টেস্ট ক্রিকেটের রজতজয়ন্তীতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুলের মহতী উদ্যোগ সাধুবাদযোগ্য। সীমিত সময়ের জন্য টি-টোয়েন্টি ইনিংস খেলার ঘোষণা নিয়ে দায়িত্ব নিয়েছে বুলবুল। দীর্ঘদিনের পরিকল্পনাহীনতা, অপব্যবস্থাপনার জঞ্জাল পরিষ্কার করে বিশাল কিছু অর্জন অকল্পনীয়। কিন্তু রজতজয়ন্তী উপলক্ষ করে বিসিবি ইতিমধ্যে ক্রিকেটকে ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরগুলো খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রামে প্রকৃত অর্থে সুসংগঠিত করার যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটির অকুণ্ঠ প্রশংসা করতেই হবে।
২৬ জুন ২০০০ স্মরণ করে ঢাকায় কাল প্রথম টেস্টে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ ক্রিকেটার, কোচ, কর্মকর্তাদের সম্মিলনীর বিবরণী ছিল চমৎকার। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে অনার্স বোর্ড করা হয়েছে। জানি বুলবুল একজন মুভার্স এবং সেকার্স, ক্রিকেট খেলোয়াড় ছাড়াও একজন বিশ্ববরেণ্য ক্রিকেট চিন্তাবিদ, ব্যবস্থাপক। ব্যতিক্রমধর্মী প্রথম আয়োজন নিয়ে কিছুটা সীমাবদ্ধতা ছিল। বাস্তব পরিস্থিতির কারণেই সাবের হোসেন চৌধুরী, আশরাফুল হক বা রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে কিছু ব্যক্তির উপস্থিতি বা অবদান উল্লিখিত হয়নি। কিন্তু বুলবুল সূচনার মাধ্যমে যে উপমা সৃষ্টি করলো সেই ধারা বজায় রেখে ক্রিকেটের তৃণমূল অনুসন্ধান করলে বাংলাদেশ ক্রিকেট শক্ত ভিত খুঁজে পাবে।
আমরা যারা বাংলাদেশ ক্রিকেটকে আঁতুড়ঘরে হামাগুড়ি দিতে দেখেছি, জানি কি সংগ্রাম করে ক্রিকেট বাংলাদেশে অস্তিত্ব রক্ষা করেছে। ভাই, পল্টু ভাই, সিরাজ ভাই, রেজা ভাই, রইস ভাই, আমিনুল ভাই, মাখন ভাইদের থেকে শুরু করে প্রথম যুগের ক্রিকেটার দৌলত জামান, শামীম চৌধুরী, রকিবুল, সৈয়দ আশরাফুল হক, শফিকুল হক হিরা, ইউসুফ বাবু, খালেদ ওমর রুমি, এস এম ফারুকরা সংগ্রাম করেছে। মনে আছে ঢাকা স্টেডিয়ামে বিসিসিবি অফিস সন্ধ্যায় বিদ্যুৎহীন অবস্থায় মমবাতি জ্বেলে রইস ভাইদের সংগ্রাম করার স্মৃতি। কপর্দকহীন অবস্থায় শুরু করা ক্রিকেটে এখন অর্থ সংকট নেই। কিন্তু একসময়ের দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা ক্রিকেট নিতান্তই ঢাকা এবং কয়েকটি শহরকেন্দ্রিক হয়ে গেছে।
মনে আছে সেদিনটির কথা যখন বাংলাদেশের কিংবদন্তি ক্রীড়া সাংবাদিক (ফুটবল, ক্রিকেট খেলোয়াড়) শ্রদ্ধেয় মোহাম্মদ কামরুজ্জামান ভাই বিলেতি পত্রিকা গার্ডিয়ানের ক্রীড়া রিপোর্টার রবিন মার্লারকে ঢাকা স্টেডিয়াম পরিদর্শনে নিয়ে এসেছিলেন। রবিন মার্লার দেশে ফিরে গার্ডিয়ানে বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন লিখেছিলেন যা ক্রিকেটের বিশ্ব সংস্থার নজরে এসেছিল। অনেকের জানা নেই স্বাধীনতার পর বিলেতে অবস্থানকারী বাংলাদেশ ক্রিকেটার সৈয়দ আশরাফুল হক কিছুটা জনসংযোগ করেছিলেন। রকিবুল হাসান অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশের হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কয়েকটি ম্যাচ খেলেছিলেন। সেই থেকে সূচনা। এরপর তৎকালীন বিসিসিবির উদ্যোগে ১৯৭৭ সালে এমসিসি এলো বাংলাদেশ সফরে। শামীম কবিরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ তিনদিনের ম্যাচ খেললো ঢাকা স্টেডিয়ামে। মনে আছে ইউসুফ বাবুর ব্যাটিং প্রতিরোধ, নজরুল কাদের লিন্টুর চায়নাম্যান বোলিং।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নয়নে ঢাকার ক্রিকেট ক্লাবগুলোর অনন্য অবদান অনস্বীকার্য, একসময় নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট আয়োজন করে কে জেড ইসলাম তৃণমূল ক্রিকেটে বিশাল অবদান রেখেছিলেন। কলেজ ক্রিকেট, আন্তঃজেলা ক্রিকেট, জাতীয় ক্রিকেট নিয়মিত হতো। পাশাপাশি চট্টগ্রামে স্টার ক্রিকেট, দামাল সামার ক্রিকেট, ময়মনসিংহে ক্রিকেট, দিনাজপুরে মিম স্মৃতি ক্রিকেট, রাজশাহী, যশোর, ফরিদপুরে নিয়মিত ক্রিকেট হতো। প্রথম এবং দ্বিতীয় প্রজন্মের ক্রিকেটাররা সীমিত সুযোগ-সুবিধা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন করলো, আইসিসির ওয়ান ডে দল হিসেবে খেলার স্বীকৃতি পেলো। মনে আছে যেদিন কুয়ালামপুরে আকরাম খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ কেনিয়াকে হারিয়ে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হয় দেশজুড়ে ছিল খুশির জোয়ার।
১৯৯৭ বাংলাদেশ আমিনুল ইসলাম নেতৃত্বে বিশ্বকাপ খেলতে গেল ইংল্যান্ডে। পাকিস্তান তখন অন্যতম বিশ্ব সেরা দল। আর সেই দলকেই বাংলাদেশ হারিয়ে দিয়ে চমক জাগিয়েছিল। এই দলের হেড কোচ ছিলেন কিংবদন্তি ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার সার গর্ডন গ্রিনিজ। বিশ্বকাপ চলার সময় এক বিলেতি পত্রিকার সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন বাংলাদেশের তখন টেস্ট মর্যাদা পাবার সময় হয়নি। কিন্তু ততদিনে সাবের চৌধুরী আর আশরাফুল হকের দ্যূতিয়ালিতে বাংলাদেশের টেস্ট অর্জন অনেকটাই অগ্রবর্তী হয়েছে। টেস্ট স্বীকৃতি পাওয়া গেল। কিন্তু স্যার গর্ডন গ্রিনিজকে বিদায় জানানো হলো। অধিনায়ক আমিনুলকে সরিয়ে নাঈমুর রহমান দুর্জয়কে করা হলো অধিনায়ক। ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে ভারত বাংলাদেশ উদ্বোধনী টেস্টে টস করলো দুই বাংলাভাষী অধিনায়ক দুর্জয় আর সৌরভ। আর প্রথম টেস্টে শত রান করে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল।
সেই থেকে ২৫ বছরে ১৫৩ টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ। জয় মাত্র ২৩, পরাজয় ১১১। জয় শতাংশ মাত্র ১৪.১৫ শতাংশ। কেন এই ত্রিশঙ্কু অবস্থা বিষ ক্রিকেট অঙ্গনে সেটির স্বরূপ অনুসন্ধান করলে ২০০০ সালে বিলেতি পত্রিকাকে দেওয়া স্যার গিনিজের মূল্যায়ন মনে পরে। বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের অবকাঠামো এখনো টেস্ট ক্রিকেটে ধারাবাহিক জয়ের উপযোগী নয়। হয়তো আমিনুল ইসলাম বুলবুল স্বল্প সময়ের অবস্থানে ক্রিকেটের খোল নলচে পাল্টে দিতে পারবে না। কিন্তু শুরুটাতো হলো। ধন্যবাদ বিসিবি। ধন্যবাদ বুলবুল।