১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ০১:৪৪:৩১ পূর্বাহ্ন


চীনের ‘গর্ভধারণকারী রোবট’ : বিজ্ঞানের বিপ্লব নাকি নৈতিক সংকট?
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২০-০৮-২০২৫
চীনের ‘গর্ভধারণকারী রোবট’ : বিজ্ঞানের বিপ্লব নাকি নৈতিক সংকট? চীনের ‘গর্ভধারণকারী রোবট’


চীনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কাইওয়া টেকনোলজির এক বিস্ময়কর প্রযুক্তিগত উদ্যোগ বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। তারা দাবি করেছে, এমন এক হিউম্যানয়েড রোবট তৈরি করা হচ্ছে, যা কৃত্রিম গর্ভাশয়ের সাহায্যে মানুষের মতো গর্ভধারণ করতে পারবে এবং পূর্ণ মেয়াদে একটি জীবন্ত শিশুর জন্ম দিতে সক্ষম হবে। এই প্রযুক্তিকে কেউ দেখছেন বন্ধ্যাত্ব সমস্যার সমাধান ও মাতৃত্বে বিপ্লবের সম্ভাবনা হিসেবে, আবার কেউ আশঙ্কা করছেন গভীর নৈতিক সংকট ও সামাজিক পরিবর্তনের সূত্রপাত হিসেবে। চীন থেকে উঠে আসা এক নতুন প্রযুক্তি পরিকল্পনা গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে।

কাইওয়া টেকনোলজি নামের এক প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, তারা এমন এক হিউম্যানয়েড রোবট তৈরি করছে, যা মানুষের মতো গর্ভধারণ করতে পারবে এবং পূর্ণ মেয়াদ শেষে জীবন্ত শিশুর জন্ম দিতে সক্ষম হবে। কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা ড. ঝাং চিফেং সিঙ্গাপুরের নানইয়াং টেকনোলজিকাল ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করা এক গবেষক বলেছেন, তাদের উদ্ভাবিত কৃত্রিম জরায়ু প্রযুক্তি ইতিমধ্যেই পরিণত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখন তারা সেটিকে একটি রোবটের ভেতরে প্রতিস্থাপন করে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথে এগোচ্ছে।

প্রকল্পটির মূল ভিত্তি হলো কৃত্রিম গর্ভাশয়। এর ভেতরে তরল ভর্তি একটি সুরক্ষিত কক্ষ থাকবে, যেখানে ভ্রূণকে ভাসমান অবস্থায় লালন করা সম্ভব হবে। নলের মাধ্যমে ভ্রূণের কাছে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছে যাবে। এই প্রক্রিয়া অনেকটা প্রাকৃতিক মাতৃগর্ভে অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইড এবং প্ল্যাসেন্টার কার্যক্রমের অনুকরণে তৈরি। তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন থেকেই গেছে ভ্রূণটি কীভাবে রোবটের গর্ভে পৌঁছাবে? প্রাকৃতিক গর্ভধারণের মতো নিষেক, ভ্রূণ স্থাপন ও জটিল হরমোন নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়াগুলো সম্পর্কে এখনো কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা কোম্পানি দেয়নি।

কাইওয়া টেকনোলজির ভাষ্যমতে, এই রোবট আগামী এক বছরের মধ্যেই বাজারে আসবে। প্রাথমিকভাবে একটি প্রোটোটাইপ তৈরির কাজ চলছে এবং সেটি প্রদর্শন করা হবে ২০২৬ সালে। কোম্পানি দাম ধরেছে প্রায় ১ লাখ ইউয়ান (প্রায় ১৪ হাজার মার্কিন ডলার বা ১০ হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড)। তুলনায় অনেক দেশে বিকল্প মাতৃত্ব বা সারোগেসি প্রক্রিয়ার খরচ কয়েক গুণ বেশি। ফলে তারা মনে করছে, এ প্রযুক্তি সহজলভ্য হলে বন্ধ্যাত্ব সমস্যায় ভোগা পরিবারগুলোর জন্য এটি হতে পারে সাশ্রয়ী সমাধান।

প্রকল্পটির সমর্থকরা মনে করছেন, এটি প্রজনন প্রযুক্তির এক বিপ্লবী অগ্রগতি। বন্ধ্যাত্বে ভোগা দম্পতিদের জন্য নতুন আশা হতে পারে। জটিল গর্ভাবস্থাজনিত ঝুঁকি থেকে নারীদের মুক্তি দেবে।একক অভিভাবক বা সমলিঙ্গ দম্পতিদের জন্যও সন্তান জন্ম দেওয়ার নতুন পথ খুলে যেতে পারে। জনসংখ্যা হ্রাসের সংকটে থাকা দেশগুলোতে জন্মহার বাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার হতে পারে। তবে সমালোচকরা নানা প্রশ্ন তুলেছেন। জৈবিক প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা: মাতৃগর্ভে শিশুর মস্তিষ্ক ও শরীরের বিকাশে যে জটিল হরমোনীয় ও স্নায়বিক প্রভাব থাকে, যন্ত্র দিয়ে তা পুরোপুরি অনুকরণ করা সম্ভব নয়। মানসিক বন্ধন: মা ও সন্তানের মধ্যে গর্ভাবস্থার সময় যে আবেগীয় বন্ধন তৈরি হয়, সেটি রোবটিক গর্ভে অনুপস্থিত থাকবে। শিশুর দীর্ঘমেয়াদি মানসিক বিকাশে এর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। অনেকের মতে, এটি মাতৃত্বকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করবে। সমাজের পরিবার কাঠামো ও মূল্যবোধে এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়তে পারে। যদি এ প্রযুক্তি ভুল হাতে যায়, তবে শিশুজন্ম বাণিজ্যিকভাবে শোষণমূলক বা অনৈতিক ব্যবসার দিকে গড়াতে পারে।

কাইওয়া টেকনোলজি ইতিমধ্যেই চীনের গুয়াংডং প্রদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আইনগত ও নীতিগত কাঠামো নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। কারণ এ ধরনের প্রযুক্তি শুধু বৈজ্ঞানিক নয়, বরং গভীরভাবে সামাজিক ও নৈতিক প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, আন্তর্জাতিক স্তরে নতুন আইন প্রয়োজন হবে যাতে প্রযুক্তি ব্যবহারে অপব্যবহার না ঘটে। বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্রে কৃত্রিম জরায়ু নিয়ে পরীক্ষামূলক গবেষণা নতুন নয়। জাপান, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা আগে থেকেই প্রাণীর ওপর এ ধরনের প্রযুক্তি পরীক্ষা চালিয়েছেন। তবে সেগুলো কখনো পূর্ণ মানবগর্ভধারণে ব্যবহার করা হয়নি। ফলে চীনের এই ঘোষণা কেবল প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, বরং এক নতুন সামাজিক বাস্তবতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

চীনের এই ‘গর্ভধারণকারী রোবট’ প্রকল্প নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। এটি যদি সফল হয়, তবে বন্ধ্যাত্ব সমস্যার সমাধানে, জনসংখ্যা নীতি বাস্তবায়নে এবং নারীদের জন্য বিকল্প মাতৃত্বের সুযোগ তৈরি করতে অসাধারণ অবদান রাখতে পারে। তবে একই সঙ্গে এটি নিয়ে যে প্রশ্ন ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, তা উপেক্ষা করার মতো নয়। মানবজীবনের সূচনা, মাতৃত্বের মানসিক অভিজ্ঞতা এবং শিশুর শারীরিক-মানসিক বিকাশ-এসব বিষয়ে এখনো বিজ্ঞানের কাছে স্পষ্ট জবাব নেই। তাই এই প্রযুক্তি বাস্তবে কার্যকর করার আগে বিশ্বকে বড় ধরনের নৈতিক ও সামাজিক আলোচনার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। বলা যায়, এই ঘোষণা কেবল এক প্রযুক্তির নয়, বরং ভবিষ্যতের সমাজ, পরিবার ও মানবতার প্রকৃতি নিয়ে নতুন বিতর্কের সূচনা করেছে।

শেয়ার করুন