২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০৭:৩৬:১৬ অপরাহ্ন
শিরোনাম :


টার্গেট বিএনপিকে ঘায়েল
বেইনসাফিদের ইনসাফ কায়েমের খায়েশ
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০৩-২০২৩
বেইনসাফিদের ইনসাফ কায়েমের খায়েশ


‘ন্যাশনাল কমিটি ফর সিভিল রাইটস জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি’র আহ্বায়ক কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার এর যে প্রস্তাবনা- জাতীয় সরকার গঠনের, নির্বাচনের পূর্বে এমন কথায়, বিএনপির কর্ণপাত না করলেও চলতো। প্রতিটা নির্বাচনের আগে দেশের শীর্ষ দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরেও বহু গুণিজনের শুভ বুদ্ধির উদয় ঘটে। দেশের স্বার্থে তাদের চেতনা বৃদ্ধি পায়। সারা বছর এমনকি বড় কোনো দুর্যোগেও সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে তাদের কোনো উদ্যোগ বা খবর না থাকলেও জাতীয় নির্বাচনের আগে তাদের দেশপ্রেম দেখানোর অভিপ্রায় ঘটে। এটা মন্দ নয়। কারণ এ সময় বড় রাজনৈতিক দলগুলো কিছুটা নমনীয় ও দুর্বল থাকে। তখন তাদের ওই দুর্বলতার সুযোগটা গুণিজনেরা নিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। 

প্রশ্ন সেখানে নয়, এমনটা হতেই পারে। কারণ দেশের একজন নাগরিকের তার চিন্তা চেতনার প্রস্ফুটিত ঘটানোর অধিকার সংবিধানে দেয়া। এখন কে কোন উদ্দেশ্যে দেবে, আর সাধারণ মানুষ সেটা কিভাবে গ্রহণ করবে সেটাই মুখ্য। 

তবে ইনসাফ কমিটির উত্থান বা খোলস ছেড়ে বাইরে আসা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যাথা না থাকলেও বিএনপি অনানুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বা ঘটিয়েছে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন, সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদকে বহিষ্কার করে। তিনি কমিটির সদস্য সচিব বলেই বিএনপির এ নিয়ে কিছুটা হলেও মাথা ঘামানোর প্রয়োজন ঘটেছে। 

ফরহাদ মাজহার বলেছেন, তার কমিটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক। এটা সত্যি। অরাজনৈতিকই তো হবে। রাজনৈতিক দল করতে হলে তো জনসমার্থনের প্রয়োজন রয়েছে। সেটা তিনি পাবেন কোথায়? তার তো রাজনৈতিক দল নয়। ২০১৩ সনে এ ইনসাফ কমিটি জনসম্মুখে আনলেও ২০১৪ এর নির্বাচনে হালে পানি পায়নি। এরপর ২০১৮ সনেও তার তৎপরতা ছিল না। এবার দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পূর্বক্ষণে আবার ইনসাফ কমিটির পুনরুত্থান। তার উদ্যোগ মন্দ নয়। কিছুটা হলেও জনসমার্থন রয়েছে এমন কিছু দল যারা আবার বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত তাদের নেতাদের টেনে অনেকটা তাদের উপর দাঁড়িয়ে একটা প্লাটফর্ম করার প্রণান্ত চিন্তা করেছেন। বনানীর শেরাটন হোটেলে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে আয়োজিত নৈশভোজ ও আলোচনা অনুষ্ঠান কমিটির অঢেল অর্থেরও একটা ইঙ্গিত রেখেছে। বুদ্ধিজীবী গুণিজনরা এমনই হয়! তবে ইতিপূর্বে এসব অরাজনৈতিক মানুষেরাই ঘটিয়েছেন সব রাজনৈতিক তোলপাড়। যেমনটা ওয়ান ইলেভেনের সূত্র ধরে ফখরুদ্দিন, মঈনুদ্দিন সরকার। শেষ পর্যন্ত দেশের শীর্ষ দুই নেত্রীকে জেলের ঘানি টানতে হয়েছে। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া আজও ভুক্তভূগী। এখনও গৃহবন্দি সেই ফখরুদ্দিন- মঈনুদ্দিনের আমলে দেয়া মামলায়। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দেশছাড়া যুগকাল ধরে। এটাও সেই ফখরুদ্দিন মঈনুদ্দিনের আমলের ফসল। 

একইভাবে ফখরুদ্দিন মঈনুদ্দিনের আমলের দেয়া নির্বাচনে- ভাগ্যিস পাস করে ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। নতুবা এমন মামলায় জর্জরিত হতে পারতো আওয়ামী লীগের জাঁদলের অনেক নেতা। মামলা ছিল তাদের নামেও। আজ প্রভাবশালী অনেক রাজনীতিবিদ সে সময়ে জেল খেটেছেন। সরকার গঠন করেছেন বলেই মামলাগুলো স্তিমিত বা প্রত্যাহার হয়েছে। 

ফলে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে সব দল থেকে প্রতিনিধি নিয়ে ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের প্রস্তাবনা দেয়ার সময় এখন কেন এ নিয়ে হাজারো প্রশ্ন। যখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বারবার বলছে সংবিধান অনুসারেই নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন হবে। সেখানে জাতীয় সরকারের ফর্মুলা কেন মেনে নেবেন ক্ষমতাসীনরা? এটা মেনে নেয়া মানেই দীর্ঘ থ্রী টার্ম ক্ষমতায় থেকে যে উন্নয়ন ও দেশকে এগিয়ে নিয়েছে- সে প্রক্রিয়া যে গলদ, জনসমার্থন নেই- সেটা প্রমণিত হবে। তাছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ সরকার পরিচালনায় কোনো ব্যর্থতা বা বেইনসাফি কী তুলে ধরেছে ইনসাফ কায়েম কমিটি? কেন ইনসাফ কায়েমের খায়েশ? তাহলে এমন প্রস্তাবনা এবং সেটা শুধুই বিএনপির নেতা ও বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে থাকা নেতৃবৃন্দকে খাওয়ানো ফর্মূলা ছাড়া আর কিছুই না? 

বিএনপির সন্দেহ এখানেই। বিএনপির চলমান অহিংস আন্দোলন যখন চরম আকার ধারণ করেছে তখনই বিএনপি ও বিএনপির সমমনাদের দুর্বল করে দিতেই এমন জাতীয় সরকারের ফর্মুলা নিয়ে আসা বলে বিএনপির নেতৃবৃন্দ মনে করেন, যা বিভিন্নভাবে তারা বলেও যাচ্ছেন। বিএনপি বছর বছর ধরে বলে আসছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া তারা নির্বাচনেই যাবে না। স্রেফ এক দাবি। সেখানে জাতীয় সরকারের ফর্মুলা বিএনপির হজম করা মানে, বিএনপির চলমান আন্দেলন শেষ হয়ে যাওয়া ও দীর্ঘ আন্দোলনে (বিএনপি মহাসচিবের দাবি মোতাবেক) যেখানে ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা। আন্দোলন করতে যেয়ে যেসকল নেতা কর্মী নিহত হয়েছেন তাদের রক্তের সঙ্গে বেইমানী, এমন কী সাধারণ মানুষের যে ভোটের আন্দোলন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন যেটা বিএনপি করছে বলে বিএনপি দাবি করছে- তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। বিএনপি কী সাধারণ জনগণের সঙ্গে এমন প্রতারণা করবে? তাছাড়া দলটির শীর্ষ দুই নেতার একজন গৃহবন্দি আরেকজন বাধ্য হয়ে পরবাসে। সে দল কেন এমন সমঝোতায় যাবে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থেকে? 

শওকত মাহমুদ প্রসঙ্গ  

শওকত মাহমুদ একজন ট্যালেন্ট ও বিচক্ষণ সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতা। একই সঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানের মত গুরুত্বপূর্ণ এক পদে অধিষ্ঠ ছিলেন। দলের নেতাকর্মীদের দুঃখ কষ্ট তার চেয়ে ভাল কে বুঝবেন। চলমান আন্দোলন করতে যেয়ে গত ওয়ান ইলেভেন থেকে বিএনপির নেতাকর্মীরা চরমভাবে নিগৃহিত। মামলা মকদ্দমায় জর্জরিত, গৃহহীন। ব্যবসা ও চাকরিচ্যুত অনেকেই। যারা কোনো রকম মানবেতর জীবন যাপন করছে। ক’দিন আগেও বিভাগীয় সম্মেলনগুলোতে অংশ নেয়ার ফলে অনেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার খবরও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তাহলে সে দলের একজন শীর্ষ নেতা কিভাবে দলের নীতির বাইরে যেয়ে সমঝোতার ‘জাতীয় সরকারের’ ফর্মুলা নিয়ে দাঁড়াতে পারেন। তাছাড়া বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব জানিয়েছে শওকত মাহমুদ এ ব্যাপারে বিএনপির সঙ্গে আলাপ করেনি ও অনুমতিও নেয়নি। তাহলে দলের এতবড় একটা পদে থেকে দলের নীতির বিরুদ্ধে যেতে পারেন। এটা তো স্পষ্ট যে শওকত মাহমুদের মত আরো অনেকেরই সমঝোতার পথে যাবার দীর্ঘ খায়েস বলে রাজনৈতিক পাড়ায় খবর ভাসছে অনেক দিন থেকেই। 

শওকত মাহমুদের এমন দলের নীতির বাইরে যেয়ে হিরো হওয়ার অভিলাস নতুন নয়। গত বছরের এপ্রিলে শওকত মাহমুদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল বিএনপি। তখনো দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ তোলা হয়েছিল। তিনি পেশাজীবী সমাজের ব্যানারে একটি সমাবেশ ডেকে সরকার পতনের ডাক দিয়েছিলেন। সেই পটভূমিতে তখন ওই সমাবেশের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক ছিল না বলে দলটির নেতারা বলেছিলেন।

এরও আগে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরেও ঢাকায় এ ধরনের দুটি বড় জমায়েত করে রাস্তায় নেমেছিল জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল ও পেশাজীবী পরিষদ । এরও নেতৃত্বে ছিলেন শওকত মাহমুদ। তখনো তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল বিএনপি। বারবার দলের শৃংখলা বহির্ভূত কর্মকান্ড করার ফলে এবার দলের প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে সর্বস্তরের সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। সর্বশেষ ইনসাফ কমিটির কার্যকলাপে এটাই প্রাপ্য ছিল তার বলে মনে করছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। 

বিএনপি এমন বহু ত্যাগী নেতাও যারা বিপদগামী হয়েছিলেন ইতিপূর্বে তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দৌজা চৌধুরী, মেজর মান্নান, সদ্য প্রয়াত নাজমুল হুদা, কর্নেল ওলির মত নেতাও বিএনপিতে টেকেনি। শওকত মাহমুদ তো তার চেয়ে অনেক নিচুস্তরের নেতা। বিএনপি থেকে সরে যাওয়াদের প্রসঙ্গ সাধারণ মানুষ বেশ ভালই জানেন। বিএনপি কোন অবস্থানে সেটাও সাধারণ মানুষের জানা। ফলে দলে বিপদগামীদের দূরে সরিয়ে রাখাই শ্রেয়। এরা দলের কোমলমতি ও নিবেদিত নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত করতেই পটু জেনেই বিএনপি সম্ভভত বহিস্কার করেছে শওকত মাহমুদকে।   

সব দলের প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সরকারের প্রস্তাবনা 

জাতীয় সরকারের প্রস্তাব বিএনপিই দিয়ে রেখেছে। সেটা নির্বাচনের পর। নির্বাচনে যদি বিএনপি ও সমমনা দল জয়ী হয়, তাহলে যারা বিএনপির সঙ্গে মাঠের লড়াইয়ে কাধে কাধ মিলিয়ে ছিলেন, তাদেরকে নিয়ে বিএনপি সরকার সাজাবে। তাহলে নির্বাচনের আগে কেন ‘জাতীয় সরকার’ প্রস্তাবনা? এটা নিছক কোনো ভাওতাবাজী বা এর পেছনে ক্ষমতায় যেতে অভিলাষ এক শ্রেণীর দলের অভিপ্রায় রয়েছে। দেশে এমন কিছু দল রয়েছে তারা নাম স্বর্বস্ব। আবার এমন কিছু দল রয়েছে যারা স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। বর্তমান সরকার এদের চিহ্নিত করে সকল ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে সিস্টেমে বিরত রাখছেন। যাদের মাঠের আন্দোলনে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ফলে এমন স্বাধানীতা বিরোধী শক্তি এর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে ফাকফোকরে ক্ষমতা ভোগ করা নাম সর্বস্ব দলের ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যেতে বা রাজনীতির মাঠে দাঁড়াতে কারো না কারো ভর করতেই হবে। কিন্তু দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন পরাশক্তি এসব দলের নেতা বা দলকে প্রশ্রয় দেয়াটাকে সাপোর্টও করেন না। এদের নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতি স্পষ্ট। বিএনপিও নীতি বদলে ফেলেছে। ফলে সবাইকে ছেড়ে বিএনপি এখন এককভাবেই আন্দোলন করছে। এরপরও মাঠে যারা বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে বা বিএনপির দেয়া কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে তাদের জন্য নির্বাচনে জয়ী হলে জাতীয় সরকারে রাখার ওই আগের ঘোষণা।

ফলে স্বাধীনতা বিরোধী এবং বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতা ভোগ করা দো’দেল মনের দল (যারা প্রতিনিয়ত দোদুল্যমান, সুবিধা পেলে সেদিকে ঝুতে যায়) এদের সঙ্গে বৃহৎ কোনো শক্তির (বিএনপি ও আওয়ামী লীগ) যোগসাযোগ নেই। এটাতে তারা অনেকটাই সাইটলাইনে। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এদেরও থাকতে পারে নানা রকম তৎপরতা। সব দলের প্রতিনিধি নিয়ে ‘জাতীয় সরকার’ হলে ওইসব দলের প্রতিনিধি অটো চলে আসে। এছাড়াও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে পারে সুশীল সমাজের নামধারী কিছু মওসুমী ব্যাক্তিবর্গও। আওয়ামী লীগ এদের ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক। এবার সে পথে বিএনপিও। 

জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এমনি মুহূর্তে এসব মৌসুমি বুদ্ধিজীবী ও পরগাছা রাজনীদিবিদদের এবার কিছুটা অবজ্ঞার চোখেই দেখছে সাধারণ মানুষও বৈকি! 

শেয়ার করুন