১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ০৪:১৯:৫৫ পূর্বাহ্ন


একের পর এক অপরিকল্পিত মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক ঋণে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০১-২০২৫
একের পর এক অপরিকল্পিত মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক ঋণে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ কর্ণফুলী ট্যানেল


দুনিয়ার অধিকাংশ উন্নত দেশ দূরদৃষ্টিমূলক সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে স্বনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন করেছে। আবার কিছু দেশ বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও লুটেরা মানসিকতার কারণে নিজেদের সম্পদ আহরণ এবং কাজে না লাগিয়ে ঋণ করে ঘি খাওয়ার চেষ্টায় দেনার দায়ে বিপর্যস্ত হয়েছে। বাংলাদেশের এখন সমন্বিত অভ্যন্তরীণ ঋণ ১০ লাখ ২০ হাজার ২০৫ কোটি টাকা, বিদেশি ঋণ ১০ লাখ ১৩ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। সরকারের মোট ঋণ ২০ লাখ ৩৩ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা। 

জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতা আন্দোলনে সরকার পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উত্তরাধিকার হিসেব ১৮ লাখ ৩২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা ঋণের বোঝা পেয়েছে। সেপ্টেম্বর ২০২৪ নাগাদ ঋণের বোঝা ২০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। মিডিয়া প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৮ হাজার ৪৪৪ কোটি ৫৪ লাখ মার্কিন ডলার। প্রতি দলের ১২০ টাকা হারে এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ১৩ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। আছে প্রায় একই পরিমাণ অভ্যন্তরীণ ঋণ। দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদদের মতে, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ এবং বৈদেশিক আয়ের তুলনায় এই বিপুল পরিমাণ ঋণের দায় দায় মেটানো বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভঙ্গুর করে ফেলেছে। সঠিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং দেশিপ্রেমী ব্যবস্থাপকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে কর আহরণ এবং বৈদেশিক বাণিজ্য, রেমিট্যান্স বাড়িয়ে সক্ষমতা বাড়াতে না পারলে, দেউলিয়া হয়ে পড়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের নিম্নতম দেশের অন্যতম। দেশের বিশাল সক্ষম জনগোষ্ঠী রয়ে গেছে কর কাঠামোর বাইরে। আর যারা কর প্রদান করছে, তারাও নানা ফন্দিফিকির করে সঠিক কর প্রদান করছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কার্যক্রম আধুনিক প্রযুক্তিতে শক্তিশালী হয়নি। আমদানি রফতানির ক্ষেত্রেও আন্ডার ইনভয়েসিং ওভার ইনভয়েসিং করে অর্থ পাচার করা হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। প্রবাসীরা অনেক কষ্টে অর্থ উপার্জন করে রেমিট্যান্স পাঠালেও তার বিরাট অংশ হুন্ডি ব্যবসায়ীরা লুটে নিচ্ছে। রফতানি আয়ের একটা বিরাট অংশ দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারছে না। রফতানি বহুমুখীকরণের বাস্তবসম্মত কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে না। অথচ লোক দেখানো উন্নয়নের জোয়ার দেখিয়ে লুটেরা শ্রেণিকে অর্থ লোপাটের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথেচ্ছ লুটপাটে সাবাড় করা হয়েছে। সঠিক পরিকল্পনা, রিস্ক অ্যানালাইসিস না করেই অসংখ্য বিদেশি ঋণনির্ভর প্রকল্প নিয়ে দেশের অর্থনীতি পঙ্গু করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারে কিছু পরিকল্পনা নিলেও অন্তত ৮-১০ বছর সময় লাগবে অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে।

কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কথা বলা যেতে পারে। যেমন- কর্ণফুলী নদীর তলদেশের সুড়ঙ্গপথ, পদ্মা বহুমুখী সেতুতে রেলসংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিপুল ব্যয়ে বাস্তবায়িত এই প্রকল্পগুলোর বিনিয়োগ নির্দিষ্ট সময়ে ফিরে আসা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। অথচ সাধারণ দৃষ্টিতে এগুলো আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে। প্রকল্পগুলোর আর্থিক এবং অর্থনৈতিক উপযোগিতা প্রমাণের জন্য যে আনুষঙ্গিক কাজগুলো করার দরকার ছিল করা হয়নি। পদ্মা সেতু দিয়ে নির্মিত রেল যোগাযোগ যদি মোংলা এবং পায়রা সমুদ্রবন্দরগুলোকে যুক্ত করা হতো, তাহলে আমদানি রফতানির সহায়ক হয়ে দ্রুত বিনিয়োগ উঠে আসতো। কিন্তু পায়রার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা আছে। বাস্তবে ছিটেফোঁটাও কাজ হয়নি। মোংলার সঙ্গে রেলসংযোগ একটু ঘুরে হলেও তো বিদ্যমান। অন্যদিকে কর্তফুলী নদীর তলদেশে সুড়ঙ্গপথ নির্মাণের পাশাপাশি দক্ষিণ কর্তফুলী এলাকায় শিল্পায়নের ব্যাপক ব্যবস্থা এবং দক্ষিণ কর্তফুলী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় পর্যটন সুবিধা সম্প্রসারণ করা উচিত ছিল। কিন্তু কই, হয়নি তো। কর্তফুলী সুড়ঙ্গপথ চালু হওয়ার পর থেকে লস আর লস। লাভের মুখ দেখার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাহলে এটা অপরিকল্পিত!

এমনিতেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অত্যন্ত অধিক বিনিয়োগঘন কারিগরি ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্প। এই প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ গ্রিডে সঞ্চালনের সহায়ক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা এবং জটিলতা এই প্রকল্পকে সাদা হাতি বানাতে পারে বলে অনেকের শঙ্কা। অথচ এ প্রকল্পগুলোর জন্য সরকারকে সুদসহ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করার দায়বদ্ধতা আছে।

সরকার ইতিমধ্যে ১০০ পণ্য এবং সেবার ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। সরকারকে এই বৃদ্ধির জন্য সুপারিশ করেছে আইএমএফ। প্রাক্কলন অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে কর আহরণে বিশাল ঘাটতি রয়েছে। সরকারের কর আহরণ ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। এনবিআরকে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান বিবেচনা করে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করা, দক্ষতা বৃদ্ধি করা জরুরি। সরকারকে অবশ্যই জিডিপি কর অনুপাত বাড়াতে হবে। বিশাল জনগোষ্ঠী যারা কর কাঠামোর বাইরে রয়েছে তাদের করের আওতায় আনতে হবে। নানা প্রণোদনা দিয়ে রফতানি বহুমুখীকরণ করতে হবে। স্বল্পশিক্ষিত শ্রমিকদের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সার্টিফিকেট প্রদান করে বিদেশে পাঠালে রেমিট্যান্স অনেক বৃদ্ধি পাবে। রেমিট্যান্স এবং রফতানি আয় বৈধ পথে দেশে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

কোনো রাজনৈতিক সরকার এ কাজগুলো খুব সহজে করতে পারবে বলে মনে হয় না। কাজগুলো শুরু করতে হবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই। ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সরকারগুলোর জন্য সংস্কারের একটি পথনকশা যেতে হবে। প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের প্রতিটি স্তরে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পরিহার এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত থাকবে। জনগণের অবগতির তথ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কাজগুলো জটিল, সহজ সমাধান নেই। সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আর্থিক শৃঙ্খলা সৃষ্টি না হলে ঋণের বোঝা দীর্ঘদিন জাতিকে বহন করতে হবে।

শেয়ার করুন