৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ১০:১৪:৩৭ পূর্বাহ্ন


শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসনে ব্যর্থ মোদি
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-০২-২০২৫
শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসনে ব্যর্থ মোদি যুক্তরাষ্ট্রে নরেন্দ্র মোদিকে স্বাগত জানিয়ে আওয়ামী লীগের ব্যানার


শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসনের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি, সেটা ভেস্তে গেছে। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর থেকেই আত্মবিশ্বাসী হয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন কখন আসবে ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এলোও! কিন্তু সবই হলো, সবই শুনলেন ট্রাম্প। কিন্তু পাত্তাই দিলেন না শেখ হাসিনা ইস্যু। শুধু ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করেই ক্ষ্যান্ত হননি তিনি। কথা হয় তার যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উপদেষ্টাসহ আরো অনেকের সঙ্গে। এর মধ্যে রয়েছেন ইলন মাস্কও। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির চেহারা ও সাক্ষাৎ পরবর্তী যেসব আচরণ হচ্ছে ভারতের সঙ্গে, তাতে অন্তত হাসিনা ইস্যু আমলেই নেননি বলেই অনুমান করা যাচ্ছে। এর কারণও আছে বেশ কিছু। একজন পরাজিত, একজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গণহত্যাকারী, একজন স্বৈরশাসক, একজন গুম-খুন ও নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত, একজন কোটি কোটি ডলার লুটপাট ও পাচারকারীর পক্ষ কেউ কী নেবে? নেবে না। ট্রাম্প হাসিনার এসব অপকর্ম জানেন না বলে ভুল হবে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট। আন্তর্জাতিক মিডিয়া এরপর জাতিসংঘের মানবাধিকার কর্তৃক ঘোষিত অপরাধীর পক্ষ নিয়ে ট্রাম্প তার নিজের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, নিজের কালচার ও গতিপথ বিতর্কিত করবেন-এটা ভাবা ভুল। 

নরেন্দ্র মোদি নিজেও গুজরাটের নানা অপকর্মের দায়ে দণ্ডিত। ট্রাম্প এরপরও তার সঙ্গে মোদির সম্পর্ক রেখেছেন, এটা তার বিজনেস পলিসি। প্রায় ১৪০ কোটি মানুষের দেশের সঙ্গে তার অনেক বিজনেস। ফলে তিনি কেনই-বা তার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য হাতছাড়া করবেন। সম্পর্কটা সেজন্যই। 

কেন মার খেলো মোদির এ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু 

একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশন বাংলাদেশে জুলাইয়ের গণহত্যার রিপোর্ট কখন প্রকাশ করেছিল। ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন, ঠিক এমন মুহূর্তে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বিশাল আকারের অভিযোগ সংবলতি জুলাই গণহত্যার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে এবং সেখানে কে কে অভিযুক্ত, কীভাবে তার সবিস্তার বর্ণনা করেছেন। ১ হাজার ৪০০ প্লাস হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তা কার কোন ধরনের অস্ত্র থেকে করা গুলিতে হয়েছে, এর নির্দেশতাদা কে-সবই রয়েছে। মোটকথা, এ হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা একজনই, তিনি বাংলাদেশের বিতাড়িত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং এটা তিনি করেছেন, তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এর সঙ্গে দ্বিমতের সুযোগ নেই। তাছাড়া গণহত্যার পর প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরই ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাকে তদন্তের আহ্বান জানান। জাতিসংঘও রাজি হয় এবং তদন্তে টিম আসে। যারা দীর্ঘসময় ধরে বিভিন্ন স্তরে নিখুঁত তদন্ত করে নিয়ে যান। কথা বলেন তারা বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে। কয়েক দফায় করা ওই তদন্ত দীর্ঘ প্রায় পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে তদন্ত করে যে রিপোর্ট তৈরি করেছেন সেটাই ঘোষণা করেন জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশন। যার সূচনা বক্তব্য দেন ভলকার টার্ক। যাতে তিনি এসবের নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা অভিযুক্ত। একই সঙ্গে সেখানে সবিস্তারে কীভাবে দেশের নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখতে বিভিন্ন সংস্থার লোককে বাধ্য করে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ বিরোধীদের হত্যা, গুম, খুন, নির্যাতন করে আসছেন তার বর্ণনা রয়েছে প্রমাণসহ।

নরেন্দ্র মোদিও বিশ্বের অন্যতম এক প্রভাবশালী দেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনিও শেখ হাসিনার জন্য পারতেন কিছু করতে। সে চিন্তাধারা থেকেই ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ইস্যুতে টানাপড়েনের মধ্যেও এক ফাঁকে বাংলাদেশ ও হাসিনা প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, তার এ ইস্যু ভীষণভাবে মার খেয়েছে। তাছাড়া মোদি তার অন্যসব বন্ধু যেমন-ইউরোপসহ পশ্চিমা অন্যসব দেশ, রাশিয়াসহ অন্যরা তাদেরও তিনি ধীরে ধীরে বোঝানোর হয়তো চেষ্টা করে শেখ হাসিনা সম্পর্কে একটা পজিটিভ ধারণা তৈরি করতে হয়তো পারতেন। কিন্তু এ ইস্যু মাঠে মারা গেছে। জাতিসংঘ এমন একসময় এমন সবিস্তারে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, এরপর শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের পক্ষে কোনো দেশ, কোনো ব্যক্তি দাঁড়ানোর অর্থ তিনিও এসব গুম-খুন, গণহত্যা সাপোর্ট করেন। এতে ওই ব্যক্তি, সংস্থা, দেশ ভীষণভাবে ইমেজ সংকটে পড়বে। বিতর্কিত হয়ে পড়বে।

কেন নরেন্দ্র মোদি এসব করছেন 

গণঅভ্যুত্থানে পরাস্ত শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দিয়ে শেখ হাসিনা থেকে দীর্ঘ ১৬ বছর সেসব সুবিধা ভারত, তথা নরেন্দ্র মোদি আদায় করে নিয়েছেন তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাৎক্ষণিক এ কাজটুকু তিনি ভেবেচিন্তেই হোক আর না ভেবেই হোক করে ফেলেছেন। ভেবেছিলেন, পরে নিজের পলিসি মোতাবেক সব ঠিক করবেন। কিন্তু এখানে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেবেন, এমনকি ইউনূস যে তার চেয়েও বড় আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়, সেটা তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। একজন নোবেলজয়ী, উনি আর কতটা বড় খেলোয়াড় হবেন। ওটা আগেই মেপে রেখেছিলেন। কিন্তু সেটা ছিল তাদের ভুল ধারণা। জুলাই অভ্যুত্থানের সবটাই ইউনূস কাজে লাগিয়েছেন তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার, বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা তুঙ্গে নেওয়া, দেশের মানুষের বিপদে সাহায্যের হাত ধরা, এমনকি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দেশের সব ক্ষেত্রে যে সিস্টেম্যাটিক চলার স্থানে একটি স্বৈরতন্ত্র বিরাজ করছিল, সেখান থেকে শৃঙ্খলায় ফেরানো, সে যাত্রায় তিনি সফল হয়েছেন এবং হচ্ছেন। আন্তর্জাতিক মহল তার এ আন্তরিকতা দেখছেন এবং প্রায় প্রতিটি দেশ তার কর্তৃক বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও উন্নতির জন্য সহযোগিতার যে আশ্বাস দিয়েছে, এর প্রতিটা মুহূর্ত শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগের জন্য ভীষণ রকম অস্বস্তি তৈরি করে ফেলেছে। মোদি সেখানেই মার খেয়ে বসে আছে। 

ভারতের পররাষ্ট্রসচিব ব্রিফিংয়ে বলেছেন যে, বাংলাদেশে ভারতের উদ্বেগের বিষয়টি ট্রাম্প ও তার প্রশাসনকে তারা জানিয়েছেন। ফলে মোদির এ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ইস্যুতে যে ‘বাংলাদেশ, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ’ খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা প্রমাণিত। 

ইলন মাস্ক ড. ইউনূস কথোপকথন 

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় ছিল শেখ হাসিনা ইস্যুতে মোদি যখন কথা বলছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তার সঙ্গে। ঠিক তখন ড. ইউনূসের সঙ্গে টেলিফোনে বা ভিডিও কলে কথা হয় ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহচর ইলন মাস্কের সঙ্গে। সেখানে ইলন মাস্ককে বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানান। মাস্কও সে আমন্ত্রণ শুধু গ্রহণই করেননি, বলেছেন আমি এমন এক সফরের জন্য অপেক্ষাও করছিলাম। একই সঙ্গে বাংলাদেশ তার স্টারলিংক স্যাটেলাইটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইন্টারনেট জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার ইউনূসের প্রস্তাবকে তিনি সানন্দে গ্রহণ করেছেন। এ বিষয় তারা খুব শিগগিরই আলোচনা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন যা বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের মানুষের জন্য হবে এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যার মাধ্যমে লাখ লাখ ডলার ইনকাম করতে সক্ষম হবেন বাংলাদেশের তরুণসমাজ ইন্টারনেটভিত্তিক চাকরি, ব্যবসা করার মাধ্যমে। 

ফলে একদিকে মোদির অভিযোগের ঝুলি থেকে এক এক বের করছেন যুক্তরাষ্ট্রের যেসব কর্মকর্তার সম্মুখে, আরেকদিকে সেসব কর্মকর্তা এসব অভিযোগ না শোনার ভান করে উল্টা বাংলাদেশ, ড. ইউনূসের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো ও ব্যবসার জন্য ছুটছেন। বিষয়টি তাহলে কী দাঁড়ালো? 

শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি কঠিন অবস্থায় 

একটা দলের কতটা দুর্গতি হলে আরেকটা দেশের প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে তৃতীয় দেশে স্বাগত জানিয়ে প্ল্যাকার্ড প্রদর্শনের মাধ্যমে মিছিল করতে পারে! ঘটনা ওয়াশিংটনে। মোদির সফরকালে ভারতের এ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের জন্য সুপারিশ করবেন-এ নিমিত্তে ওয়াশিংটনে সেখানকার আওয়ামী লীগ ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে মিছিল করে। আওয়ামী লীগ স্বাগত জানায় নরেন্দ্র মোদিকে এক ফেস্টুনে, আরেক ফেস্টুনে দেখা যায় ইউনূসের পদত্যাগের। 

জুলাই অভ্যুত্থানে যে ম্যাসাকার হয়েছে, সেটা দেখেছে বিশ্ববাসী। জাতিসংঘ কর্তৃক এ গণহত্যা স্বীকৃত ও এতে অভিযুক্তদের দলিলাদিসহ প্রকাশ পাওয়ার পর বাংলাদেশে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অবস্থান অনিশ্চয়তার মেঘে ঢাকা পেড়েছে। শুধু শেখ হাসিনাই নয়, দল হিসেবে আওয়ামী লীগও অভিযুক্ত। বাংলাদেশে জুলাই আন্দোলনের পর অদ্যাবধি কোটি কোটি সমর্থকের আওয়ামী লীগের নামও উচ্চারণ কেউ করছেন না, প্রচার নেই। মাঠেও নেতাকর্মীরা গা ঢাকা দিয়ে চলছেন। এটা আওয়ামী লীগের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম একটি সময় অতিবাহিত হচ্ছে। শেখ হাসিনার বয়স ৭৫ প্লাস। তিনি রাজনীতি করতে বাংলাদেশে আসবেন কি, আসবেন না বা ভারত তাকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের হাতে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর দায়ে বিচারের কাঠগড়ায় তুলতে দেবে কি না, সেটা নিতান্ত ভারতের ইচ্ছা। তবে এসব বেড়াজাল পেরিয়ে শেখ হাসিনা আবারও রাজনীতির মাঠে নামবেন, সেটা প্রায় অসম্ভব একটি বিষয়। মোদি কিছু একটা করতে পারতেন, সে চেষ্টায়ও তিনি করে ব্যর্থ। পরবর্তী সময়ে এমন কোনো অবস্থা তৈরি করতে পারবেন কি বা আদৌ করবে কি না সেটা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। ততক্ষণ শেখ হাসিনারও শক্তি, সাহস, সামর্থ্য থাকবে কি না, সেটাও দেখার বিষয়। সব মিলিয়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এই নেত্রী। 

দল হিসেবে আওয়ামী লীগও তোপের মুখে। শেখ হাসিনা ছাড়াও দলের ৯৫ শতাংশ শীর্ষনেতা অভিযুক্ত কোনো না কোনোভাবে। হয়তো হত্যা মামলা, অর্থ লোপাট, অর্থ পাচার, দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি, গুম, খুন, নির্যাতন-কোনো না কোনো ইস্যুতেই। ফলে এরা তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ খণ্ডিয়ে আবার রাজনীতির মাঠে নামবেন কবে, সে প্রশ্ন খোদ এখন আওয়ামী লীগের তৃণমূলে। 

সবশেষ

সব দিন এক রকম যায় না। দিন আসে, দিন যায়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এ তত্ত্বটা খুব ব্যবহার করছে এ সময়ে। বাংলাদেশের মানুষও খুব সহসাই ভুলে যান সবকিছু। কিন্তু শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ যে তরুণসমাজকে তছনছ করে রেখে গেছেন, ম্যাসাকার করেছেন, তারা পাঠ্যবই রেখে এখন রাজনীতির মাঠে। ড. ইউনূস এ ছাত্র ও তরুণসমাজকে শেখাচ্ছেন দেশ গঠনে এগিয়ে আসার গল্প। এটা ভীতিকর আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য। যারা প্রতিনিয়ত দাবি করে আসছে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের, তাদের সামনে কীভাবে মাঠে নামবে নিষিদ্ধ হওয়া ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ, সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। 

শেয়ার করুন