৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:২৬:১৬ পূর্বাহ্ন


যুক্তরাষ্ট্রে কারাবন্দির সংখ্যা ১৯ লাখ ছাড়ালো
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০৪-২০২৫
যুক্তরাষ্ট্রে কারাবন্দির সংখ্যা ১৯ লাখ ছাড়ালো ব্রুকলিনের মেট্রোপলিটন ডিটেনশন সেন্টার


যুক্তরাষ্ট্রে কারাবন্দির সংখ্যা ২০২৪ সালের শেষে এসে ১.৯ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে, যা বর্তমানে বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। করোনা মহামারির সময় এই সংখ্যা কিছুটা কমলেও পরে আবার তা বাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং অপরাধ দমন নীতিমালার জটিল যোগফলই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে মনে করছেন আইনবিশেষজ্ঞরা। এই ১৯ লাখ বন্দির মধ্যে রয়েছেন ফেডারেল ও রাজ্য কারাগারে দণ্ডিত, স্থানীয় জেলে বিচারাধীন, ইমিগ্রেশন ডিটেনশন সেন্টারে আটক, সামরিক হেফাজতে বন্দি, মানসিক স্বাস্থ্যের কারণে নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা ব্যক্তি এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সংশোধনাগারে রাখা কিশোর অপরাধীরা।

ফেডারেল কারাগারে বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার ৯৭২ জন বন্দি রয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৪৬ শতাংশ মাদকসংক্রান্ত অপরাধে দণ্ডিত। ২০২৩ সালের হিসাবে দেখা যায়, ফেডারেল কারাগারে অ-আমেরিকান নাগরিক বন্দির সংখ্যা ২২ হাজার ৮১৭ জন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা অবৈধ প্রবেশ বা মাদক পাচার সংশ্লিষ্ট মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত। স্টেট কারাগারগুলোতে বন্দির সংখ্যা আরো বেশি। প্রায় ১০ লাখ ৫০ হাজার। এদের মধ্যে প্রায় ৬৩ শতাংশ সহিংস অপরাধে দণ্ডিত, যার মধ্যে খুন, ধর্ষণ, অস্ত্র ব্যবহার এবং গুরুতর হামলার মতো অপরাধ অন্তর্ভুক্ত। টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া ও ফ্লোরিডা রাজ্যে কারাগারে চাপ সবচেয়ে বেশি। শুধু টেক্সাসেই ২০২৪ সালের হিসাবে স্টেট এবং স্থানীয় মিলে বন্দির সংখ্যা ২ লাখ ১১ হাজার ৭১৭ জন ছাড়িয়েছে। স্থানীয় জেলগুলোতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বন্দির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৬৩ হাজার ১০০ জনে। এদের অধিকাংশই এখনো বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন। জামিনের অর্থ জোগাতে না পারা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিচার-অপেক্ষাকালই অনেক সময়ে ‘অঘোষিত শাস্তি’তে পরিণত হয়েছে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে বন্দিদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ, যা মোটের ৭৪ শতাংশ। নারীর সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ (২৬ শতাংশ)। যদিও ঐতিহ্যগতভাবে পুরুষদের অপরাধ প্রবণতা বেশি, তবে সম্প্রতি নারীদের মধ্যেও বিশেষ করে মাদকদ্রব্য বহন, সম্পত্তিসংক্রান্ত অপরাধ এবং পারিবারিক সহিংসতাসংক্রান্ত অপরাধের হার বেড়েছে। বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ৫৫ বছরের ঊর্ধ্বে বন্দিদের সংখ্যা ২০০০ সালের তুলনায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধির ফলে কারাগার ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা, মানসিক সহায়তা, ওষুধ এবং দীর্ঘমেয়াদি যত্নের চাহিদা বহুগুণে বেড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কারাগার ব্যবস্থায় বর্ণভিত্তিক বৈষম্য এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়। আফ্রিকান-আমেরিকানরা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৩ শতাংশ হলেও তারা কারাবন্দিদের প্রায় ৩৮ শতাংশ। হিস্পানিক জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও একই ধরনের চিত্র দেখা যায়। অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে এই হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, পুলিশি হেফাজত, জামিন নির্ধারণ, বিচার বিলম্ব এবং শাস্তির মাত্রায় বর্ণভিত্তিক পক্ষপাত এখনো প্রভাব বিস্তার করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কারাবন্দি সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে ‘ওয়ার অন ড্রাগস’ নীতিমালার অংশ হিসেবে কঠোর মাদকবিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়, যার ফলে হাজার হাজার মানুষ দীর্ঘমেয়াদে কারাগারে আটক হন, এমনকি অপ্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীদেরও। অনেক ক্ষেত্রে অ-হিংসাত্মক অপরাধের জন্যও দেওয়া হয়েছে আজীবন দণ্ড। জামিন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, আদালতের দীর্ঘসূত্রতা, অপরাধ তদন্তে প্রযুক্তিগত দুর্বলতা এবং পুনর্বাসনমূলক কর্মসূচির অভাব কারাগারে বন্দিদের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলছে। এছাড়া মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার উপযুক্ত চিকিৎসা না পাওয়াও অপরাধের পুনরাবৃত্তি এবং আটককাল বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ৫৮০ জন কারাগারে রয়েছেন। ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে এই সংখ্যা ১০০-এর নিচে। যেমন নরওয়েতে এই হার ৫৭, জার্মানিতে ৭৬ এবং নেদারল্যান্ডসে ৬৫। এমনকি চীন, রাশিয়া কিংবা ব্রাজিলের মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় হার অনেক কম।

আইনবিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা এখনো ‘শাস্তিমূলক’ কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ। অপরাধ দমন করতে গিয়ে সমাজ থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, পুনর্বাসন কর্মসূচির অভাব এবং জীবনের দ্বিতীয় সুযোগ না দেওয়ার প্রবণতাÑ সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে। এখন সময় এসেছে বিচারব্যবস্থাকে মানবিক এবং পুনর্বাসনকেন্দ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুনর্বিবেচনা করার।

যুক্তরাষ্ট্রে কারাবন্দি জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই প্রবণতা শুধু আইনশৃঙ্খলার বিষয় নয়; এটি সমাজ, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের প্রশ্নও। বর্তমান পরিস্থিতি মার্কিন নীতিনির্ধারকদের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছে, একটি জাতি তার নাগরিকদের কীভাবে দেখে: শুধুই অপরাধী হিসেবে, না কি সংশোধনের সুযোগপ্রাপ্ত মানুষ হিসেবে? যদি সমাজে ন্যায়বিচার, মানবিকতা এবং টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তবে এখনই সময় আমূল কারা সংস্কার ও বিচারব্যবস্থার রূপান্তরের।

শেয়ার করুন