ইউনেস্কো হেরিটেজ সুন্দরবন সংলগ্ন বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত শহর সাতক্ষীরা ক্রীড়া সংস্কৃতির পাদপীঠ অপার সম্ভাবনাময় বললে অত্যুক্তি হবে না। মধুফল আম, কুল, বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন, হরেক রকমের সুস্বাধু মাছের জন্য সুখ্যাত সাতক্ষীরা অবিভক্ত ভারত সাম্রাজ্যের সময় থেকেই এতদাঞ্চলে অনেক গুণীজন উপহার দিয়েছে। সুদূর অতীতকেই যদি বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে স্মরণ করবো দীর্ঘসময় ধরে বাংলাদেশের স্প্রিন্ট কুইন শিরিন আক্তার সাতক্ষীরার গর্ব, বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল অঙ্গনের সাবিনা খাতুন, আফাইদা খন্দকার দুই জ্বলজ্বলে নক্ষত্র, বিশ্ব ক্রিকেট অঙ্গনকে আলোকিত করা মুস্তাফিজুর রহমান, সৌম্য সরকার বা হলে-মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর কথা সবার জানা। এ শহরের তায়েব হাসান শামসুজ্জামান খ্যাতনামা ফিফা রেফারি। সংস্কৃতি অঙ্গনের সাবিনা খাতুন, আফজাল হোসেন কাকে রেখে কার নাম বলবেন। এ শহরের মানুষ কতটা অতিথিপরায়ণ তার প্রমাণ পেয়েছিলাম ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। দীর্ঘ ৫০ বছর পর ২০২২ সুযোগ হয়েছিল স্মৃতির শহর সাতক্ষীরা সফরের সাতক্ষীরা ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার ফোরামের আমন্ত্রণে অতিথি হিসেবে। উপলক্ষ ছিল সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামে ওদের একটি অনুষ্ঠানে দেশের খ্যাতিমান ধারাভাষ্যকার শামসুল ইসলামসহ যোগদান করার। শেষ মুহূর্তে ব্যস্ত না হলে হয়তো ধারাভাষ্যের কিংবদন্তি আলফাজ আহমেদ যোগদান করতেন। এ সময়ে সীমান্ত এলাকা ভাদড়ায় মুষলধারার বৃষ্টির মধ্যে একটি ফুটবল ম্যাচে ১৫ হাজার দর্শক কাক ভেজা হয়ে খেলা দেখতে দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়েছিলাম। ২০২৪ জুন মাসে আরেক অনুজ ধারভাষ্যকার কামরুজাম্মানকে নিয়ে আবারও গিয়েছিলাম সাতক্ষীরা সফরে। এবারেও আলফাজ ভাই শেষ মুহূর্তে অসুস্থ হয়ে পড়ায় যেতে পারেননি। আমার সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম স্বর্ণকন্যা যুক্তরাষ্ট্রে একটি নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০ শতাংশ বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি অধ্যনরত মীম নওশীন নাওয়াল খান ছিল। আবারও ভাদ্রা মাঠে খেলার ধারা বিবরণী। আবারও ভোমরা স্থলবন্দর পরিদর্শন আর সাতক্ষীরা ক্রীড়াভাষ্যকারদের সঙ্গে নিয়ে সাতক্ষীরা থেকে শ্যামনগর পরিদর্শন।
আমি কিন্তু ২০ বছর দেশের বাইরে। থাকি বিশ্বের অন্যতম সুন্দর দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়ার নানা দেশে কাজ করা এবং ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। ক্রিকেট ফুটবলসহ নানা খেলা দেখেছি, দেখছি নিয়মিত। এখন কুইন্সল্যান্ডের গোল্ড কোস্টে থাকি। অস্ট্রেলিয়ার সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে স্বল্প খরচেই সাগর, পাহাড়, বন বনানীর মধ্যে বিচরণ করতে পারি। তবুও বলবো সাতক্ষীরা থেকে শুরু করে খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, পটুয়াখালী, পায়েরা অঞ্চলকে বিশ্বের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসাবে গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে।
আমি জানি, আজ সাতক্ষীরায় ক্রীড়া ভাষ্যকার ফোরামের নবনির্বাচিত কমিটির অভিষেক অনুষ্ঠানে দেশের খ্যাতিমান এবং বরেণ্য ব্যক্তিদের সমাবেশ হবে। সেখানে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক, খ্যাতিমান ধারাভাষ্যকার আলফাজ ভাই, শামসুল ইসলামসহ অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির সমাবেশ হবে। আমি সবার উদ্দেশে কিছু সবিনয় নিবেদন করবো।
সাতক্ষীরার খেলোয়াড় এবং ক্রীড়াবিদদের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রমাগত অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সাতক্ষীরায় বিকেএসপির একটি শাখা স্থাপন করা যেতে পারে। সাতক্ষীরায় আধুনিক সুবিধা সংবলিত একটি স্পোর্টস কমপ্লেক্স গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। সাতক্ষীরা প্রশ্ন বিসিবি এবং বিএফএফের সঙ্গে সমন্বয় করলে যৌথভাবে একটি ক্রিকেট এবং ফুটবল একাডেমি হতে পারে।
যেহেতু আজ অনুষ্ঠানটি ক্রীড়া ভাষ্যকার ফোরামের। ওদের কথা বলবো। আমি নিয়মিত সাতক্ষীরায় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন খেলার ধারাবিবরণী শুনি ওদের কণ্ঠে ১২ হাজার মাইল দূর থেকে। ধারাভাষ্য একটি শিল্প। আলফাজ ভাই, শামসুল ইসলাম, কামরুজাম্মান, জামিলুর রহমান, বোরহানের কণ্ঠগুলোর মতো ওয়ালিউল ইসলাম বা মিলন সুললিত কণ্ঠে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা খেলোয়াড়দের জাগিয়ে তুলছে সৃষ্টি সুখের উন্মাদনায়। আমি অনুরোধ করবো বিটিভি এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন যেন বাংলা ধারাভাষ্যকে শিল্পের মর্যাদা দিয়ে শিল্প হিসেবে বিকাশের সুযোগদান করে। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ জানাবো সাতক্ষীরা ধারাভাষ্যকার ফর্মকে যেন স্টেডিয়াম এলাকায় একটি স্থান দেওয়া হয় এবং প্রশাসনিকভাবে যতটুকু সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন প্রদান করা হয়। যেহেতু এখানে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা আছেন তাই বলছি।
সাতক্ষীরার অন্যতম সমস্যা দুর্বল বেড়িবাঁধ। প্রতি বছর বন্যায় সাতক্ষীরার কিছু অঞ্চল বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অবশ্যই স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে বন্যায় ফসলহানি, মৎস্যসম্পদ রক্ষার ব্যবস্থা করা সম্ভব। একসময় সাতক্ষীরার প্রাক্তন জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসান অস্ট্রেলিয়ায় প্রশিক্ষণ সফরে আসলে আলাপ হয়েছিল। সাতক্ষীরা থেকে খুলনা হয়ে বাগেরহাট পর্যন্ত একটি মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করলে শুধু বন্যা প্রতিরোধ না সুন্দরবন অঞ্চলে ইকো ট্যুরিজম সুবিধা সম্প্রসারিত হবে। সাতক্ষীরা থেকে শ্যামনগর সড়কটিও ব্যাপক উন্নয়নের দাবি রাখে। সড়কসংলগ্ন প্রতিটি উপজেলার রয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভাবনা।
সাতক্ষীরায় আমি ফ্লোটিং সৌরবিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা দেখেছি। গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হলে ব্যাপক শিল্পায়ন হতে পারে। খেলাধুলা নিয়ে সূচনা আলাপের। তাই শেষ করবো সেটি দিয়ে। আশা করি, জাতীয় পর্যায়ে উজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতি হিসেবেই সাতক্ষীরায় আধুনিক স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্রীড়া কমপ্লেক্স এখন সময়ের দাবি। আশা করি, সবার সমন্বিত প্রয়াসে সাতক্ষীরার বহুমুখী সম্ভাবনা বাস্তবায়নে দেশ সমৃদ্ধ হবে।