২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০২:৫১:৩১ অপরাহ্ন


ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পুনরাবৃত্তি চলেছে
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৫-০৪-২০২৩
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পুনরাবৃত্তি চলেছে


দেশে মার্চে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে মতামত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে হুমকি ও হামলা, কারা হেফাজতে মৃত্যু, সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংসতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেড়েছে। এসব তথ্য উঠে এসেছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)-এর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে দেয়া গত মাসের রিপোর্টে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। 

এমএসএফের মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদন মার্চ ২০২৩-এ বলা হয়েছে যে, এ মাসেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, তাদের পরিচয়ে অপহরণ, গ্রেফতার এড়াতে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে মৃত্যু ও নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটেই চলেছে। প্রাপ্ত তথ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ধর্ষণসহ নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা অনেকাংশে বেড়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অন্যদিকে রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা কিছুটা কম হলেও নির্বাচনি সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে মতামত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে হুমকি ও হামলা, কারা হেফাজতে মৃত্যু, সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংসতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেড়েছে, সীমান্তে হতাহতের মতো ঘটনা কমেছে। এ মাসে একাধিক বাণিজ্যিক ভবনে বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা জনমনে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে গণপিটুনির মতো ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই ঘটনাগুলো ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিচার ও ভুক্তভোগীদের সুবিচার দাবি করছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধ, গোলাগুলিসংক্রান্ত  রিপোর্টে বলা হয় দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী মার্চ ২০২৩ মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন একজন, এ ঘটনায় অপর একজন গুরুতরভাবে গুলিবিদ্ধ হন। আরেকটি ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন একজন কথিত ডাকাত ও একজন পুলিশ সদস্য, আহত হয়েছেন পুলিশের অপর তিন সদস্য। অন্যদিকে গ্রেফতার হয়েছেন পাঁচ ডাকাত সদস্য। 

মার্চ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে একজন নারীসহ দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে আসামির মৃত্যুর বিষয়টি অনাকাক্সিক্ষত ও অগ্রহণযোগ্য। এর বিস্তারিত জানাতে গিয়ে তুলে ধরা হয় ১৩ মার্চ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পুলিশ হেফাজতে পুলিশের গাড়িতে করে নরসিংদী কারাগারে নিয়ে যাওয়ার পথে অসুস্থ হয়ে পড়লে অনুমান দুপুর একটার দিকে সিরাজ মিয়াকে ভুলতা আল রাফি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। অন্যদিকে ২২ মার্চ সকালে সুলতানা জেসমিন তার কর্মস্থল নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে যাওয়ার পথে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মুক্তির মোড় এলাকা থেকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে র‌্যাবের সদস্যরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। তাকে কোথায় বা র‌্যাবের কোন ক্যাম্পে নেয়া হয়েছে তা স্বজনদের জানানো হয়নি। দুপুর ১২টার পর তারা জানতে পারেন, সুলতানা নওগাঁ সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সেখানে র‌্যাব সদস্যরা উপস্থিত ছিল কিন্তু সুলতানা কোনো কথা বলতে পারছিলেন না। এর পরই তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩১ মার্চ সকালে তার মৃত্যু হয়। সুলতানার সন্তান শাহেদ হোসেন সৈকত জানান, র‌্যাব হেফাজতে থাকা অবস্থায় তার মায়ের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে ফলে তার মৃত্যু হয়েছে। এ বিষয়ে র‌্যাব ৫-এর দাবি সুলতানার বিরুদ্ধে আর্থিক প্রতারণার ও তার ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুক্তির মোড় এলাকা থেকে র‌্যাব হেফাজতে নেওয়া হয়। আটকের পরপরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। নওগাঁ সদর হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে রাজশাহীতে নেওয়া হয়। ৩১ মার্চ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্ট্রোক করে তিনি মারা যান বলে দাবি করা হয়।

এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী মার্চ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার তিনটি অভিযোগের ঘটনায় ও ঢাকা থেকে অপহৃত হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে উদ্ধার হয় যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। 

ঘুষ ও অপতৎপরতার অভিযোগ

এ মাসে পুলিশি অভিযানে এক জনের মৃত্যু, পুলিশি গুলিবর্ষণ ও পুলিশ কর্তৃক নির্যাতনে এক যুবক গুরুতর আহত ও বেশ কয়েকটি প্রতারণার অভিযোগ অভিযোগ উঠেছে।

রাজনৈতিক সমাবেশে যোগদানে বাধা 

মার্চে বিরোধীদল বিএনপি ও বিরোধীদলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বলপ্রয়োগ, শান্তিপূর্ণ সভা, মিছিলে বাধাদান অব্যাহত ছিল। এ মাসে রাজনৈতিক, নির্বাচনি সহিংসতা ও সভা সমাবেশে বাধার ৩১টি ঘটনায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৩৮৯ জন। মার্চ, মাসে গণমাধ্যমে সূত্র অনুযায়ী নির্বাচনি, রাজনৈতিক সহিংসতা ও সভা-সমাবেশে বাধার ঘটনায় মোট ৩৮৫  জন আহত ও ৫ জন  নিহত হয়েছেন। নিহত ৫ জনের মধ্যে  ৩ জন ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্দ্বন্দ্বে ও ২ জন ইউপি নির্বাচনি সহিংসতায় মারা গিয়েছেন। এ মাসে পাঁচটি রাজনৈতিক মামলার মধ্যে বিএনপির বিরুদ্ধে ২টি, জামায়েত ইসলামী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ৩টি মামলা করা হয়েছে। মোট ১৭০ জন রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, যাদের মধ্যে দুই জন নারী রাজনীতিবিদও রয়েছেন। ১৯ মার্চ রাত ১টার দিকে বনানী থেকে বিএনপির ৫৫ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। দলীয় কার্যক্রমকে বেগবান করতে মমিন আলী মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের ১৪ ইউনিয়নের স্থানীয় সব প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনা সভাসহ ও নৈশভোজের সময়ে তাদের আটক করা হয়। এ মাসে রাজনৈতিক কর্মকা- চলমান অবস্থায় ১৩৭ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়, অন্যদিকে আদালতে জামিন প্রার্থনাকালে জামিন না দিয়ে ৩৩ নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ১১২ জন বিএনপি ও এর সহযোগী অঙ্গসংগঠনের এবং ৫৮ জন জামায়েত ইসলামীর কর্মী। 

অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার

এ মাসেও উদ্বেগ-আতঙ্কের বিষয় অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, মার্চ ২০২৩  সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৬ জন নারী ও ২১ জন পুরুষ, মোট ২৭ জনের অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে, যা ছিল অনাকাক্সিক্ষত এবং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ। 

কারা হেফাজতে মৃত্যু

এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, মার্চ ২০২৩ মাসে কারা হেফাজতে মোট ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে। গত মাসে এর সংখ্যা ছিল ৫ জন। এ মাসে তিন জন হাজতি ও তিন জন কয়েদির মৃত্যু হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার-অপব্যবহার

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবলভাবে সমালোচিত হওয়া সত্ত্বেও এ আইনে মামলার নামে হয়রানি অব্যাহত রয়েছে ও এর যথেচ্ছ অপব্যবহারের বিষয়টি ক্ষোভ ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। কর্তৃপক্ষ বারবার এ আইনের সংশোধনের কথা বললেও সম্প্রতি আইনমন্ত্রী জানিয়েছে, বর্তমান বাস্তবতায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, মার্চ ২০২৩ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১০টি মামলায় সাত জন গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে এক জন সাংবাদিক, এক জন বিএনপি, এক জন আওয়ামী লীগ, এক জন অভিনেত্রী, দুই যুবক এবং এক জন সরকারি কর্মচারী রয়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে মামলার সংখ্যা ছিল পাঁচটি। এ মাসে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তিনটি মামলা হয়েছে, যার মধ্যে এক জন সাংবাদিক গ্রেফতার হয়েছেন। এ ছাড়া সরকারি কর্মচারী নারীটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে র‌্যাবের হেফাজতে মারা যান। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সাতটি মামলা হয়েছে সরকারের উচ্চপর্যায়ে ব্যক্তি নিয়ে ও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এ ধরনের সমালোচনামূলক পোস্ট শেয়ার-কমেন্ট করার কারণে দুটি মামলা হয়েছে প্রতারণার অভিযোগে ও একটি মামলা হয়েছে জনমনে ভীতি প্রদর্শন, জনমনে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কথিত অপরাধে। প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২ টি মামলা হয়েছে। এ আইনের যথেচ্ছ অপব্যবহারের মাধ্যমে মানুষকে তার মতামত প্রকাশে বাধাগ্রস্ত করা ও ভয় দেখানো এবং সবার মুখ বন্ধ করে দেওয়ার একটি ভয়ংকর তৎপরতা চালানো হচ্ছে। এমএসএফ এই আইনের বাতিল দাবি করছে। 

সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের অধিকারের লঙ্ঘন

সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে যেভাবে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং তাদের যেভাবে শারীরিকভাবে আক্রমণ, হয়রানি, হুমকি ও লাঞ্ছিত করা হচ্ছে তা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, বরং বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করার শামিল। স্বাধীন সাংবাদিকতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকেরা নানাভাবে হুমকি, হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যা ছিল উদ্বেগজনক। এসব ঘটনার মাধ্যমে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে।

শেয়ার করুন