৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:৪২:১৫ অপরাহ্ন


ভূ-রাজনৈতিক হিসাবই পাল্টে দিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৯-২০২৫
ভূ-রাজনৈতিক হিসাবই পাল্টে দিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি


‘সংস্কারের জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ হোন, এই সুযোগ আর আসবে না, সংস্কার না হলে আপনার বংশধররা আটকে যাবে।’ দেশের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় গভীর সংস্কার ছাড়া স্বৈরাচারী শাসন আবার ফিরে আসার আশঙ্কা থেকেই যাবে।’ ‘কেবল ওপরে প্রলেপ নয়, আমাদের চাই ভেতর থেকে পরিবর্তন মনোজগত ও ব্যবস্থার গভীর সংস্কার।’ মাত্র কয়েকদিন আগেও এমনটাই বলতেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আর এখন বলেছেন, ‘নির্বাচনের কোনো বিকল্প ভাবলে তা হবে জাতির জন্য বিপজ্জনক। ’কিন্তু এখন কেনো ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কণ্ঠে আশঙ্কার কথা? কেনো এভাবে দ্রুত নির্বাচনের পথে হাঁটছেন তিনি? এসব নিয়ে নানান প্রশ্ন রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘুরপাক খাচ্ছে। 

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সর্বশেষ বার্তা

সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে জাতীয় নির্বাচন যথাসময়ে আয়োজনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সতর্ক করে বলেছেন, নির্বাচনের কোনো বিকল্প ভাবলে তা হবে জাতির জন্য বিপজ্জনক। জানালেন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে উৎসবমুখর পরিবেশে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

কিন্তু কেনো এই আশঙ্কা?

কারো কারো মতে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কণ্ঠে যখন এই আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে তখন বাংলাদেশসহ বিশ্বে অনেক ঘটনা ঘটছে খুবই দ্রুত। এর অন্যতম একটি বড়ো ঘটনা হচ্ছে ভূ-রাজনৈতিক। কারো কারো মতে, এই ভূ-রাজনৈতিক হিসাব নিকাশই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত পালটে দিয়েছে। এবং ভবিষ্যতও সে-ই হিসাবে চলবে। কূটনৈতিক মহলের একটি সুত্র জানায়, ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন দ্রুত নির্বাচন দিয়েই সরে যেতে যান। কেননা খোদ আমেরিকার এখন গভীর মনোযোগ বাংলাদেশকে নিয়ে। আমেরিকার থিংক ট্যাঙ্ক মনে করেন, বাংলাদেশে এখন দ্রুত নির্বাচন দিয়ে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। তা না হলে ভূ-রাজনৈতিকভাবে দেশটি যে পরিস্থিতি তেরি হবে তা-তে অনেক জটিলতা সৃষ্টি করবে। এছাড়াও সূত্রটি আরো জানায় যে, প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসছেন তখন বিশ্বে এক নতুন মেরুকরণে দিকে ধাবিত হচ্ছে।

তা হচ্ছে, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলন। যেখানে অংশ নিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অন্তত ২০ বিশ্বনেতা। আরও ঘটনা প্রবাহে দেখা যায় যে, দেশকে পরম বন্ধু হিসেবে কাছে টেনে নেওয়া হয়েছিল, তার কাছে ’দাগা’ খেয়ে এখন সেই দেশের পথে পা বাড়ালেন নরেন্দ্র মোদি যে দেশকে এক সময় চরম শত্রু হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। দেশটি হচ্ছে প্রতিবেশী চীন। প্রায় সাত বছর পর সেই দেশে যাওয়া নিয়েও ভূ-রাজনৈতিক হিসাব পাল্টে দিচ্ছে। আর এত্তোসব ঘটনা ঘটেছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাশিয়া থেকে তেল কেনার পরিণতি। বলা হচ্ছে শাস্তি হিসেবে ভারতের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করার কারণে মার্কিন মুল্লুক থেকে তারা সরে গেছে। কিন্তু তেল কিংবা শুল্কের হিসাব যা-ই থাকুক না কোনো এর ধাক্কা বাংলাদেশে যে পড়বে এবং তা যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর বর্তাবে সেটি মাকির্নীরাও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কাজেই দ্রুত নির্বাচন দিয়ে আপাতত বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল অবস্থান দেখতে চায় খোদ আমেরিকা। এমন আভাসটি আরও স্পষ্ট হয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত (চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স) ট্র্যাসি এন জ্যাকবসনের বক্তব্যে। তিনি দৃঢতার সাথে বলেছেন, ‘অনেক গুজব ও ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই আমি স্পষ্ট করতে চাই, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অবস্থান কী। আমরা অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগকে সমর্থন করি, যাতে আগামী বছরের শুরুতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।’ গত বছরের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই প্রথম সিইসির সঙ্গে বৈঠক করলেন মার্কিন দূতাবাসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।

দেশের ভেতরেও তিক্ততা

এদিকে দেশের ভেতরেও ড. মুহাম্মদ ইউনূস-কে নিয়ে নাগরিক সমাজেও নানান ধরনের তিক্ততা দেখা দিয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর সোমবার রাজধানীর হোটেল লেকশোরে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশ রিফর্ম ওয়াচ’ নামে নতুন উদ্যোগের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সঞ্চালনা করতে গিয়ে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক এবং গবেষণা সংস্থা সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আমরা সকলেই যে সহানুভূতি, ভালোবাসা ও ভক্তি নিয়ে ছিলাম, সেখানে কোথায় যেন একটা মোহভঙ্গ হয়েছে। অপরদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, দেশে চলমান সংস্কার উদ্যোগে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পরিবর্তন আনা সাধারণ মানুষকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। পুরো জিনিসটা যমুনার (প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন) দেয়ালের মধ্যে আটকে আছে। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরেরও বেশি সময়ের মাথায় মানুষের আকাঙ্খার জায়গা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, এর একটা খতিয়ান নেওয়া জরুরি বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। কারো কারো কারো মতে দেশের ভেতরে নাগরিক সমাজের শক্ত জায়গা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তাদের এমন অবস্থান ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ভাবিয়ে তুলছে বলে কারো কারো ধারণা। 

শেষ কথা

বিশ্লেষকদের মতে, ভূ-রাজনৈতিক হিসাব নিকাশ বিশেষ করে আমেরিকার দৃঢ় ইচ্ছার পাশাপাশি দেশের ভেতরে দিনের পর দিন ফুসে উঠা পরিস্থিতি রাজনৈতিক অঙ্গনে সব হিসবা পাল্টে দিচ্ছে। মূলত এসব কারণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন দ্রুত নির্বাচনের পথেই হাঁটতে বাধ্য হয়েছেন। অন্যদিকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে গত দু’দিনে নানান ধরনের গুজবের মধ্যেই সোমবার দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসিরউদ্দিনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ((চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স) ট্র্যাসি এন জ্যাকবসনের বৈঠকও বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ। আবার দেখা গেছে কয়েকদিন আগে পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে বলতে শোনা গেছে যে, এনসিপির কথায় কিছু যায় আসে না, ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। তিনি জানান ফেব্রুয়ারিাতে নির্বাচন হবে না এটি কোনো রাজনৈতিক দলের বক্তব্য। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময় আগামী ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে’, যোগ করেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। 

তা না হলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম কি করে এত্তো জোর গলায় বলে ফেলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখের আগেই হবে, কোন অপশক্তি এবং ষড়যন্ত্র এটি প্রতিহত করতে পারবে না। দ্রুত নির্বাচনের পরিস্থিতি এখন এতো দ্রুত বদলাচ্ছে যে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই জাতীয় সনদের খসড়া চলতি সপ্তাহের মধ্যে চূড়ান্ত করতে গেলেও সনদ তথা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে, তা জুলাই সনদে উল্লেখ থাকছে না। রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আলাদা সুপারিশ তুলে ধরবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বাস্তবায়ন পদ্ধতি জুলাই সনদের অংশ হবে না, যা নির্দেশ করে সার্বিক পরিস্থিতি এখন দ্রুত নির্বাচনের পথে। ফলে দেখা যাচ্ছে দেশের ভেতর বাহির ছাড়াও ভু-রাজনৈতিক হিসাব নিকাশ এখন ড. প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের দিকে ধাবিত করছে।

শেয়ার করুন