এবার ধবংসের তালিকায় স্থান পেতে যাচ্ছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রাধাকৃষ্ণ মন্দির। দীর্ঘদিন ধরে সরকারের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার খপ্পড় আর ইচ্ছাকৃত অব্যবস্থাপনা, অযত্ন, অবহেলা এবং বেআইনি দখল ও অবৈধ ব্যবহারের কারণে চরম ধ্বংসের মুখে পড়েছে।
অতীত কথা
ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, বিশ শতকের শুরু দিকে লালমোহন সাহা বণিক, ভজহরি সাহা বণিক ও গৌর নিতাই সাহা বণিক ঢাকায় ব্যবসায় বেশ উন্নতি লাভ করেন। শোনা যায় তারা এতো বিত্তশালী হয়ে উঠেন যে তারা তাঁরা বণিক উপাধি বর্জন করেন। গ্রহণ করেন ‘শঙ্খনিধি’ উপাধি । ১৯২০-১৯২৬ সালের দিকে তাঁরা ঢাকার কিছু ভূসম্পত্তির মালিক হন এবং সেখানে কিছু ভবন নির্মিত হয়। তবে তিন ভাইয়ের একজন লালমোহন সাহা ১৯২১ সালে শঙ্খনিধি হাউস নির্মাণ করেন। এই সময়েঢাকার টিপু সুলতান রোড থেকে ওয়ারীর র্যাঙ্কিন স্ট্রিট পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে এই ভবনগুলো গড়ে ওঠে।
ভবনটির বিভিন্ন দিক
শঙ্খনিধি হাউসের স্থাপত্যে গোথিক-ইন্ডিয়ান ও ইন্দো-সারাসিন রীতির অসাধারণ মিশ্রণ দেখা যায়। ভবনের পূর্বদিকে অবস্থিত শঙ্খনিধি নাচঘরটি তার কারুকার্যপূর্ণ ছাড়াও ও রঙিন টালির দেয়াল দিয়ে যে কোনো দর্শনার্থীকে মুগ্ধ করতো। শঙ্খনিধি হাউজের পূর্বপার্শ্বে প্রায় ৫০ ফুট প্রশস্থ একটি ছোট মনোরম একতলা স্থাপনা ছিল যা শঙ্খনিধি নাচঘর নামে পরিচিত। এর কারুকাজ এবং প্রবেশমুখ দেখতে হিন্দু মন্দিরের মতো হলেও এটি মূলত বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কাজের জন্যই নির্মাণ করা হযেছিল বলে শোনা যায়। কেন্দ্রের ওই মূল নাচঘরটিতে কাঠের কারুকাজসজ্জিত ছাদ এবং দেয়ালগুলো রঙিন টালিতে শোভিত ছিল। শোনা যায় এই দক্ষিণমুখী ভবনটি ভূপৃষ্ঠ হতে ৫ ফুট উঁচুতে স্থাপন করা হয়েছিল। ভবনটি কেন্দ্রীয় অক্ষের সাপেক্ষে প্রতিসম, দুইদিকের প্রান্তে বিদ্যমান ছিল দুটি অষ্টকোণী অংশ। অষ্টকোণী অংশদ্বয় দ্বিতলবিশিষ্ট এবং চূড়ায় অষ্টকোণী গম্বুজ দ্বারা আবৃত। এর বারান্দায় প্রবেশের জন্য ছিল ২০ ফুট প্রশস্থ সোপান। বারান্দার সম্মুখে ৪টি সুশোভিত কোরিন্থিয়ান স্তম্ভ ছিল, যাদের মাঝখানে তিনটি বহুখাঁজযুক্ত অর্ধবৃত্তাকার তোরণ বিদ্যমান। অষ্টকোণী অংশদ্বয়ের জানালাগুলো সুসজ্জিত তোরণ এবং দুইপাশে সরু লম্বা কোরিন্থিয়ান স্তম্ভ দ্বারা বেষ্টিত।
এখন সব অতীত
স্থানীয়ভাবে “শঙ্খনিধি লজ”, “লালমোহন সাহার ঠাকুরবাড়ি-আখড়া” বা “ঠাকুরবাড়ি” নামে পরিচিত-দীর্ঘদিন ধরে অব্যবস্থাপনা, অযত্ন, অবহেলা এবং বেআইনি দখল ও অবৈধ ব্যবহারের কারণে চরম ধ্বংসের মুখে পড়েছে। গত ২ জুন সোমবার সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এই স্থাপনাটির সম্মুখ ভাগের টানা বারান্দাসহ একটি অংশ ধসে পড়েছে, যা পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী নগর স্থাপত্যে এক গভীর আঘাত।
সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ কাগজে-কলমে
তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভবনের হিন্দু অধিবাসীরা ভারত চলে যান। ১৯৮০ সালে শঙ্খনিধি হাউস প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০১৭ সালের ২ আগস্ট হেরিটেজ বা ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেবে পরিচিত রাজধানীর ৯৩টি প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও স্থান সংরক্ষণে সরকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন,যার মধ্যে শঙ্খনিধি হাউসও রয়েছে। যদিও মন্দিরটি সরকারের জাতীয় ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, রাজউক, ডিএসসিসি ও জেলা প্রশাসনের অব্যবস্থা, গাফিলতি ও আন্তঃসংস্থাগত সমন্বয়ের অভাবে এর বিভিন্ন অংশ বহু বছর ধরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দোতলা বিশিষ্ট এই স্থাপনাটির নিচতলায় বর্তমানে ১৫-২০টি মেটাল ওয়ার্কশপ এবং চত্বরের খোলা অংশে একটি বড় আকারের গাড়ি মেরামতের কারখানা পরিচালিত হচ্ছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ভবনের কিছু অংশ আবাসিক ও বাণিজ্যিক লিজেও দেওয়া হয়েছে, যা ঐতিহ্য রক্ষার চরম ব্যর্থতা।
২০১১ সালে মন্দিরটির মূল গর্ভগৃহ ও নাটমন্দির (হোল্ডিং নং ৪৪, রাংকিন স্ট্রিট)-যেখানে বিগ্রহ বিরাজমান ছিল-তা হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ অমান্য করে অবৈধভাবে ভেঙে ফেলা হয়। এরপর বহুবার স্থাপনাটি সম্পূর্ণ দখল ও ধ্বংসের চেষ্টা হয়েছে। ২০১৮ সালের উচ্চ আদালতের যুগান্তহকারী রায়ে রাধাকৃষ্ণ মন্দিরসহ পুরান ঢাকার ঐতিহ্য রক্ষায় আশার আলো দেখা গেলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। মন্দিরের দখলদারদের উচ্ছেদ করে স্থাপনাটিকে সুরক্ষার আওতায় আনার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, সেটিও নষ্ট হয়ে যায়।
এরপর ২০২১ সালে পূর্বোক্ত ২০১১ সালের রিটের মূল শুনানিতে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের অস্পষ্ট অবস্থান এবং আদালতে ভ্রান্ত তথ্য উপস্থাপনের ফলে এক রায়ের মাধ্যমে এই ধ্বংস কার্যক্রম কার্যত বৈধতা পায়। যা অনেকের মধ্যে অত্যন্ত উদ্বেগ তৈরি করেছে। কারো কারো মতে এটা সাংস্কৃতিক আকাঙক্ষার পরিপন্থী।
এদিকে এসব বিষয় নিয়ে আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী স্থপতি তাইমুর ইসলামের সাথে কথা হয়। তিনি অবিলম্বে মন্দির এলাকা থেকে সকল অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে আহবান জানান। দেশ পত্রিকার সাথে কথা বলতে গিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত অংশের পুনর্গঠন এবং সম্পূর্ণ কমপ্লেক্সটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এনে নিয়মিত সংরক্ষণ ও সংস্কার নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি। তিনি বলেন, এই ধ্বংস শুধু একটি স্থাপনার ক্ষয় নয়-এটি আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আইনের প্রতি চরম অবমাননার বহিঃপ্রকাশ। আজকের পাল্টে যাওয়া রাজনৈতিক পরিবেশে আমরা আশা করি, সরকার এখন যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে জাতির এই অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তিনি এটি ধ্বংস ও জবরদখলের বিরুদ্ধে জরুরি আইনগত ও রক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান।