০২ অক্টোবর ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৮:২৮ অপরাহ্ন


পরিবেশ ধ্বংসে কালো টাকার প্রভাবও দায়ী
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০১-২০২৫
পরিবেশ ধ্বংসে কালো টাকার প্রভাবও দায়ী বক্তব্য রাখছেন ড. নজরুল ইসলাম


বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, অতি মুনাফা ও বাজার অর্থনীতি পরিবেশ ধ্বংসের মূল কারণ। আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবে পরিবেশ সুরক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য সম্মিলিতি প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ প্রয়োজন। তবে সবার আগে এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে বিশেষ কমিশন গঠন করতে হবে। তিনি আরো বলেন, বাজার অর্থনীতির কারণে জমির অস্বাভাবিক মূল্য বেড়েছে। যে কারণে নদ-নদী, জলাভূমি ও বনভূমি দখল করে আবাসন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। এক্ষেত্রে কালোটাকার প্রভাবও দায়ি বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, পরিবেশ ধ্বংসে কালোটাকার প্রভাবও দায়ি। “বাপা’র ২৫ বছরঃ পরিবেশ আন্দোলনের সাফল্য ও চ্যালেঞ্জ” বিষয়য়ে দুই দিন ব্যাপী বাপা-বেন সম্মেলন উদ্বোধনী দিনে তিনি এসব কথা বলেন।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান আরো পরিবেশ সুরক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ নিবে বলে আশা প্রকাশ করে অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা নিজেই একজন পরিবেশবিদ। তিনি পরিবেশ সুরক্ষায় ইতোমধ্যে ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে, বিভিন্ন ইস্যুতে সরকার কমিশন ও বিশেষ কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু পরিবেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এখনো কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। 

পরিবেশ সুরক্ষায় বাংলাদেশের নাগরিকদের সম্পৃক্ততার প্রশংসা করে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন আরও বলেন, নাগরিক সম্পৃক্ততা থাকলেও অনেকেই ভিন্ন ভিন্ন প্লার্টফর্মে থেকে আন্দোলন করছে। ফলে দেশে অনেক যুগোপযোগী ও অত্যাধুনিক আইন থাকলেও যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবে তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। সুফল পেতে চাইলে সকলকে একই মঞ্চে আনতে হবে। এরমাধ্যমে সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি সহজ হবে। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প দেশের জ্বালানি সমস্যা সমাধানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের স্বপ্ন দেখানো হয়েছিলো। কিন্তু বাস্তবে কোন স্বপ্নই পুরণ হয়নি। বরং ওই অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ উদ্বাস্থ হয়েছে। আমাদের পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। পরিবেশ ধ্বংস করে এমন প্রকল্প থেকে রেবিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

১৭ জানুয়ারি, ২০২৫ তারিখ শুক্রবার সকালে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এর টিএসসি মিলনায়তানে দুই দিনব্যাপী বাপা-বেন সম্মেলন বিশেষ সম্মেলন হয়। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাপা সভাপতি ড. নুর মোহাম্মদ তালুকদার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন বেন-এর প্রতিষ্ঠাতা ও বাপার সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম। বক্ততা করেন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. আব্দুল লতিফ, বেন-এর গ্লোবাল সমন্বয়কারি অধ্যাপক ড. মো. খালেকুজ্জামান, বাপা সহ-সভাপতি ড. মোস্তাফিজুর রহমান, অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল ইসলাম ও খুশী কবির, বাপা সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির, কোষাধ্যক্ষ জাকির হোসেন, যুগ্ম সম্পাদক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার প্রমুখ।

এছাড়াও সম্মেলনের রাজনীতিবিদদের দৃষ্টিকোণ থেকে বাপা এবং পরিবেশ রক্ষার সংগ্রাম অধিবেশনে আলোচক হিসেবে উপস্থি ছিলেন রুহিন হোসেন প্রিন্স, সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), মাহমুদুর রহমান মান্না, সভাপতি, নাগরিক ঐক্য, এড. হাসনাত কাইয়ূম, প্রধান সমন্বয়ক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় সমাজতান্ত্রীক দল (জেএসডি), ডা. মনীষা চক্রবর্তী, সদস্য কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল প্রমুখ।

ধারণাপত্রে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বিগত ২৫ বছরের কাজের মধ্য দিয়ে বাপা ও বেন দেশের পরিবেশের সমস্যাবলী সম্পর্কে এক বিপুল জ্ঞানভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশের আর কোনো সংস্থার কাছে, কিংবা এমনকি সরকারের কাছে এ দেশের পরিবেশের সমস্যাবলী সম্পর্কে এরূপ তথ্য, বিশ্লেষণ এবং সুপারিশের সম্ভার আছে কিনা সন্দেহ। এসব গ্রন্থ এখন বাংলাদেশের পরিবেশ বিষয়ক গবেষণা ও আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উৎস্য হিসেবে কাজ করছে। তবে বাপাকে এখনো উজানে নৌকা বাইতে হচ্ছে। স্ব-অর্থায়ন ও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে পরিবেশ রক্ষামূলক কাজের সংস্কৃতি অব্যাহত রাখা কঠিন হচ্ছে। তাই এই কাজে সম্মিলিত উদ্যোগ ও সহযোগিতা প্রয়োজন।

সভাপতির বক্তব্যে ড. নুর মোহাম্মদ তালুকদার বলেন, দীর্ঘ ২৫ বছরের পথচলায় বাপার অনেক অর্জন থাকলেও সারাদেশে কার্যকর পরিবেশ আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। সারাদেশে স্থানীয় পরিবেশ সমস্যা নিয়ে ভূক্তভোগী জনগণ আন্দোলন করছেন। যাদের অনেকের কাছে আমরা পৌছাতে পারেনি। অনেকে এখনো বাপার খোঁজ রাখে না। তাদের কাছে আমাদের পৌঁছাতে হবে। 

এদিকে সম্মেলনের নদ-নদী ও পানি ব্যবস্থাপর্না অধিবেশনে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান যোগ দিয়ে বলেন, পরিবেশ সুরক্ষায় ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিটি জেলার একটি নদীকে দখল ও দুষণমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাজধানীর চারপাশ দিয়ে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীকে দখলমুক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে। ভারতের সঙ্গে আন্তঃনদী সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে তিস্তার পানি সমস্যার সমাধানে কাজ চলছে। ইকোসিস্টেম পূনরুদ্ধারে কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এ সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।

এদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন) এর উদ্যোগে এবং দেশের পরিবেশ সপক্ষ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান/সংগঠনের যৌথ অংশগ্রহণে দ্বিতীয় দিনে সম্মেলনে ‘স্থায়িত্বশীল নগরায়ন’, ‘জ্বালানী, বিদ্যুৎ, ও জলবায়ু পরিবর্তন’ এবং ‘বন, পাহাড়, উপকূল, ও আদিবাসী অধিকার’ বিষয়ের উপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয় এবং এবিষয়ে আলোচকগন দিক নির্দেশনামূলক আলোচনা করেন। 

সরকারি বেসরকারি মেগা প্রকল্পের কারণে বনাঞ্চল ধ্বংস হচ্ছে বলে মনে করেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞবৃন্দ। তারা বলেছেন, বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে বনের জায়গা দখল করে একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে। কল-কারখান, রিসোর্ট, আবাসনসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। যা বনাঞ্চল ধ্বংসের পাশাপাশি পরিবেশগত ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা মোকাবেলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বিশেষ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘বন, পাহাড়, উপকূল, ও আদিবাসী অধিকার’ শীর্ষক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে এ সব কথা বলেন তারা। বাপা সহ-সভাপতি মহিদুল হক খানের সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সভায় ধারণাপত্র উত্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এম শহীদুল ইসলাম। বাপার যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাসের সঞ্চালনায় সভায় আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন কনা ও অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মীর মোহাম্মদ আলী, আদিবাসী নেতা দীপায়ন খীসা প্রমুখ। সভায় উত্থাপিত ধারণাপত্রে ড. এম শহীদুল ইসলাম বলেন, একটি দেশে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকার কথা থাকলেও আমাদের সরকারি হিসেবে আছে ১৩ শতাংশ। বাস্তবে আরো কম। গবেষণায় দেখা গেছে, গত ২৫ বছরে পাহাড়ে ৩০ শতাংশ বনভূমি কমেছে। যার অন্যতম কারণ শিল্পায়ন ও নগরায়ন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারি সংস্থাও বনের জায়গায় বিশাল বিশাল প্রকল্প করেছে। বনের মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে, হরেক ধরনের রিসোর্ট। যা বনের গাছপালা শুধু নয়, বনের প্রাণ-প্রকৃতিও নষ্ট করছে। 

আলোচনায় অংশ নিয়ে ড. কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ বলেন, অদূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে ভূমি ও ভূ-প্রকৃতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যে কারণে পাহাড়, উপকূলসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে।

অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন কনা বলেন, যে ব্যবস্থাপনা আমাদের বনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে সেই ব্যবস্থাপনা আমরা চাই না। আদিবাসীরা ৮৫ শতাংশ বন রক্ষা করে থাকে। অথচ তাদেরকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এটা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বন ও ভূমি বিপর্যয় থেকে রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।

সহকারি অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, উপকূল সর্বদাই বঞ্চিত। উপকূলের চারপাশে পানি হলেও বিশুদ্ধ পানির সংকট চলমান, পানির করণের স্বাস্থ্য সমস্যা, দখল ও দূষণে মৃতপ্রায় নদীগুলো। সরকার ও জনগণের ঐক্যবদ্ধভাবে ব্লক ও বাঁধ দিয়ে উপকূল রক্ষা করার নামের অনিয়ম বন্ধ, উপকূলের নিষিদ্ধ জাল নির্মূল ও জেলেদের পুনর্বাসন জরুরি বলে গুরুত্ব আরোপ করেন। দ্বিতীয় দিনের শুরুতে ‘স্থায়িত্বশীল নগরায়ন’ বিশেষ আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন বাপা সহ-সভাপতি খুশী কবির। ধারণাপত্র উত্থাপন করেন পরিকল্পনাবিদ তৌফিকুল আলম। এতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, সভাপতি, সেন্টার ফর আরবান স্ট্যাডিস (সিইউএস), ড. খায়রুল ইসলাম, আঞ্চলিক পরিচালক, ওয়াটার এইড বাংলাদেশ এবং ড. শাকিল আক্তার, অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, বুয়েট প্রমুখ।

শেয়ার করুন