ছাত্রসমাজ সূচিত কোটাবিরোধী আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। নোবেল লরিয়েট ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সেনাসমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশ সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। অঙ্গীকার ছিল জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যা, লুটতরাজের আন্তর্জাতিক মানের বিচার, সমাজজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং ন্যূনতম সময়ে স্বাধীন, নিরপেক্ষ, অবাধ জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
১০০ দিন সময় এ কাজসমূহের জন্য নিঃসন্দেহে অপর্যাপ্ত। কিন্তু একেবারে সামান্য নয়, ভেঙেপড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার বিষয়ে কিছু কার্যক্রম গৃহীত হলেও কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়াা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সামান্য। বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে নিত্যপণ্যের দ্রব্যমূল্য এখনো আকাশছোঁয়া। সীমিত আয়ের মানুষ আছে মহাসংকটে। পুলিশ অবিন্যস্ত এবং স্থানীয় প্রসাধন অগোছালো থাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক। সড়ক শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। শিল্পাঞ্চলে প্রায়ই অসহিষ্ণুতা দেখা যাচ্ছে। জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকট সহসা সামাল দেওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এমনকি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাণিজ্য সেক্টরসমূহেও অরাজকতা বিরাজ করছে। যখন তখন সামান্য বিষয় নিয়ে ঘেরাও আন্দোলন হচ্ছে।
১০০ দিন অতিবাহিত হলেও সরকার কিন্তু তাদের ভিশন সুনির্দিষ্ট করতে পারেনি। বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হলেও এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়নি। আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার বিচার কমিশন গঠিত হলেও বিচারকার্য শুরু হয়নি। ভেঙে পড়া পুলিশ প্রশাসন এখনো সক্রিয় না থাকায় সেনাবাহিনীকে এখনো সড়কে মোতায়েন রাখা হচ্ছে। এমতাবস্থায় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে।
সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ অধিকাংশ উপদেষ্টা নিজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রথিতযশা এবং স্বনামধন্য। তবে বাংলাদেশের মতো জটিল সমস্যাসংকুল রাজনৈতিক পরিবেশে সংকটাপন্ন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো সক্ষমতা তাদের আছে কি না- প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। স্মরণে রাখতে হবে, অনির্বাচিত সরকার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়া অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। আর সব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার মতো কোনো অধিকার তাদের নেই। এমনিতেই এই সরকারের বৈধতা বিষয়েও যৌক্তিক প্রশ্ন আছে। উপরন্তু সরকার-ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তি নানা কথা বলে সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে সরকারের অবস্থান জটিল করে তুলেছে।
একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মূলশক্তি জনগণ। জনগণ অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ভোট প্রয়োগ করে রাজনৌতিক দলকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেবে। কোন রাজনৈতিক দল থাকবে, কোনটি থাকবে না সেটি নির্ধারণ করবে জনগণ নির্বাচিত পার্লামেন্ট। দেশটি কিন্তু রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্বীকার করলে কিন্তু দেশের অস্তিত্ব থাকে না। স্বাধীনতা অস্বীকার করে স্বাধীন দেশে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে কিছু প্রচার করা সঠিক না। কিছু তারুণ্যের উচ্চারণে স্বাধীনতার বিজয়ী বীরদের নিয়ে কটাক্ষ করা শোভা পায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছু বিতর্কিত ব্যক্তিকে উপদেষ্টা বানানোর বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সরকার-ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ পতিত সরকারের মন্ত্রী-সাংসদদের মতো অহংকারী আস্ফালন করছে। প্রধান উপদেষ্টার উচিত নিজেদের অবস্থান সুস্পষ্ট করা।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে কিন্তু অদূর বা সুদূর পরিকল্পনার কোনো সুস্পষ্ট অভ্যাস নেই। উনি বললেন, রাজনৈতিক দলগুলো না চাইলে সংস্কার ছাড়াই নির্বাচন দেওয়া হবে। এটি অভিমানী উচ্চারণ। এটি ঠিক মানানসই নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অংশীজনদের সম্পৃক্ত রেখে কিছু রূপরেখা প্রণয়ন করতে পারে। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজন নির্বাচিত সরকার, নির্বাচিত পার্লামেন্ট। কত জন, কত কথা বলেছে। সংবিধান নতুন করে লিখবে, জাতীয় সংগীত পাল্টে দেবে। ১০০ দিনেও জুলাই আগস্ট নিহত আহতদের পুনর্বাসনের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা না হওয়ায় ওদের সড়কে আসতে হয়েছে। সরকার এখনো সুবিধাভোগী আমলাদের ওপর নির্ভর করে আছে। উন্নয়ন কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির হয়ে আছে।
আশা করবো বিচক্ষণ সরকারপ্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর স্বরূপ বুঝতে পেরেছেন। সরকারের ২০০ দিন পার হওয়ার আগেই সংস্কার সম্পাদন এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি যুগপৎ পথনকশা আশা করবো। সেই সঙ্গে আশা করবো সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা যেন বাগাড়ম্বর না করে সরকারকে সর্বোতভাবে সহায়তা করে। এক মাঘে কিন্তু শীত যাবে না।