যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের ‘আমব্রেলা খ্যাত সংগঠন’ ‘বাংলাদেশ সোসাইটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংগঠনটির নিয়ন্ত্রণ অভিবাসীদের স্বর্গরাজ্য খ্যাত নিউইয়র্কে বসবসাকারি বাংলাদেশিদের হাতে। অন্যান্য রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব বলতে গেলে তেমন একটা নেই। তবে, নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের গ্রহণযোগ্যতা-কদর কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পায়। যেমন-প্রতি দুই বছর অন্তর বাংলাদেশ সোসাইটির ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়। এ সময়টিতে নিউইয়র্কের বাইরের অভিবাসীরাও সম্পৃক্ত হন। যদিও তা ভোটারদের নিজ উদ্যোগে নয়! নিবন্ধিত ভোটার তালিকা প্রণয়নে ‘সম্ভাব্য প্যানেল ও প্রার্থীরা’ স্ব স্ব উদ্যোগে মাঠে নামেন। লক্ষ্য একটাই। নিজেদের ভোটব্যাংক সংখ্যা বৃদ্ধি করা। এ যেন এক অসম প্রতিযোগিতা। কোন প্যানেল কত সংখ্যক ভোটার নিবন্ধিত করতে পারছেন; সেটির ওপরই নির্ভর করে সোসাইটির পরবর্তী নেতৃত্ব কাদের হাতে! এ ধরনের পদ্ধতি নিয়েও রয়েছে মিশ্র-প্রতিক্রিয়া।
পাঠক-বাংলাদেশ সোসাইটির আগামী নির্বাচন সংক্রান্ত আমার একান্তই ব্যক্তিগত মতামত ও উপলব্ধির খানিকটা তুলে ধরার চেষ্টা কেবল। যা নিম্নরূপ:
এক. ভোটার নিবন্ধ প্রক্রিয়া:
২০ ডলার (বাংলাদেশিরা কথার ছলে ‘ডলারকে’ টাকা বলে থাকেন)। সেই ২০ টাকায় ভোটার নিবন্ধন। হালনাগাদ তালিকা প্রতিবারই অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। নিম্নের এই পরিসংখ্যানটি ২০১৮ সালের। ওই সময়ে ভোটার তালিকা প্রণয়নকে কেন্দ্র করে সোসাইটি নির্বাচন স্থগিত ছিল। ছিল মামলা মকদ্দমাও। ওই সময়ে নিবন্ধিত ভোটার সাড়ে ২৭ হাজারের বেশি ছিল। যাতে বাংলাদেশ সোসাইটির কোষাগার বেশ অর্থ শক্তিশালী হয়েছে।
সবশেষ তথ্যে ২০২৪ সালের নিবন্ধিত ভোটার তালিকা ও সংগৃহীত অর্থ বেশ।
এর আগে ২০১৮ সালে ভোটার নিবন্ধন নির্ভর অর্থের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৩৬ হাজার ৪৬০ ডলার। যেখানে ২৭ হাজার ভোটারের মধ্যে ৪৮৮ জন হচ্ছেন আজীবন সদস্য। তারাও ভোটার। সাধারণ ভোটার নিবন্ধিত করা হয়েছে ২০ ডলারের বিনিময়ে। আর জীবন সদস্য ফি ৫০০ ডলার। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ সোসাইটির অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বেশ মোটাসোটা। কমিউনিটির জনমনে প্রশ্ন- স্বাস্থ্যবান এ সোসাইটির তহবিল কীভাবে খরচ হচ্ছে? এতে কমিউনিটিরই কতটুকু উপকারে আসছে?
এবারের ২০২৪ সালের নির্বাচনকে ঘিরেও একই চিত্র লক্ষ করা যায়। এ প্রক্রিয়ায় প্রবাসীরা বাংলাদেশ সোসাইটিতে পরবর্তী দু’বছরের জন্য তাদের প্রতিনিধিত্ব নির্বাচিত করে যাচ্ছেন। বিনিময়ে কি পেয়েছেন কিংবা পাচ্ছেন; সেটা দেখার কেউ নেই। কারণ একটাই। ওইসব নিবন্ধিত ভোটাররাও ছিলেন ২০ (ডলার) টাকার। যাদের এই নিবন্ধন প্রক্রিয়া ছিল না কোন সরাসরি অংশগ্রহণ। স্বদিচ্ছার অভাও বলা যায়।
দুই. নির্বাচন কমিশন গঠন
বাংলাদেশ সোসাইটির এবারের নির্বাচন চলতি মাসের ২৭ অক্টোবর। তার আগেই নির্বাচন কমিশন গঠন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ চূড়ান্ত করা হয়। যা সম্পাদন করে থাকে বর্তমান-সবশেষ কার্যনির্বাহী কমিটি। এরপর নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন গঠিত কমিশন কর্মকর্তারা। ঘোষিত হয় নির্বাচনী তফসিল। যার মধ্যে, সম্ভাব্য প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র উত্তোলন, জমা দেওয়া, যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা। এতোসব আয়োজন এরই মধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। এখন কেবল প্রতিনিধি নির্বাচনে বাকি। বরাবরের মতো এবারো নিউইয়র্ক সিটির পাঁচটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করা হবে। এসব তথ্য কমিউনিটির সবার জানা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এতোসব আয়োজনের ফলাফলটা আসলে কি?
তিন. মিলিয়ন ডলার ব্যয়ের নির্বাচন
বাংলাদেশ সোসাইটির কার্যনির্বাহী পরিষদ নির্বাচনে ১৯ টি পদের বিপরীতে দুটি প্যানেল এখন মাঠে সরব। নমিনেশন বিক্রি করেও নির্বাচন কমিশনের আয় বড় অঙ্কের। ফলে বলা যায়, গঠিত এ নির্বাচন কমিশন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল একটি কমিশন। ভাবা যায়! এসব অর্থ ব্যয় হবে, বাংলাদেশ সোসাইটির আসন্ন নির্বাচনে। মানে মিলিয়ন-ডলারের বেশি ব্যয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে প্রবাসীদের আমব্রেলা খ্যাত এ সংগঠনটির এবারের নির্বাচন।
চার. ভোটার নিবন্ধন প্রক্রিয়া
শিরোনামেই বলা আছে, ‘বিশ টাকার (ডলারের) কাছে ‘বিবেক-বিক্রি’! প্রতি বছর গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পায় রেকর্ডসংখ্যক ভোটার। প্রার্থীদের অর্থে ভোটার হওয়া এ আমাদের অবস্থানও তাই অতটা স্বচ্ছ নয়। তবে যারা কর্মজীবী, তাদের কেউ কেউ ওইদিনের মাইনে থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ঠিকই। বিনিয়ময়ে ২০ ডলারের কাছে বিক্রি করেছেন নিজের বিবেক। প্রতিটি নির্বাচন ঘিরে সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে নামেন। উদ্দেশ্য একটাই; কে কত জন ভোটার বানাবেন। এ প্রতিযোগিতা চলে মাসজুড়ে। হোটেল-রেস্টুরেন্ট কিংবা কমিউনিটির আড্ডায় চলে একই বিষয়। চলতে থাকে পরিচিত আর আপনজনদের তালিকা চূড়ান্ত করা। মুঠোফোনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ আর মোবাইল নম্বর। ব্যস! ভোটার ফরম পূরণ সম্পন্ন!! অনেকে আবার জানেনই না যে, তিনি ভোটার!!!
পাঁচ. প্রার্থীর নিরলস প্রচার-প্রচারণা
আগামী ২৭ অক্টোবরের জন্য প্রস্তুত সবাই। নির্বাচনের দিন, কিংবা আগের দিন পর্যন্ত চলে প্রার্থী আর ভোটারদের মধ্যে কুশলবিনিময়। সেই সঙ্গে চলে পরিচিতি সভা। যাতে থাকে নির্বাচনী ওয়াদা পূরণের নানা ফিরিস্তি। সংশ্লিষ্টদের ভরসা হচ্ছে, পরিচিতজন। এছাড়া প্যানেলকেন্দ্রিক মাঠে সক্রিয় থাকা প্রতিনিধি/আঞ্চলিক/সামাজিক সংগঠনের নেতারা। যারা ওই ভোটারকে মনে করিয়ে দেন, ‘আপনি ভোটার’। ভাই অমুক দিন ভোট। যেহেতু তিনি টাকা খরচ করেননি; তাই প্রশ্ন করেন, কাকে ভোট দেবো? এভাবেই বিক্রি হয়ে যায় বিবেক! যার মাধ্যমে ভোটার হয়েছেন; তিনি তার পছন্দের প্রার্থী ও প্যানেলের কথা বলেন। সম্ভব হলে পরিচয় করিয়ে দিতেও প্রস্তুত থাকেন। এতেই খুশি আমরা। এই হচ্ছে রেকর্ড ভোটার নিবন্ধন’র ফসল। তবে, ভোটগ্রহণ ও নিবন্ধন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা প্রশ্নে, আদালতের দ্বারস্থ হন কেউ কেউ। চ্যালেঞ্জের মুখে কয়েকবার স্থগিত ছিল নির্বাচনও।
ছয়. কমিউনিটির দায়বদ্ধতা
অবশেষ এলো নির্বাচনের দিন। আমাদের মতো অনেকেই প্রস্তুত। ‘বিনে পুঁজির’ ভোটাররা কেবল অপেক্ষায় থাকি। বড় ধরনের ব্যস্ততা না থাকলে, খুদে বার্তায় কিংবা মুঠোফোনে অডিও বার্তায় আমরা তথ্য পাই। চলে যাই সবচেয়ে কাছের নির্ধারিত কেন্দ্রে। প্রয়োগ করি নির্ধারিত-নিবন্ধিত ভোটাধিকার। বস্তুত আমরা প্রকৃত প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে পারি কি? আমার মনে হয় ‘না’। ফলে- সোসাইটিতে ঘুরেফিরে একই মুখের প্রতিনিধিত্ব। অভিযোগ আছে, সবখানেই রয়েছে ‘প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের’ আনাগোনা। কথিত আছে, প্যানেল গঠনের সঙ্গে গোপন গঠন হয় তথাকথিত ট্রাস্টি বোর্ড সদস্য বানানোর প্রক্রিয়া। যে ট্রাস্টি বোর্ড সদস্যপদ নিয়ে অতীতের প্যানেল প্রতিনিধিরা মুখ ফিরিয়ে চলে যান অন্য প্যানেলে। এভাবেই কথিত কমিউনিটি নেতাদের ভোল পাল্টানোর সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ অব্যহত থাকে।
এছাড়া আঞ্চলিকতা, স্বজনপ্রীতি আর নানা কথার ছড়াছড়ি। অনেকে সিন্ডিকেট নেতারাই নাকি নির্ধারণ করেন; প্যানেল ও প্রার্থীদের পদ। সব কিছু মিলে পরবর্তী দুই বছরের জন্য যাদের আমরা নির্বাচন করি। এতে ব্যয় হয় ‘মিলিয়ন ডলার’। প্রিন্ট হয় নিয়মিত প্রকাশিত কমিউনিটির প্রায় সবগুলো পত্রিকার পাতা। ছাপা হয় ‘ভি-চিহ্নের’ জয়ধ্বনির ছবি। এটুকুনই আমাদের অর্জন। আবার অনেক গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরাও সোসাইটির প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ঠিকই; কিন্তু তাদের নিয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগ বিস্তর। যেমন-‘কোনো কোনো সংবাদকর্মী কিংবা কর্তাব্যক্তিরা স্বচ্ছ ভোটার তালিকা প্রণয়নে সম্পৃক্ত নন। কেবল প্যানেলভিত্তিক সংবাদ সম্মেলনে অংশগ্রহণ, দু-একটা প্রশ্ন করা আর বিজ্ঞাপন, শুভেচ্ছা ছাপানোতেই সীমাবদ্ধ।’ এসব কথা আমাকেও শুনতে হয়েছে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে। তাদের মতে, ‘সাংবাদিকরা যদি স্বচ্ছভাবে সোসাইটির ভালো কর্মে যুক্ত থাকতেন, তাহলে কিছুটা হলেও অনিয়ম বন্ধ হতো।’ একজন তো বলে বসলেন, ‘কেবল আমরা বিনে পয়সা ভোটার হয়নি, আপনারাও এই তালিকায়’!!
সাত. নির্বাচিত প্রতিনিধি
নির্বাচনের ক’দিন ধরে চলে সাপ্তাহিক পত্রিকার পাতায় বিজ্ঞাপন আর অভিনন্দনের পালা। এরপর শুরু হয় জয় পাওয়া নেতাদের অভিষেক পর্ব! সেখানেও মোটা অঙ্কের খরচ। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দায়িত্ব কেবল ‘একুশে পালন, সংশ্লিষ্ট একটি প্রকাশনা আর ইফতার পার্টি’ করা। তথ্য রয়েছে, কার্যনির্বাহী কমিটির কর্তাব্যক্তিরা ক’দিনের মাথায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। কর্মকর্তাদের ১৯ জন বনে যান কয়েক খণ্ডের প্রতিনিধি। সিদ্ধান্ত গ্রহণ আর আধিপত্য বিস্তারে যে পক্ষ যত শক্তিশালী; তারাই কেবল থাকেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। ফলে, ভোটের আগে দেওয়া নির্বাচনী ওয়াদা চলে যায় হিমঘরে। যা কখনো ফিরে আসে না আলোতে। যদিও নানা সামাজিক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হন সোসাইটির নেতারা। তাইতো ‘পুঁজিহীন ভোটে’ কেবল একদিনের ‘বিবেক বিক্রি’ করেই আমাদের (প্রবাসীদের) দায়িত্ব শেষ। বিনিময়ে বছরে একটি ইফতার পার্টি, ঘটা করে একুশে ফেব্রুয়ারি ও স্বাধীনতা দিবস পালন। আর বিজয় দিবস ও পহেলা বৈশাখ উদযাপনে তুষ্ট থাকেন সংশ্লিষ্টরা।
আট. বিভাজনের কর্মফল
প্রতি বছর এ একুশ পালন ঘিরেও আমরা বিভাজিত। ওখানে শুরু হয় কোন্দল। চলে (বিএনপি-আওয়ামী লীগের ক্ষমতার লড়াই)! দলীয় স্লোগান সংবলিত ব্যানার থাকে সবার আগে। অস্থায়ী শহিদ বেদিতে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন থাকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। পুরো আয়োজন সম্পন্নে সোসাইটির অর্থ ব্যয়ে নির্ধারিত। সঙ্গে আলাদা নিরাপত্তা ব্যবস্থাও রাখা হয়। এর মাঝেই ধাক্কাধাক্কিতে চলে ‘দেশ ও সংস্কৃতিপ্রেম’। যা দেখে ‘বাংলাদেশি আমেরিকান’ প্রজন্মের মাঝে ‘প্রশ্ন জাগে’- কী হচ্ছে এসব? আর কমিউিনিটি নির্ভর গণমাধ্যম কর্মী আমরা মুঠোফোন কিংবা সামাজিক মাধ্যমে লাইভে সম্প্রচারে ব্যস্ত থাকি। অনেকে জড়িয়ে পড়ি নিজ নিজ কর্মসম্পাদনে। পছন্দের-পক্ষের ব্যক্তির পুষ্পমাল্য অপর্ণের ছবি তোলাই সাংবাদিকদের ‘মহৎ কাজ’। পরবর্তী সপ্তাহের কাগজে যা ছাপা হবে! যাতে থাকবে ‘বিরতিহীন-পদবির-ক্যাপশন’ নির্ভর কমিউনিটি নেতার নাম।
স্বপ্নের সোনার হরিণের খোঁজে আসা এসব ‘ব্যতিব্যস্ত’ মানুষগুলোর দিনশেষে অর্জন কি? তা হচ্ছে, পত্রিকার পাতায় একটি সুন্দর ছবি। প্রচারণার আরেক মাধ্যম ফেসবুক তো রয়েছেই। এতেই তৃপ্ত আমার। যা যুক্তরাষ্ট্রের গণ্ডি পেরিয়ে ‘সাত সাগর তেরো নদীর’ ওপার বাংলায় পৌঁছে! পরিবার-পরিজনরা গর্বের সঙ্গে তা ‘পাড়া-মহল্লায়’ জানিয়ে দেন। বলেন, দেখেছো? আমার ‘ছেলেমেয়ের জামাই-কন্যা’ আজ কোথায় পৌঁছেছে!! যদিও, আমাদের প্রবাস জীবনের বাস্তব চিত্র সম্পর্কে স্বজন ও দেশোবাসী পুরোপুরি অন্ধকারে।
নয়. সংগঠনের আধিক্য
কমিউনিটির মাদার সংগঠন বলে বিবেচিত ‘বাংলাদেশ সোসাইটি’। এছাড়া নিউইয়র্কে নামে-বেনামে রয়েছে ‘অসংখ্য সংগঠন’। এ সংখ্যা প্রায় ‘চার শতাধিক’। যা বাংলাদেশের ইউনিয়ন পর্যায় শুরু করে জেলা ও বিভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত। এসব সামাজিক সংগঠনের মধ্যে ‘একই নামে’ রয়েছে ‘একাধিক’। বলতে পারি খুবই ‘শক্তিশালী বিভাজিত’ কমিউনিটি আমরা। না এ দায় শুধু কমিউনিটিরই নয়; অন্যদের-সবার। জাতির বিবেক বলতেও বিভাজন। কমিউনিটিনির্ভর গণমাধ্যমেরও একই চিত্র। সাংবাদিক সংগঠনগুলোতে বিভাজন চলমান। এছাড়া রয়েছে বেশ কয়েকটি ‘পুরস্কার/অ্যাওয়ার্ড/সম্মাননা’ নির্ভর প্রতিষ্ঠান। প্রশ্ন ওঠে, ‘কে দিচ্ছেন কার স্বীকৃতি?’ যাদের দৌরাত্ম্য কম নয়। প্রতি বছর সামার ঘিরে বিভিন্ন ব্যানারে ‘পথ মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়। এসবেও থাকে বিভাজনের রেশ। দিনশেষে আমাদের অর্জন। আমরা বাংলাদেশি। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ নই। বিভাজিত একটি জাতি। যাদের কথায় আবেগ। বাস্তবে অন্ধ-একচোখা।
দশ. দেশের ভূত প্রবাসে
আমেরিকায় জন্ম নেওয়া কিংবা একটু সচেতন যারা, তারাও চায় না যে, ‘বাংলাদেশের বিভাজিত রাজনীতির ছোঁয়া পড়ুক কমিউনিটিতে’। কিন্তু কে শুনবে কার কথা। প্রতিনিয়ত ‘ক্ষমতাসীন ও বিরোধী’ রাজনৈতিক চর্চা। একপক্ষ অন্য পক্ষকে ঘায়েল করা। মতের অমিল হলে নিজ সংগঠন কিংবা দলের বিরুদ্ধে অবস্থান। প্রয়োজনে আরেকটি গ্রুপ প্রতিষ্ঠা। মারামারি-হাতাহাতি থামাতে পুলিশি হস্তক্ষেপ! আটকের পর মুক্তি!! এটাই হচ্ছে, নিউইয়র্কে বসবাসকারী বা আমাদের নিত্যদিনের রুটিন। যা চলমান, তাই না?
এগারো. মূলধারায় প্রতিনিধিত্ব
বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে কেবল নিউইয়র্কে ৬-৭ লাখেরও বেশি বাংলাদেশির বাস। পেশাগত দায়িত্ব পালনে নিউইয়র্ক সিটি ও রাজ্য প্রশাসনের বিভিন্ন সংবাদ সংগ্রহ করি। অনেকের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আফসোস, এতো বড় একটি কমিউনিটি হয়েও আমেরিকান-মূলধারায় রাজনীতিতে আমাদের কেউ ছিল না। তবে নতুনভাবে মূলধারার (সিটি কাউন্সিলে) রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন দু-একজন, করছেন প্রতিনিধিত্ব। এছাড়া ছোট ছোট কাউন্টিগুলোতে একাধিক ‘শহর বা নগর প্রতিনিধি’ রয়েছেন, যারা বাংলাদেশি-অভিবাসী। আমাদের ছোটখাটো অর্জনগুলোকে আরো বড় করা প্রয়োজন ‘ঐক্যবদ্ধ কমিউনিটি’ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ‘আমব্রেলা খ্যাত সংগঠন’ তা কি গড়তে পেরেছে? হুম! ‘একটি ভবন’ আছে, এটা সত্য। কিন্তু এমন ভবন তো আরো দুটি আঞ্চলিক সংগঠনের রয়েছে। বৃহত্তর নোয়াখালী সোসাইটি আর বৃহত্তর চট্টগ্রাম সমিতির। যাদের নিজস্ব ভবন আছে।
বারো. যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচন
২০২৪ সালেরো দুটি প্যানেলের মধ্যে কাকে বেছে নেবেন? এ নিয়েও নানা মত। তবে আমার দেখা একটি প্যানেলে রয়েছে প্রায় সব অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব। এছাড়া যেখানে তরুণ উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণও বেশ। রুহুল-জাহিদ প্যানেলের কথা বলছি। জাহিদ মিন্টুর প্রতিশ্রুতি-‘তারা এবার সত্যিকারের সোসাইটি বিনির্মাণ করবেন। যার মধ্যে থাকবে একটি বৃহৎ আকারের কমিউনিটি সেন্টার। সোসাইটির সদস্য ও তথ্যকে ডাটাবেজে যুক্ত ইত্যাদি,’ যা আশাব্যঞ্জক। অন্য প্যানেলেরও রয়েছে নানা প্রতিশ্রুতি। অকপটে বলতে পারি, ‘ব্যক্তি জাহিদ মিন্টুকে আমি জানি দীর্ঘদিন ধরে। আপাদমস্তক তিনি কমিউনিটির অ্যাসেট। অতীত ও বর্তমানে তার কথা কাজে অনেক মিল পেয়েছি।’ অতীতে যেসব প্রার্থী নির্বাচনকালীন প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ ছিলেন, এবার রুহুল-জাহিদ প্যানেলের ওয়াদা পূরণ সহজ হবে। কারণ কমিউনিটির উদীয়মান নেতা জাহিদ মিন্টু। যিনি ব্যক্তিগতভাবেই মানুষের কল্যাণে কাজ করে থাকেন। তাই তার মতো সৎ এবং বিত্তবান প্রতিনিধি বাংলাদেশ সোসাইটির হাল ধরলে এর সুফল হবে বাস্তবধর্মী। কিছুটা হলেও গতি ফিরে পাবে প্রবাসীদের আমব্রেলা খ্যাত সংগঠনটি। এটা একান্তই আমার বিশ্বাস। অন্য প্যানেলেও ভালো মানুষ রয়েছেন। কিন্তু বাস্তবমুখী কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ অর্থ, যেখানে মূল কারণ, সেখানে পদ-পদবির চাইতে মেধা ও শ্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তেরো. স্বপ্নবাজদের চাওয়া
প্রজন্মের সঙ্গে মূলধারার সেতুবন্ধন। এটি কি ঐক্য ছাড়া সম্ভব? দেশীয় রাজনীতি, আধিপত্য আর বিভাজনই কী সব? হতে পারতো এর বিপরীত চিত্র। একটি ঐক্যবদ্ধ কমিউনিটি গড়া। যাতে সম্ভব ‘আরো বড় কিছু’ অর্জন। ভাবতেই ভালো লাগে। যখন দেখি; নিউইয়র্ক সিটির পাবলিক-স্পেশালাইজড স্কুল ও কলেজে বাংলাদেশি-আমেরিকান শিক্ষার্থীরা এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে। আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সিভিল-সার্ভিসে বাংলাদেশিরা কর্মরত। চাকরি ক্ষেত্রে তাদের অনেকেই সফল। ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগে বাংলাদেশি-ইমিগ্র্যান্টদের অবদানও মূল্যায়িত হচ্ছে। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে তা তুলে ধরছেন, সিটির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। এধারা আরো অব্যহত রাখতে দরকার কমিউনিটির ঐক্য এবং সচেতনতা।
চৌদ্দ. লেখকের প্রত্যাশা
বাংলাদেশ সোসাইটির আসন্ন নির্বাচনে প্রকৃত বিবেকের ব্যবহার করুন। ‘২০ ডলারে’ বিবেক বিক্রি করবেন না। যোগ্য প্রার্থীকে বেছে নেবেন। সম্ভব হলেও ভোটের আগের দিন পর্যন্ত প্রত্যেকের অতীত কর্মকাণ্ডের খোঁজ নেবেন। এরপর সিদ্ধান্ত নেবেন। খুঁজে বের করবেন আঞ্চলিক সংগঠন কিংবা কমিউনিটিতে এসব প্রার্থীর বাস্তবধর্মী অবদানইবা কতটুকু? প্রশ্নটি নিজের বিবেককে করবেন। আমরা চাইবো যার মাধ্যমেই ভোটার নিবন্ধিত হই না কেন; প্রতিনিধি নির্বাচনে অন্তত নিজের ন্যূনতম বিবেকের ব্যবহার। অন্যথায়, প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি যাই হোক; ফলাফল সেই একই। কোনো কিছুরই ওয়াদা পূরণ হবে না।
পরিশেষে বলতে চাই-আমার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাস জীবন খুব একটা দীর্ঘ নয়। কমও বলা যায় না। আগামী ২৭ অক্টোবরের নির্বাচনসহ সোসাইটির প্রায় পাঁচটি নির্বাচন দেখার সৌভাগ্য অর্জন করতে যাচ্ছি। একজন ক্ষুদ্র গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে সক্রিয় ছিলাম। চ্যানেলের জন্য সংবাদ সংগ্রহ করতে হয়েছে। সরাসরি সম্প্রচারও করেছি। অনেক কিছু পরখ করে দেখেছি। কাছ থেকে দেখেছি কাদের দৌরাত্ম্য কতটুকু। দিনশেষে ভাবছি, ‘আসলেই আমাদের অর্জনটাইবা কি?’ কোনো উত্তর পাইনি। তবুও আশা করছি, ঐক্যবদ্ধ কমিউনিটি এগিয়ে নেবে অভিবাসী-বাংলাদেশিদের। দেশের বিভাজিত রাজনীতি নয়; আমেরিকান প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠায় দরকার কমিউনিটিতে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব, যা গড়ে উঠুক বাংলাদেশ সোসাইটির মধ্য দিয়ে, এমনটিই প্রত্যাশা।
শিবলী চৌধুরী কায়েস
সাংবাদিক-লেখক, নিউইয়র্ক