১৯ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার, ০৪:১৫:৪৩ পূর্বাহ্ন


অভিবাসী নির্বাসনে যুদ্ধকালীন আইন ব্যবহারের অনুমতি পেলেন ট্রাম্প
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৪-২০২৫
অভিবাসী নির্বাসনে যুদ্ধকালীন আইন ব্যবহারের অনুমতি পেলেন ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট


যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট গত ৭ এপ্রিল রাতে ট্রাম্প প্রশাসনের অনুরোধ মঞ্জুর করে এলিয়েন এনিমিস অ্যাক্ট ব্যবহারের ওপর নিম্ন আদালতের একটি সাময়িক নিষেধাজ্ঞা (টিআরও) তুলে দিয়েছে, এবং এই আইনের মাধ্যমে ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের বহিষ্কার পুনরায় শুরু করার অনুমতি দিয়েছে। অর্থ্যাৎ ফেডারেল কোর্ট ট্রাম্প প্রশাসনকে অভিবাসী নির্বাসনে যুদ্ধাকালীন আইন ব্যবহারের অনুমতি দিলো। তবে রায়ে বলা হয়েছে যে, এই আইনের আওতায় বহিষ্কৃত ব্যক্তিরা তাদের বহিষ্কারের বিরুদ্ধে আইনি চ্যালেঞ্জ করার অধিকার পাবে এবং তারা এই আইনটির ব্যাখ্যা ও সাংবিধানিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে। কোর্টের আদেশের সাথে সাথেই এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য একটি বিজয় হলেও রায়টি ওই আইনটির সাংবিধানিকতা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি এবং মূলত একটি প্রক্রিয়াগত সিদ্ধান্ত ছিল, যেখানে কোর্ট বলেছে যে অভিবাসীদের আইনগত লড়াই ভুল আদালতে শুরু করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের মামলা টেক্সাসে দায়ের করা উচিত ছিল, যেখানে তারা আটক রয়েছেন, কিন্তু তারা ভুলভাবে ওয়াশিংটন আদালতে মামলা করেছিলেন। কোর্টের মতে, অভিবাসীদের তাদের বহিষ্কারের বিরুদ্ধে আইনি চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ দেওয়া উচিত এবং এই প্রক্রিয়া অবশ্যই যথাযথ সময়ে শুরু হতে হবে।

এই রায়ের মাধ্যমে, সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের তাদের বহিষ্কারের নোটিশ প্রদান করা হবে এবং তাদের একটি যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে নিজেদের আইনি অধিকার চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ দেওয়া হবে। তবে, কোর্ট বলেছে যে, এই চ্যালেঞ্জটি টেক্সাসে করা উচিত, যেখানে অভিবাসীরা আটক রয়েছেন, ওয়াশিংটন আদালতে নয়।

রায়ে বিভক্তিতা

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে, ৬-৩ ভোটে অধিকাংশ বিচারপতি ট্রাম্প প্রশাসনের এলিয়েন এনিমিস অ্যাক্ট ব্যবহারের ওপর থেকে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছেন। তবে বিচারপতি সোনিয়া সোটোমায়র, এলেনা কাগান এবং কেটাঞ্জি ব্রাউন জ্যাকসন এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে মত দেন। রায়টি মূলত একটি প্রক্রিয়াগত সিদ্ধান্ত ছিল, যেখানে কোর্ট বলেছে যে অভিবাসীদের মামলা ভুল আদালতে দায়ের করা হয়েছে এবং তাদের উচিত ছিল টেক্সাসে মামলা দায়ের করা। যদিও কোর্ট সরকারের ক্ষমতা নিয়ে মন্তব্য করেনি, তবে এটি নিশ্চিত করেছে যে, যাদের বিরুদ্ধে বহিষ্কারের আদেশ দেওয়া হবে, তারা আইনি চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ পাবেন। এলিয়েন এনিমিস অ্যাক্ট ব্যবহারের পক্ষে রায় দেওয়ার বিচারপতির মধ্যে ছিলেন প্রধান বিচারপতি রবার্টস, বিচারপতি থমাস, বিচারপতি আলিটো, বিচারপতি গর্সুচ, বিচারপতি কাভানাহ এবং বিচারপতি ব্যারেট। অন্যদিকে বিপক্ষে রায় দেন বিচারপতি সোণিয়া সোটোমায়র, বিচারপতি এলেনা কাগান, এবং বিচারপতি কেটাঞ্জি ব্রাউন জ্যাকসন।

বিচারপতি সোনিয়া সোটোমায়র তার অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, কোর্ট প্রশাসনকে অতিরিক্ত সুবিধা দিয়েছে, কিন্তু যদি অভিবাসীরা এল সালভাদরে ভুলভাবে বহিষ্কৃত হন, তাদের যে মারাত্মক ক্ষতি হবে তা উপেক্ষা করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কোর্ট সরকারের ক্ষমতাকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করে আইনের শাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিচারপতি অ্যামি কনি ব্যারেট এই আপত্তির কিছু অংশে যোগ দিয়েছেন।

বিচারপতি কেটাঞ্জি ব্রাউন জ্যাকসন তার পৃথক আপত্তিতে বলেন, আজকের রায় অতীতে যেমন ভুল ছিল, তেমনি এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি খারাপ নজির তৈরি করবে। তিনি ’কোরেমাতসু বনাম যুক্তরাষ্ট্র’ মামলার উদাহরণ দিয়ে বলেন, এই ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত ইতিহাসের পাতায় অমোচনীয় ক্ষতি তৈরি করেছে। আজকের কোর্টের সিদ্ধান্ত অতীতে কোরেমাতসু বনাম যুক্তরাষ্ট্র মামলার মতো ভুল হতে পারে, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি আমেরিকানদের বন্দি শিবিরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, যত বেশি সময় আমাদের গুরুত্বপূর্ণ রায়গুলো অস্থায়ী দস্তাবেজে দেওয়া হচ্ছে, তত বেশি এটি ভবিষ্যতের জন্য খারাপ নজির হয়ে দাঁড়াবে।

এছাড়া বিচারপতি এলেনা কাগান তার আপত্তিতে রায়টির প্রক্রিয়াগত ত্রুটির কথা তুলে ধরে বলেন, কোর্ট এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা অভিবাসীদের মৌলিক অধিকারকে উপেক্ষা করছে।

ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া

ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট আমাদের জাতির আইনের শাসনকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং একটি প্রেসিডেন্টের, যে কেউ হোক না কেন, সীমান্ত সুরক্ষিত করা এবং আমাদের দেশ এবং পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করার অধিকার নিশ্চিত করেছে। এটি আমেরিকায় একটি মহান দিন।

এল সালভাদরের বন্দিশিবিরে ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের পাঠানো

যে ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের এল সালভাদরে পাঠানো হয়েছিল, তাদেরকে এমন এক কারাগারে রাখা হয়েছে, যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অত্যাচারের ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। অঈখট এবং ডেমোক্রেসি ফরওয়ার্ড, যাদের আইনজীবীরা অভিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব করছেন, অভিযোগ করেছে যে ট্রাম্প প্রশাসন এই অভিবাসীদেরকে অনৈতিকভাবে বন্দিশিবিরে পাঠিয়ে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো ভঙ্গ করছে।

ভবিষ্যৎ আইনি লড়াই

অবশ্য রায়টি ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের আইনি লড়াইকে শেষ করেনি। তাদের এখন টেক্সাসে মামলা করতে হবে এবং এই প্রক্রিয়া ভবিষ্যতে আরো আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ)-এর আইনজীবী লি গেলার্ট বলেন, এটি আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয়, কারণ সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে বলেছে যে, তারা অভিবাসীদের তাদের আইনি অধিকার চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ দিতে হবে।

আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ), ডেমোক্রেসি ফরওয়ার্ড এবং ডিস্ট্র্রিক্ট অব কলাম্বিয়া শাখার এসিএলইউ এই মামলাটি পরিচালনা করছে, যেখানে ট্রাম্প প্রশাসনের এলিয়েন এনিমিস অ্যাক্ট ব্যবহার স্থগিত করার জন্য মামলা করা হয়েছিল। ২৬ মার্চ, ফেডারেল আপিল কোর্ট প্রশাসনের অনুরোধ খারিজ করে দেওয়ার পর ট্রাম্প প্রশাসন সুপ্রিম কোর্টের কাছে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আবেদন করে। সুপ্রিম কোর্ট ৭ এপ্রিল রাতে ঘোষণা করেছে যে, এটি শুধু স্থানীয় আদালতের বিষয় ছিল, কারণ মামলাটি ডিস্ট্র্রিক্ট অব কলাম্বিয়ায় দায়ের করা হয়েছিল, যেখানে আটক রাখার স্থান নয়। তবে কোর্ট এটি স্পষ্ট করেছে যে, এলিয়েন এনিমিস অ্যাক্টের আওতায় যারা বহিষ্কৃত হবেন, তাদের যথাযথ সময়ের মধ্যে নোটিশ দেওয়া হবে এবং তারা তাদের বহিষ্কারের বিরুদ্ধে আইনি চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন।

যদিও ট্রাম্প প্রশাসন এই আইনের আওতায় দ্রুত বহিষ্কার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, এর মধ্যে অনেক ভেনেজুয়েলান অভিবাসীকে ভুলভাবে গ্যাং সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, বিশেষত তাদের ট্যাটু ভিত্তিতে। এসিএলইউ এবং ডেমোক্রেসি ফরওয়ার্ড জানিয়েছে, ১৫ মার্চের ফ্লাইটে যারা এল সালভাদরে পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে অনেকেই এই গ্যাংয়ের সদস্য নন, তবে শুধু তাদের শরীরের ট্যাটুর কারণে তাদের গ্যাং সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের ইমিগ্র্যান্ট রাইটস প্রজেক্টের ডেপুটি ডিরেক্টর এবং প্রধান আইনজীবী লি গেলার্ট বলেন, এই রায়টি নিশ্চিত করেছে যে, এলিয়েন এনিমিস অ্যাক্টের আওতায় যারা বহিষ্কৃত হবেন, তাদেরকে আইনি প্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ করার অধিকার দেওয়া হবে, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয়।ডেমোক্রেসি ফরওয়ার্ডের প্রেসিডেন্ট এবং সিইও স্কাই পেরম্যান বলেন, আজকের রায় আমাদের দীর্ঘদিনের অভিমতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে: ট্রাম্প প্রশাসন অবৈধভাবে এদের বহিষ্কার করেছে এবং আমরা আমাদের আইনি উপায় অব্যাহত রাখবো।

এছাড়া আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন অব ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার আইন পরিচালক স্কট মাইকেলম্যান বলেন, কোনো প্রেসিডেন্টই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। ট্রাম্পের এই শতাব্দী প্রাচীন যুদ্ধকালীন আইনের অপব্যবহার একটি বিপজ্জনক এবং অবৈধ ক্ষমতার অপব্যবহার, যা সকলের মৌলিক নাগরিক অধিকারকে হুমকির মুখে ফেলছে। এখন সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের মাধ্যমে প্রশাসনকে কেবল আইনি প্রক্রিয়া মেনে চলার জন্য বাধ্য করা হয়েছে, তবে এটাও স্পষ্ট যে, এই আইনি লড়াইয়ের পথ খোলা থাকবে এবং এটি ভবিষ্যতে আরও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠনগুলো এখনো এ আইনের সাংবিধানিকতা ও প্রয়োগ নিয়ে আরো আইনি লড়াই চালিয়ে যাবে।

জরুরি মামলা দায়ের

যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক স্বাধীনতা সংস্থা (এসিএলইউ) এবং নিউ ইয়র্ক সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন, একযোগে লিগ্যাল এইড সোসাইটির সাথে, যারা তাদের ক্লায়েন্টদের পক্ষে মামলায় আবেদন করেছে, গত ৮ এপ্রিল মঙ্গলবার সকালে নিউ ইয়র্কে ফেডারেল আদালতে এলিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট অভিবাসীদের নির্বাসন স্থগিত করতে একটি জরুরি মামলা দায়ের করেছে। এই পদক্ষেপটি যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের গত ৭ এপ্রিল রাতে দেওয়া রায়ের পর নেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ন্যাশনাল অস্থায়ী আদেশ তুলে নেওয়া হয়েছে। সেই রায়ে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এলিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট ব্যবহার করার চ্যালেঞ্জকে অনুমোদন দেওয়া হয়।

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়েছে যে, যারা এই আইনের আওতায় নির্বাসনের জন্য টার্গেট হয়েছেন, তাদেরকে তাদের নির্বাসন চ্যালেঞ্জ করার অধিকার রয়েছে এবং তাদেরকে এর জন্য যথাযথভাবে অবহিত করতে হবে এবং উপযুক্ত সুযোগ দেওয়া হবে।

শেয়ার করুন