বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন আবিষ্কার পিআর পদ্ধতি। কোথা থেকে কিসের স্বার্থে এমন পদ্ধতির আবিষ্কার ও এর নেপথ্যে কারা কলকাঠি নাড়ছেন সেটা বোধগম্য নয়। তবে এ পদ্ধতির দাবিতে রাজনীতির মাঠ তোলপাড়। এক পক্ষ এটাকে ভোট পেছানো বা ভোট বানচালের ফঁন্দি দেখছেন, কেউ আবার এর মাধ্যমে কয়েকটি হলেও আসন নিয়ে সংসদে যাবার বাসনা করছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর শেষ হতে চললো। আট আগস্ট এর বর্ষপূতি। কিন্তু এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি নির্বাচনের দিনক্ষণ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের ক্ষমতার অবসানের পর থেকেই প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে চলছে দেশ। এরই মধ্যে অনেক কিছু বিষয়ের উপস্থাপনা ঘটেছে, পরিবর্তন আসছে কিন্তু সবকিছুই ধীর গতিতে। এতে মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। কেউ বলছে, ‘বেশ ভালই চলছে সব।’ কেউ বলছে ‘না তো, যা প্রত্যাশা করেছিলাম তেমন তো কিছু না।’ কেউ বা এর বিপরীতে। নির্বাচিত সরকারের কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। কিন্তু সেটা কবে? সেটা এখনও নিশ্চিত হয়নি। জুলাই হত্যাকান্ডসহ অনেককিছুর হিসেব নিকেষ বাকি। সেগুলোর কাজও চলছে ঢিমেতালে।
উপদেষ্টা পরিষদের আন্তরিকতার অভাব দেখা যাচ্ছে না। তবে বাস্তবে যে পদক্ষেপগুলো জরুরি ভিত্তিতে নেয়া প্রয়োজন সেগুলোর গতিও কচ্ছপ! এমন পরিস্থিতিতে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে নানা ইস্যু। এরমধ্যে পিআর পদ্ধতিতে ভোট ও জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনেরও দাবি তোলা হচ্ছে। এসব নিয়ে রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন হিসেব মেলাচ্ছেন। সবাই চান ক্ষমতা। এতে কেউ চান সিংহভাগ আসন নিয়ে ক্ষমতায় বসতে। কেউ চান ভাগ। এই ভাগবাটোয়ারাই জুলাইয়ের যে চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন সবাই শেখ হাসিনার টানা শাসনামলের বিপক্ষে, সে ঐক্যে স্পষ্ট ফাটল। এখানে স্পষ্ট দুইভাগ হয়ে গেছে। এক পক্ষ বিএনপি নেতৃত্বাধীন, অন্য পক্ষ ইসলামকে পুজি করে একত্রিত হওয়া কিছু দল।
সাধারণ মানুষের কাছে এটা মোটেও কাম্য না। তবু এমন অনৈক্য আবারও শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগকে পূর্নবাসিত হতে সুযোগ করে দেবে কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। চলছে নানা বিশ্লেষণ।
আর এ সবের পেছনে একটা উদ্দেশ্য জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়া। নির্বাচন যত পেছাবে তত রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হবে। যে সুযোগটা নিতে চাইবে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। যদি নির্বাচন হয়ে যায় এবং নির্বাচিত সরকার চলে আসে, তাহলে পরবর্তি পাচ বছরের জন্য নতুন সরকার যেটাকে আওয়ামী বিরোধী আরেকটি সরকারের যাতাকলে পড়তে হবে আওয়ামী লীগকে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচন্ড চাপে দেশ ছেড়ে যাওয়া ও আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়া আওয়ামী রাজনীতি আরেকটা প্রেসারে পড়লে সেখান থেকে উঠে দাঁড়ানো বহু কষ্ট। ফলে নির্বাচন বিলম্বিত করে রাজনৈতি ঐক্য বিনষ্ট করে যদি ঘোলাজলে বিশৃংখলা তৈরি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিদায় করে দেয়া যায় তাহলে রাজনীতির মাঠে ফিরতে দলটির সুবিধা। ক্ষমতায় না আসতে পারলেও রাজনীতির মাঠে থাকাই দলটি খুব দ্রুত পূনর্বাসিত হতে পারবে। কারণ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ছদ্মবেশে আওয়ামী পন্থীরা রয়ে গেছে। সবাইকে রিমুভকরণ সম্ভব না। অন্তর্বর্তী ওই পদক্ষেপ খুব একটা নেয়ও নি। যা নির্বাচিত সরকার এলে হয়তো বা নেবে।
কিভাবে রাজনৈতি পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে?
অন্তর্বর্তী সরকারের সূচনা থেকেই সংস্কারের বক্তব্য বেশ জোরালো। একদিকে সংস্কার অন্য দিকে নির্বচনের রোডম্যাপের দাবি। কিন্তু বিএনপির ওই রোডম্যাপের দাবি শুধুই অর্ন্তবর্তী সরকারের কাছে অগ্রাহ্য থেকেছে তাই নয়, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এক সঙ্গে থাকা দলসমূহেও অনৈক্য ছিল। এর বিরোধীতা করেছে জামায়াত। যদিও অনেক পরে এসে বিএনপির সেই দাবির সঙ্গে একমত হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে অন্তর্বর্তী দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপের প্রয়োজনীয়তা থেকে কিছুটা হলেও দূরে সরেছে।
সর্বশেষ, লন্ডনে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকের পর আবারও নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে শোরগোল রাজনীতিতে। সেটা এখনও আছে। কিন্তু সম্প্রতি কিছু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও অনৈক্য আবারও সেই নির্বাচনের সময়সূচি পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি করেছে। এরমধ্যে ‘পিআর পদ্ধতি’তে নির্বাচনের দাবি ও জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনসমূহ অনুষ্ঠানের দাবি। এ দুটি দাবিতেই এখন বিএনপি নেতৃত্বাধীন এক পক্ষ ও জামায়াত, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনসহ কতিপয় দল অন্যপক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে।
এ দুই পক্ষের কঠোরতা সম্ভবত জাতীয় নির্বাচন এমনিতেই পিছিয়ে দিতে বাধ্য হবেন অর্ন্তবর্তী সরকার। কারণ পিআর পদ্ধতির আমদানী হঠাৎ। মানুষ এটা কি, সেটা বুঝেনই না। শতকড়া এক পার্সেন্ট মানুষও এ পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত নন। ফলে হঠাৎ এমন পদ্ধতিতে কে লাভবান হবেন সেটা নিয়ে প্রচণ্ডরকম শঙ্কা বিরাজ করছে।
বর্হিবিশ্বের একটি অংশের চাপ রয়েছে আগামী নির্বাচন হতে হবে, সব দলের অংশগ্রহণে। সব দল বলতে সেখানে আওয়ামী লীগ থাকবে না এটা কিন্তু কেউ বলেনি। ফলে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে যদি অন্তর্ভুক্ত করে নির্বাচনে সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে পিআর পদ্ধতির সুবাদে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ মুহূর্তে পুনর্বাসিত হবে। তাতে শেখ হাসিনা বা তার মন্ত্রী, এমপি যারা রয়েছেন, তাদের দেশে এসে প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে না। এমনিতেই বিশাল রাজনৈতিক দল। গত ১৬-১৭ বছরে টানা ক্ষমতায় থেকে আরো অনেক শক্তিশালী। ফলে পিআর পদ্ধতিতে আওয়ামী লীগ যদি শতকরা আর না হোক ২০% ভোটও (সাধারণ আওয়ামীপন্থীর ভোট) লাভ করে, তাহলে সংসদে তাদের আসন হবে ৬০টি। এটা একেবারে কম করেও হলেও। সংসদে ৬০টি আসন মানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ বেশ ভালভাবেই ফিরে আসার সুযোগ পাচ্ছে। তাহলে আওয়ামী লীগ এভাবেই পুনর্বাসিত হয়ে যাবে।
পক্ষান্তরে এ পদ্ধতির যারা দাবিদার এ মুহূর্তে সে জামায়াতের ভোট কত পার্সেন্ট? ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের কত পার্সেন্ট? হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ঐক্যজোটের কত পার্সেন্ট। সবাই আনুপাতিক হারে ভোট পেয়ে সংসদে আসন লাভের সুযোগ পেল। পরবর্তীতে এরা সব আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগ দিলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে চোখে চোখ রেখেই দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পাবে। যা পরবর্তীতে আরেকটি নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি বা তাদের নেতৃত্বাধীন জোটকে পরাস্ত করে আবারও পুরানো আমল ফিরে যাবার সুযোগ অনায়াসেই তৈরি হয়ে যেতে পারে। ফলে যারা পিআর পদ্ধতি নিয়ে আন্দোলন করছে, তারা কাদের স্বার্থে এটা করছেন বা সবকিছু বুঝে শুনে করছেন কি না সেটা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাড়িয়েছে।
কে কে চাচ্ছে পিআর পদ্ধতি
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন বা পিআর পদ্ধতির দিকে নজর দিচ্ছে যেসব রাজনৈতিক দল, যেমন- জাতীয় নাগরিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন এবং কমিউনিস্ট পার্টি। তবে বিএনপি এই পদ্ধতির বিরোধিতা করে আসছে। প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষেই রয়েছে তারা। জানা গেছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন দলের মধ্যে মতবিরোধ কাজ করছে। বিএনপি নেতারা মনে করছেন পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবি করার উদ্দেশ্য হলো নির্বাচন পিছানো বা বানচাল করা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও সালাউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়ার অর্থ হলো আগামী নির্বাচনকে বানচাল করা। তারা বলেন, যাদের জনগণের প্রতি আস্থা নেই, যারা নির্বাচনকে ভয় পায় তারাই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এ পদ্ধতিকে সামনে এনেছে।
বিএনপি নেতারা বলেন, লন্ডন বৈঠকের পর রোজার আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বার্তা পায় জনগণ। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের প্রাথমিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রায় ১২ কোটি ভোটার আছেন ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে। সবার ধারণা, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কারের পর প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। কিন্তু সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে হঠাৎ করে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) বাংলায় ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ নির্বাচন শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
হঠাৎ করে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি তুলছেন এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সে দাবি অধিক গুরুত্ব দিয়ে দিনের পর দিন বৈঠক চালিয়ে যাচ্ছে। নেপথ্যের রহস্য কি? পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের নামে তারা কি ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সংসদে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে চাচ্ছেন? নাকি জনসমর্থন না থাকায় সারা দেশের প্রাপ্ত ভোটে নিজেদের সংসদে যাওয়া নিশ্চিত করতে চাচ্ছেন?
বাংলাদেশে আনুপাতিক হারে নির্বাচনের ইতিহাস নেই এবং সংসদীয় রাজনীতি এবং সংসদীয় নির্বাচনের ইতিহাস নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটি একটি নতুন ধারণা। যার জন্য অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা পৃথিবীর বহু দেশে হয়েছে। আমরা দেখেছি, এই দেশের জন্য এটি প্রযোজ্য নয়। আনুপাতিক হারে নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো সংসদীয় এলাকার ভোটাররা জানবেন না যে, কে তাদের এমপি হবেন। তা ছাড়া প্রয়োজনে এমপিদের কাছে যে তারা যাবেন, নির্ধারিত কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে পাবেন না।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেন, কার এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে হঠাৎ করে কিছু দল পিআর পদ্ধতির নির্বাচন দাবি জোরদার করতে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
জনসমক্ষে যেভাবে উঠে এলো এ দাবি
গত ২৮ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সমাবেশে অংশ নেয়া জামায়াত, এনসিপি, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল ও হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ঐক্য পরিশোধের নেতারা পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি জানিয়ে সোচ্চার বক্তব্য দেন। অথচ ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াতের মধ্যে কখনই একে অপরকে সহ্য করতে দেখা যায়নি। শেখ হাসিনার শাসনামলে বিএনপিসহ কোনো দল সভা-সমাবেশ করতে না পারলেও ইসলামী আন্দোলন পুলিশ প্রহরায় সমাবেশ করেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীদের প্রচারণায় নামতে দেয়া হয়নি অথচ ইসলামী আন্দোলনকে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে দেয়া হয়। বছর দেড়েক আগে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতারা ঘুষি মেরে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীর মুখমন্ডল রক্তাক্ত করে। ওই ঘটনার প্রতিবাদে দলটি ২০২৪ সালের পাতানো নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকে। দলটি দীর্ঘ ১৫ বছর যে আওয়ামী লীগ তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে আগামী সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি তোলা হচ্ছে।
পিআর পদ্ধতিটা কী
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি যেখানে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কোন দল মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ১০ শতাংশ পায়, তাহলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি (৩০০ আসনের মধ্যে) আসন পাবেন। পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুক্ত, গোপন ও মিশ্র তিনটি আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থার সাথে পার্থক্য কী?
বর্তমান বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় ৩০০টি আসনে আলাদা আলাদা প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক দলগুলো। ধরা যাক, বর্তমান পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে একটি আসনে মোট চারজন প্রার্থী চারটি দল থেকে নির্বাচন করছে। এই নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৮৫ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তিনজন প্রার্থীই ২০ শতাংশ করে ভোট পেল। আর চতুর্থ প্রার্থী পেলো ২৫ শতাংশ ভোট। বর্তমান পদ্ধতি অনুযায়ী চতুর্থ প্রার্থীই এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। আর ওই তিনটি দলের ৬০ শতাংশ ভোট তেমন কোন কাজে আসছে না।
একই ভাবে সারাদেশের অন্তত ২৯০ আসনে যদি একই হারে ভোট পেয়ে চতুর্থ দলটির প্রার্থীরা জয়লাভ করে, তাহলে মাত্র ২৫ শতাংশ ভোট নিয়ে তারা সরকার গঠনসহ সংসদে একচ্ছত্রভাবে আধিপত্য করবে।
অথচ বাকি তিন দল মিলে ৬০ শতাংশ ভোট পেলেও তাদের কোন প্রতিনিধিত্ব থাকলো না সংসদে। এতে সংসদে প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণ থাকে না।
পিআর-এ অসুবিধা
পিআর পদ্ধতিতে অসুবিধা হচ্ছে ধরা যাক নোয়াখালী সদরে জনপ্রিয় প্রার্থী মি. ক। মানুষ তাকে ভোট দিচ্ছে এলাকায় তার দ্বারা অনেক উন্নয়ন সম্ভব। বিভিন্ন সময় সে সাধারণ মানুষের উপকারে আসবে। মানুষ তার কাছে দাবি তুলতে পারবে। কিন্তু পিআর সিস্টেমে নোয়াখালী সদরে সবাই ভোট দিলেও এখানে কে সংসদে দায়িত্ব পালন করবেন সেটা নির্ধারিত হবে প্রতিটা রাজনৈতিক দলের চাহিদা বা দরকষাকষিতে যে জিতবে সে। এখানে সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ বিএনপির দলের প্রার্থীকে চেয়ে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু তারা পাচ্ছে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রার্থী। অথবা চেয়েছিল তারা জামায়াতের প্রার্থী পেয়েছে হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য জোটের একজন সংসদ সদস্যকে।
এ পদ্ধতিতে সংসদে অনেক দলের সংসদ সদস্যের উপস্থিতি ঘটলেও নির্বাচনি এলাকায় তিনি সম্পূর্ণ অপরিচিত হতে পারেন। যার কাছে মানুষ হয়তো যাওয়াটা পছন্দ নাও করতে পারে। এমন নানা অসুবিধা তৈরি হতে পারে। সংখ্যানুপাতে আসন পেলেই তো হবে না। এরপর চরম অসন্তোষ দেখা দিতে পারে কে কোন এলাকার সাংসদ হবেন সে দরকষাকষি। এমন রাজনৈতিক জটিলতায় দীর্ঘদিন পর মানুষ যে আশা নিয়ে ভোট দেবে সে আশায় গুড়ে বালিও পড়তে পারে। ফলে এ নিয়ে ইতিমধ্যে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে জনমনে।
সবশেষ
দীর্ঘ ১৫ বছর ভোটের যে আকাঙ্ক্ষা সেটার জন্য মানুষ যখন একটা সম্ভাবনা দেখছে, তেমনি মুহূর্তে এমন পিআর পদ্ধতির নির্বাচন, বা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের ঝাক্কি ঝামেলা গোটা নির্বাচন কমিশন বিতর্কিত হয়ে পড়তে পারেন। ফলে যাদের উপর জাতীয় নির্বাচন আয়োজন অসম্ভব হয়ে যেতে পারে রাজনৈতিক দলসমূহের আন্দোলন সংগ্রামে। কারণ বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়াবহ নির্বাচন হলো স্থানীয় সরকারের নির্বাচন। যেখানে মুহূর্তে সবাই গ্রাম, ওয়ার্ড থেকে শুরু করে ঘরে ঘরে মানুষ জড়িয়ে যান নির্বাচনী ক্যাম্পে। যেটা জাতীয় নির্বাচনে তুলনামুলক কম। ফলে সম্ভব্য আগামী রোজার আগে যেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের একটা নির্বাচনের চিন্তাভাবনা শোনা যাচ্ছে সেখানে এমন পিআর পদ্ধতি ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি হুমকির মুখে পড়তে পারে জাতীয় নির্বাচনই। বিষয়টা ইতিমধ্যে চিন্তার খোড়াকে যোগ হয়েছে!