বাংলাদেশে নদীর নাম উচ্চারণ করলে প্রথমেই আসে পদ্মা নদীর নাম। এটা বাংলাদেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী। পদ্মা কখনো উত্তাল হয়, কখনোবা শান্ত। পদ্মার এই দৃশ্য দেখে কত কবি, কত গীতিকার তাদের অনুভূতির কথা লিখেছেন। কেউ পদ্মা নদীর অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন। কেউবা লিখেছেন গল্প-উপন্যাস। কেউবা পদ্মা নদীর সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছেন, আবার কেউবা পদ্মানদীর সর্পিল গতি ও বিশালতা দেখে ভয় পেয়ে অবলীলায় নিজেকে সেই নদীর কাছেই সমর্পণ করেছেন।
বাংলা উপন্যাসে এই পদ্মা নদী বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। উপন্যাসের ভেতরে পদ্মা যে কতবার এসেছে নাম নিয়ে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এর মধ্যে পদ্মানদীর মাঝি-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, পদ্মার পলিদ্বীপ-আবু ইসহাক, পদ্মা প্রমত্তা নদী-সুবোধ বসু, পদ্মা-প্রমথ নাথ বিশী, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-আবু জাফর শামসুদ্দিনের উপন্যাসের কথা উল্লেখ করা যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ এবং সুবোধ বসুর ‘প্রমত্তা পদ্মা নদী’ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে জেলে জীবনের আখ্যান নির্মিত হয়েছে। ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ উপন্যাসে চরের মানুষের সংগ্রাম ও প্রেমের চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রমথ নাথ বিশীর ‘পদ্মা’ উপন্যাসে নদীর শীতকালের শীর্ণ অবস্থাকে তুলে ধরা হয়েছে। রাজশাহীর পদ্মায় জেগে ওঠা বিশাল চরকে নিয়েই যেন প্রমথ নাথ বিশীর ‘পদ্মা’ অবয়ব পেয়েছে। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাক ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ উপন্যাসটির উপজীব্য পদ্মাপাড়ের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। বাংলাদেশে বিদ্রোহী পদ্মা নামে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়। আশকার ইবনে শাইখের উপন্যাস অবলম্বনে ‘বিদ্রোহী পদ্মা’ ছবিটি পরিচালনা করেন বাদল খন্দকার।
পদ্মা নদী রাজনৈতিক আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছে বহুবার। ষাটের দশকের আন্দোলনের সেøাগান ছিল, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ এই পদ্মার বুকচিরে এ দেশে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন গড়ে ওঠে। আজ সেই আন্দোলনের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ। পদ্মার নৈসর্গিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জাতীয় কবি নজরুল ইসলামকে আকৃষ্ট করেছে। তার হাতে তৈরি হয়েছে সেই অমর গান-‘পদ্মার টেউ রে, মোর শূন্য হৃদয় নিয়ে যা যা রে’।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ‘পদ্মা’ শিরোনামে কবিতা লিখেছেন। এর পংক্তিমালা হচ্ছে, ‘হে পদ্মা আমার/ তোমায় আমায় দেখা শত শত বার/ একদিন জনহীন তোমার পুলিনে/ গোধূলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে/ সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অন্তমান/ তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান।’
বাংলা সাহিত্যে আরেক কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনিও পদ্মা নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তার অনুভূতি এরকমÑ‘হে পদ্মা! প্রলয়ঙ্করী! হে ভীষণ ভৈরবী সুন্দরী!/ হে প্রগলভা হে প্রবলা! সমুদ্রের যোগ্য সহচরী তুমি শুধু/ নিবিড় আগ্রহ আর পার গো সহিতে/ একা তুমি সাগরের প্রিয়তমা, অয়ি দুর্বিনীতে!’ ভারতের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ভূপেন হাজারিকা পদ্মাকে গঙ্গার মতো সমান চোখে দেখেছেন। যে কারণে তিনি গেয়েছেন, ‘গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা/ ও আমার দুই চোখে দুই জলের ধারা মেঘনা যমুনা।’ আবদুল আলীমের কণ্ঠেও উঠে এসেছে পদ্মা নিয়ে গাওয়া গান।
‘পদ্মারে তোর তুফান দেইখ্যা পরাণ কাঁপে ডরে
ফেইল্যা আমায় মারিস না তোর সর্বনাশা ঝড়ে।’
কিশোর কবি সুকান্ত। অল্প বয়সে তিনি অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। তার ‘দুর্মর’ নামে একটি কবিতায় এভাবেই উঠে এসেছে আমাদের প্রিয় পদ্মা নদী। ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ/ কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে।’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পদ্মা নদীকে খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। পদ্মাপাড়ের ছোট গ্রাম এভাবেই উঠে এসেছে তার ভরাট কণ্ঠে। ‘পদ্মা নদীর পাড়ে ছোট আমার গ্রাম’।
বাংলাদেশের মরমি শিল্পী আবদুল আলীম তার দরাজ কণ্ঠে গেয়েছেন-
পদ্মা রে তোর তুফান দেইখ্যা পরাণ কাঁপে ডরে
ফেইল্যা আমায় মারিস না তোর সর্বনাশা ঝড়ে।
পদ্মা নদীকে নিয়ে এতক্ষণ ভূমিকা দিলাম। এবার আসল কথায় আসি। আমাদের প্রিয় পদ্মা নদী, আমাদের ভালোবাসার পদ্মাকে নিউইয়র্কে বিক্রি করছে অতি মুনাফালোভী কতিপয় প্রবাসী ব্যবসায়ী। কিছুদিন আগে আমার এই কলামেই ‘পদ্মা ইলিশ কি পদ্মার!’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম। বিষয়বস্তু ছিল নিউইয়র্কের বাংলাদেশি গ্রোসারিগুলোতে সহজলভ্য একটি ব্র্যান্ড ‘পদ্মা ইলিশ’। কভারে বড় করে তাই লেখা ছিল। আরো লেখা ছিল ‘হাওর ব্র্যান্ড’। নিচে লেখা-দেশি মাছের সেরা স্বাদ।
পদ্মা আর হাওর দুটোই বাংলাদেশের অংশ। এ দুটো নাম দেখার পর কারো বিভ্রান্ত হওয়ার অবকাশ নেই। আর কিছু খুঁজে দেখার প্রয়োজন হয় না। চোখ বন্ধ করে যে কেউ কিনে নেবেন এই ব্র্যান্ডের মাছ। কিন্তু অনুসন্ধিৎসু কেউ যদি একটু খুঁটিয়ে দেখেন, দেখতে পারেন প্যাকেটের গায়ে অত্যন্ত ছোট করে প্রিন্ট করা আছে একটা মানচিত্র। অপ্রাসঙ্গিক মায়ানমায়ের মানচিত্র এই প্যাকেটে কেন? সোজা উত্তর, মায়ানমারের মাছই আমরা পদ্মা ইলিশ নামে খাচ্ছি। আইন থেকে বাঁচতেই প্যাকেটের গায়ে এ মিয়ানমারের মানচিত্র সংযোজন।
গত সপ্তাহে আবার স্থানীয় বাংলাদেশি গ্রোসারিতে গিয়ে দেখলাম ইলিশের আরো একটি ব্র্যান্ড। নাম ‘পদ্মার হিলশা’। বাজারজাত করেছে নিউইয়র্কের অন্য একটি বাংলাদেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তবে এরা চোর হলেও ইমানদার। মাছের প্যাকেটে বড় করে ‘পদ্মার হিলশা’ লিখলেও অন্য কোম্পানির মতো মায়ানমারের মানচিত্র না দিয়ে ছোট ছোট হরফে লিখে দিয়েছে, প্রোডাক্ট অব মায়ানমার। এটাও অবশ্য আইন থেকে বাঁচার একটা অপচেষ্টা।
এসব ব্যবসায়ী ভাইদের কাছে প্রশ্ন, পদ্মা কি তার গতিপথ বদলিয়ে মায়ানমারে গিয়ে ঢুকেছে? যদি তা নাই হয়, তাহলে মায়ানমারের ইলিশকে পদ্মার ইলিশ নাম দিয়ে আইন বঁাঁচিয়ে কেন নিরীহ প্রবাসীদের ঠকাচ্ছেন? কেন আমাদের প্রিয় পদ্মাকে, ভালোবাসার পদ্মাকে বাংলাদেশ থেকে নিউইয়র্কে টেনে এনে এমন সস্তা দরে বিক্রি করছেন? আপনাদের এ অধিকার কে দিয়েছে?
লজ্জাও লজ্জা পায়!
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পর তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতি দেয় আওয়ামী লীগ। ওই বিবৃতিতে শেখ হাসিনাকে ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী’ উল্লেখ করা হয়।
এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ভারতের যেসব সাংবাদিক হাসিনার অনুগত এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিত্য লেখালেখি করেন, তাদের একজন এ নিয়ে জানতে চাইলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন ভারত শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আশ্রয় দিয়েছে। শেখ হাসিনা এখনো নিজেদের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দাবি করলেও ভারত সেটা মনে করছে না। তিনি আরো বলেন, বারবার আমরা বলেছি তিনি (শেখ হাসিনা) বাংলাদেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। আমরা এই অবস্থানেই আছি।
শেখ হাসিনা আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। বাংলাদেশে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যারা দেশ পরিচালনা করছেন। এসব ভুলে গিয়ে শেখ হাসিনাকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেওয়া বাস্তবতাকে অস্বীকার করার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দৈন্যতা বলেই অনেকে মনে করছেন।
প্রবাসে হারিয়ে যাচ্ছে মূল্যবোধ!
প্রবাসে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের নিয়ে শঙ্কায়। নতুন প্রজন্মের জীবন দর্শন অনেকটা এরকমÑখাও দাও ফুর্তি করো। পারিবারিক বন্ধন ক্রমেই যেন আলগা হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক, সামাজিকতা, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া নতুন প্রজন্মকে আগ্রহী করে না। খাবার টেবিলেও তাদের দেখা মেলে না। তাদের রয়েছে হাজার হাজার অনলাইন বন্ধু। এসব ভার্চুয়াল বন্ধুদের নিয়েই তাদের জীবন। বলা যায়, তারা এখন ভার্চুয়াল জগতের এক বাসিন্দা। তারা পৃথিবী বিমুখ, জীবন বিমুখ। মায়ের হাতের রান্না তাদের আকৃষ্ট করে না। মায়ের হাতের খাবারের চেয়ে অনলাইনে অর্ডার দেওয়া খাবার তাদের কাছে অধিক প্রিয়।
ঘরে ঘরে ডিশের বদৌলতে চলে দেশি-বিদেশি চ্যানেলের রমরমা বিজাতীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সকালের নাশতা হয় চলার পথে বা কর্মস্থলে। স্ত্রী-পুত্র পরিবার নিয়ে একসঙ্গে রাতের খাবার টেবিল মুখরিত হয় না অনেকের ঘরেই। মুসলিম বাবা-মা তাদের শিশুসন্তানকে বিজাতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নিজেরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন। এই যে আমাদের নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, আমরা কি তাদের কথা একবারও ভাবি? প্রত্যেক বাবা-মা কি তাদের সন্তানের খোঁজখবর রাখেন? সন্তানকে কীভাবে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তা নিয়ে কি ভাবেন? সন্তানের বাবা-মা ব্যস্ত রয়েছেন জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর জন্য, দিনরাত পরিশ্রম করে আনা অর্থ কোনো কাজে লাগছে কি না সে বিষয়ে কারো চিন্তার সময় নেই। সন্তান কী শিখছে, কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, সে খেয়াল রাখার মতো অবস্থা অনেক অভিভাবকের নেই।
একটা শিশুর প্রথম শিক্ষা তার ঘর থেকেই শুরু হয়। চোখ খোলার পর ঘরকেই সে আপন করে নেয়। শিশু প্রথমেই তার বাবা-মার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে বড় হয়। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কী ধরনের ভূমিকা পালন করতে হয়, সততা, তাদের বিশ্বাস, আচার-ব্যবহার সবকিছুই বাবা-মায়ের কাছ থেকে শেখে। অভিভাবকদের মধ্যে যদি অসদাচরণ, অযৌক্তিক চিন্তা-চেতনা, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার দেখা যায়, তবে সেই শিশুটিও মানসিকভাবে সেভাবেই গড়ে ওঠে। সমাজে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রয়োজন আছে, ভালোবাসা, সৎ-অসৎ বিচারের প্রয়োজন আছে, তবে তার বীজ ঘরেই রোপণ করতে হবে এবং এর মূল হতে হবে বাবা-মা দু’জনই। সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এগুলো থেকে বের হয়ে আসা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সমাজ বিনির্মাণে, রাষ্ট্রের একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারে আমাদের যে কিছু দায়িত্ব রয়েছে, সেগুলো আমরা সঠিকভাবে পালন করছি কি না, কিংবা বেমালুম ভুলে যাচ্ছি কি না, আমার মনে হয় এখন সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে।