আমি তো ফোন পাইনি। তা যা হোক আমি গেলাম। তখন রাস্তায় এতো লোক, আর আমাদের চেহারা কিছু মানুষের কাছে পরিচিত হবার কারণে গুলশান ১ নম্বর থেকে জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত আড়াইঘন্টা লেগে গেল আমি পৌঁছাতে পারলাম না।
কিন্তু ব্রিফিং এ উনি (সেনা প্রধান) বলেছেন, সব পার্টির নেতা ছিলেন, সবার প্রথম নাম বললেন জামায়াতে ইসলামী।
তারপরে ওইখানে শুনলাম সন্ধ্যার সময় প্রেসিডেন্টের ওইখানে বসবেন সবাই। গেলাম সেখানে। ওই জায়গাতে যে কথাবার্তা হলো- সরকার গঠনের কোনো অলোচনাই হলো না। তার পরেই তো ঘোষণা টোসনা যা হবার তাই হলো এবং দেখলেনই তো যে ডক্টর ইউনূস বললেন ছাত্ররাই তাদের প্রথম নিয়োগ কর্তা বা যেমনটা যেভাবে করে তারা বলেন। এই এলাকাটা কিন্তু একটা গ্রে (ধুসর বা অস্পষ্ট) এরিয়া থাকলো। এটা ঠিক ছাত্ররা তার নাম প্রস্তাব করেছিল। সে হিসেবে ড. ইউনূস এখনও কৃতজ্ঞতাবোধ করেন যে ছাত্রাই তারা সেখানে তাকে বসিয়েছেন। ওরাই তার নিয়োগকর্তা। কিন্তু তার পরের যারা যারা এলেন তারা কিভাবে এলেন? এটা কারোর সাথে আলোচনাই হয়নি, কিছুই হয়নি। এটা যেমনটা প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রী সভার নিয়োগ দেন। এখানেও সেই চীফ এডভাইজার নিয়োগ দিয়েছেন- এমনটা মনে হয়।
যদিও প্রফেসর ইউনূস এভাবে ব্যাক্তিগতভাবে কিভাবে করছেন তা জানা যায়নি। গতকালের (১১ নভেম্বর সোমবার) ঘটনাই দেখেন, একবার প্রচার হলো পাঁচজন শপথ নেবেন। আবার কোনো কোনো টিভি বললো চারজন নেবেন। শেষ পর্যন্ত নিল তিনজন। আজকে (১২ নভেম্বর মঙ্গলবার) বাজারে কী আছে আর দুইজন শপথ নেননি। নামটা ডিসক্লোজ হয়েছে দুইজনেরই, একজন বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের যেটা পিজির প্রিন্সিপ্যাল, আরেকজন প্রাক্তন একজন আইজি। তারা নাকি শপথ নেননি। এটার কোনো ব্যাখ্যা নেই তো। এবং যাদের দেয়া হলো তাদের ব্যাপারটা খুব স্পষ্ট না। তাহলে তাদের নিলেনই বা কেন। আর তিনজন নেননি। নিয়েছেন তো দুইজন। একজন তো আগ থেকেই ছিল ওই খানে। ওই যে মাহফুজ যিনি। উনি তো ওইটার মধ্যে ছিলেনই। ফলে আপনি যদি সেই দিন ( ডে ওয়ান) থেকে ব্যাপারটা দেখেন তাহলে বিষয়টা কেমন যেন অস্পষ্ট। এবং মাঝে কয়েকটা ঘটনা এমন ঘটেছে যা রীতিমত একটু বিস্ময় উদ্রেক করে প্রশ্নের সৃষ্টি করে। আপনি কমিশন বানিয়েছেন, কনস্টিটিউশন কমিশন বানিয়েছেন সেখানে একজনের নাম ঘোষণা হলো, ২৪ ঘন্টা যেতে না যেতে সে নাম বদলে গেল। কেন?
কোনো সাংবাদিক এটা প্রুফ করলো কিনা জানি না কিন্তু ওই ভদ্রলোকের কোনো কথা শোনা গেল না। শুধু একটা কথা শোনা গেল ওই ভদ্রলোক একটা কথা বলেছিল যে ’৭২ এর যে সংবিধানটা আছে সেটা আমরা অ্যামেনম্যান্ট করে আপডেট করতে পারি। সেটাতে আমাদের চলে। কিন্তু এখন যিনি হলেন বা যারা কাজ করছেন, তারা বলছেন রিরাইট করতে হবে অথবা ’৭২ ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। নতুন করে করতে হবে।
তাহলে এখানে কিছু কিছু চিন্তারও ক্লেশ আছে। কিন্তু সেটা স্পষ্ট নয়। কারণ আপনি ’৭২ ছুঁড়ে দিতে চাইলেও ’৭২ এর যিনি প্রণেতা ড.কামালের কাছে আবার এই কমিশন গেলেন। এবং কথা বললেন। এবং তার পর সুপ্রীমকোর্টে যে অলোচনা সেখানে ড. কামাল ’৭২ এর সংবিধানের পক্ষে যে যে কথা বলার সেটা বললেন। আমি এ কথা কেন বলছি- এ ঘটনা থেকে এ গভর্মেন্ট যে একটা ডিসিপ্লিন ওয়েতে যাচ্ছে সেটা না। লতিফুর রহমান যখন কেয়ারটেকার চীফ হয়েছিলেন, উনি বিকেল বেলায় শপথ নিয়েছিলেন, রাত ৯টার মধ্যে ২৩ জন না কজন যেন সেক্রেটারী (সচিব) বিদায় করে অন্য জায়গায় বদলী করে পাঠিয়েছিলেন। এই গভর্মেন্টের কোনো অ্যাকশনই নাই। নাকি পুলিশকে কোনো রেগুলারাইজ করতে পেরেছে, নাকি সিভিল ব্যুরোক্রাসি কোনোটাই করতে পারে নাই। এবং তাদের সাথে যদি কোনো কথা বলেন, মানে তাদের কনসার্ণ তাদের সাথে, বলবে লোক তো পাই না ভাই, কাকে দিয়ে করবো। এ্যাজিব ডাউন দ্যা লাইন কেউই তাদের নাই। অথচ আমার খুব মনে আছে, আমি তো আওয়ামী লীগ করেছি, খালেদা জিয়া দেশ চালাচ্ছেন, তখন শেখ হাসিনা বলতেন তোমরা ক্ষমতায় যেয়ে কি করবে অন্তত তিন চারটা স্তর পর্যন্ত বেগম জিয়া সাজিয়ে রেখেছেন। তোমরা যেয়ে কিছুই করতে পারবে না। আবার উনি যখন ক্ষমতায় গেলেন তখন সবই তারা ওনাকেই সার্ভ করছে। তবে এইখানে করছে কেন, বা কী করছে আসলে ওই জায়গাগুলো তো রেডিই করতে পারেনি তারা। এখনও ল’ অ্যান্ড অর্ডার সিচ্যুয়েশন ক্লিয়ার না। এডমিনেস্ট্রেশনের এফিসেন্স কোনো লোক আপনি নেননি।
এই গভমেন্টের কিছু নাম টাম নিচ্ছে না, সোস্যাল ইনফ্লুয়েন্সর আছে, ওইরকম নামটামের মধ্যে আমি নাই যাই, কাউকে ছোট করার কথা আমি বলতে চাইছি না, আমি বলছি যে দেশ চালাবে এর জন্য যোগ্য লোক উপযুক্ত লোক নেয়ার বদলে যাদের নিচ্ছেন এর কোনো মিনিংই ক্যারি করে না। গতকালের (তিনজনের শপথ) এরই তো কোনো মিনিং ক্যারি করে না।”
সর্বশেষ
প্রধান উপদেষ্টা কপ সম্মেলনে যোগ দিতে আজারবাইজানে রয়েছেন। এদিকে নতুন উপদেষ্টাগণও অন্যদের সঙ্গে প্রাণবন্তভাবে মিশছেন। সবাই সহজেই গ্রহণ করছেন। কিন্তু বাইরে এ নিয়ে রীতিমত ঝড় বইছে। আপাতত হয়তো এভাবেই চলবে। প্রধান উপদেষ্টা বিষয়টা কতটা উপলব্ধি করবেন এটা তার ব্যাপার। হয়তো তার ফেরা পর্যন্ত একটা অপেক্ষা চলবে কিছু একটা হয় কি না, নাকি আপন গতিতেই চলবে সব- সময় এলেই উত্তর মিলবে।