২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০৫:৪৪:৪৬ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জের, বিএনপির বহিস্কার ৭৬ থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান ‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়


নেতৃত্ব চরিত্রের দুর্বলতা জাতি-সমাজ ও রাষ্ট্র চরিত্রকে প্রভাবিত করে
কামরুজ্জামান ভুঁইয়া
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০৪-২০২২
নেতৃত্ব চরিত্রের দুর্বলতা জাতি-সমাজ ও রাষ্ট্র চরিত্রকে প্রভাবিত করে


‘রাজা যদি প্রজার শত্রæ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে বড় চিন্তার কথা। মানুষ বজ্রপাতকে ভয় করে, কিন্তু রাজ ক্রোধ তো তার চেয়ে ভয়ঙ্কর। বাজ শুধু এক জায়গায় পড়ে এক জায়গার অনিষ্ট করে, রাজ ক্রোধ যে কতজনকে আঘাত করবে, কত লোকের সর্বনাশ করবে, তার কোনো ঠিক নেই’ -কথাটি সত্যজিৎ রায়ের কালজয়ী অমর সৃষ্টি ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রের সংলাপ থেকে উদ্ধৃত। সেখানে শিক তাঁর ছাত্রদের পাঠ দিতে গিয়ে কথাগুলো বলছিলেন। কথাটি শুধু রাজ-রাজন্য বা রাজ্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, শিল্প-সাহিত্যসহ সকল ক্ষেত্রেই নেতৃত্বের প্রশ্নে কথাটি বিবেচনায় আসতে পারে। রাজ্য ও রাষ্ট্রভিত্তিক সমাজ বিকাশ ও বিনাশের ইতিহাস দেখতে গেলে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এই কথাটির সত্যতা এবং স্যা খুঁজে পাওয়া যাবে। যে কোনো জাতি-রাষ্ট্র-সমাজ যাই বলি না কেন, তার বিকাশের ধারায় উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল, আলো-অন্ধকার, ভালো-মন্দ, সত্য-অসত্যের যুগ, কালের চড়াই-উৎরাই পেরিয়েই তবে পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ক্ষেত্রে সেই সকল সমকালীন যুগে বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সমাজ নেতৃত্বের চারিত্রিক প্রভাব সমাজ-মানসে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখে এসেছে। এই সকল নেতৃত্ব কখনো সূর্যোদয়ের মতো চারদিক আলোকিত করে আলোর বন্যা নিয়ে এসেছে। চরিত্রের আপন ঔজ্জ্বল্যের প্রভায় দেশ রাষ্ট্র-সমাজকে আলোকিত করেছে। সভ্যতাকে একটি ধাপ থেকে আরেকটি ধাপে উন্নীত করেছে। আলোয় আলোয় মানবসমাজ আলোকিত হয়েছে, মনুষ্যত্ব চেতনায় মানবসমাজ উদ্ভাসিত হয়েছে। নতুন দিনের নতুন ভাবনার সূচনা করেছে। আবার ঠিক এমনটির বিপরীতটিও ঘটেছে প্রচুর। কখনো কখনো মেঘমুক্ত শরতের নীল আকাশকে ঘন কালো মেঘে ছেয়ে দিয়েছে। আপন চরিত্রের কালো ছায়ায় আলোকিত একেকটি দিন, একেকটি যুগ, কালকে অন্ধকারে ছেয়ে দিয়েছে। কালোর কালিমায় সমাজ সভ্যতা ও মূল্যবোধকে ধাপে ধাপে অধঃগামিতায় নামিয়ে এনেছে। মনুষ্য ও মানবিক সম্ভাবনার দিগন্তকে কুয়াশায় ঢেকে দিয়ে মানবসমাজকে পিছিয়ে দিয়েছে একেকটি যুগ-কাল-শতাব্দী। নতুন দিনের নতুন নতুন সম্ভাবনা থেকে মানুষকে-অগ্রযাত্রার নব নবজাগরণ থেকে সমাজকে বঞ্চিত করেছে। দেশ-রাষ্ট্র নেতৃত্বে আদর্শ-অনাদর্শের এসব চারিত্রিক বৈপরীত্য দিন-রাত্রির মতন সমাজ বিকাশের ধারায় আবর্তিত হয়ে কখনো বিপুল বিক্রমে সমাজকে এগিয়ে নিয়েছে, কখনোবা জরা বন্ধ্যাত্ব ও অধঃপতনের নিম্নগামিতায় সমাজকে পিছিয়ে দিয়েছে। মানব সভ্যতা ও সমাজ বিকাশের গতিপথ প্রবাহে তার ভুরি ভুরি স্বার ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। ইতিহাস স্যা দেয়, একই সাম্রাজ্যে একেক শাসকের যোগ্যতা ও চরিত্রের ধরন এক নয়। আবার একই জাতি এবং একই রাষ্ট্রে সকল কালের জাতীয় চরিত্রের ধারাবাহিকতা একপ্রকার নয়। তাই শাসক চরিত্র এবং নেতৃত্বের ব্যক্তিচরিত্র রাষ্ট্র-সমাজের মন-মগজে অগ্রযাত্রা ও পশ্চাৎপদতায় তার একটি দীর্ঘকালের ওপর ছাপ রেখে যায়।

সুদূর অতীতের কথা না হয় বাদই রাখলাম। আমাদের বিগত অন্তত দুই শতাব্দী কালের বেড়ে ওঠা সময়ের বা জাতি-সমাজ নির্মাণের রাজনৈতিক ও সামাজিক পথপরিক্রমায় নেতা ও নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় শুভ-অশুভ মিলিয়ে অসম চরিত্রের নানা চড়াই-উৎরাই এবং বৈপরীত্য স্পষ্ট হয়ে আছে। বলা বাহুল্য, সেই সময়-কাল ও সেই সমাজকে তার দায় বহন করতে হয়েছে। রাষ্ট্র থেকে সমাজ, পরিবার থেকে ব্যক্তি পর্যন্ত তা সংক্রমিত হয়েছে। বিদ্যাবুদ্ধি, বইপুস্তক, জ্ঞানবিজ্ঞান ছাপিয়েও যে, পরিবারের প্রধান পিতা-মাতার ব্যক্তিচরিত্র সন্তানের চরিত্রে পরিবাহিত হয়, বিস্তৃত হয়, সে বিষয়ে কারো সন্দেহের অবকাশ নেই। তেমন একজন গুরুর চারিত্রিক দোষ-গুণ তা শিষ্যের মধ্যে এবং একজন শিকের ব্যক্তিচরিত্র যে ছাত্রের মধ্যে সঞ্চালিত হয়, সে বিষয়েও দ্বিমত করার সুযোগ নেই। তেমনি একটি দেশ, একটি রাষ্ট্র ও সমাজ প্রেেিত নেতৃত্বের চরিত্রও যে, জনমনে প্রভাব বিস্তার করে তা অস্বীকার করার জো নেই। তিলে তিলে গড়ে ওঠা একটি উন্নত রুচি-সংস্কৃতিসম্পন্ন সভ্য দেশ বা রাষ্ট্রও যে কেবল কোনো ণকালের আদর্শহীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্রহীন আচরণ ও চর্চার ফলে কত স্বল্পসময়ে, কত দ্রæত যে অধঃপতনের অতলে তলিয়ে যেতে পারে, তা প্রত্য করতে হয়তো বেশিদূর যেতে হবে না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি ক্রমাগত ধূর্ত চালাকি হঠকারী মিথ্যাশ্রয়ী হয়ে পড়ে এবং এর মাধ্যমে তার ফসল ঘরে তুলতে মরিয়া হয়ে ওঠে, তবে সেই রাষ্ট্র বা জাতির জন্য গণচরিত্রে তার একটি বিস্তৃত দীর্ঘমেয়াদি ছাপ পড়ে যায়। ধীরে ধীরে তা রাষ্ট্রশাসক ও জনগণ উভয়ের জন্য একটি ফলদায়ক সমঝোতার শক্তিশালী ভিত গড়ে তোলে। যার প্রভাব বলয়ে পড়ে সামাজিক নেতৃত্বগুলোর লাভধারী কিছু অংশ স্বতঃস্ফুর্ত স্বদ্যোগে, কিছু অংশ সময়ের বাস্তবতা মেনে ইচ্ছাবহির্ভূত বাধ্যবাদকতায় হলেও তাদের নিজ চরিত্র বদলে ফেলে একসাথে একে অন্যের সহযোগী হয়ে নির্বিবাদ লাভের পথ চলতে শুরু করে। যার সম্মিলিত শক্তির সামনে তখন আদর্শবাদী চিন্তা-চেতনাধারী ব্যক্তি বা সংগঠনগুলো আর শক্তি ধরে সহজে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কালো কালের কালিমায় কলঙ্কিত নিম্ন সংস্কৃতির নীচু স্তরে নেমে এসে আদর্শবাদী শক্তিটি ঠিক সমানে সমান ওদের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে না। ওই সুবিধাটুকু অধঃগামী শক্তির জন্য পোয়াবারো হয়ে ওঠে। 

আমরা জানি, কী সমাজ, কী রাষ্ট্র সর্বত্রই সেই সমাজ, সেই রাষ্ট্রের সকল মানুষ সৎ বা আদর্শের অনুসারী হয় না। সমাজ গঠনে, রাষ্ট্র সৃষ্টিতে সকলেই ত্যাগী ও নিষ্ঠাবান থাকেন না। ভালো-মন্দ, সামাজিক-অসামাজিক, ইতর-ভদ্র নিয়েই রাষ্ট্র বা সমাজ। একটি সমাজে চৌর্যবৃত্তি থাকে, অনিয়ম-অসদাচরণ, দুর্নীতি থাকে। চোর-ডাকাত, দস্যু-দুর্বৃত্তও থাকে। তাদের ক্ষিপ্রতা, হিংস্রতা থাকে। আবার একইসাথে সাধু-সন্ন্যাসী থাকে, সত্য-মিথ্যা থাকে। তাদের সততা, নিষ্ঠা, মানবিকতা, ন্যায়পরায়ণতা থাকে। তাই নিয়েই তো সমাজ। তাই নিয়েই তো রাষ্ট্র। মানব সভ্যতায় সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের শুরু থেকেই এটি একটি প্রক্রিয়াগত বাস্তবতা এবং বাস্তব সত্য। এর মধ্য দিয়েই মত-পথের সংখ্যাধিক অনুপাতে সমাজ এগিয়ে যায়, কখনো পিছিয়ে যায়। এর সাথে সাথে এটিও একটি বাস্তবতা, একজন ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, সে যতই সমাজ অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় বা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তার অশুভ শক্তি ও চারিত্রিক দোষ যতই প্রবল হোক না কেন, তা কিন্তু সমাজ দেহের সবটুকু আক্রান্ত করতে পারে না। সম্পূর্ণ সমাজের সবটুকু কলুষিত করতে পারে না, তিসাধন করতে পারে না। বরং একটি সময়ে এসে সমাজে তার একটি নেতিবাচক পরিচয়ে সে বা তারা ভিন্ন পরিচয়, ভিন্ন দৃষ্টিতে সমাজের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। যে পরিচিতি তাদেরকে সামাজিক মূল স্রোত থেকে ঘৃণাভরে দূরে সরিয়ে রাখে এবং কোনো কোনো েেত্র তারা নিজেরাই দূরত্ব বজায় রেখে চলে। কিন্তু যখনই বৃহৎ পরিসরে সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব চরিত্রের প্রশ্নটি আসবে, তখন ঠিক অমন সহজ সরলিকরণ করা যাবে না। একজন রাষ্ট্রনায়ক বা রাষ্ট্রের কর্ণধারের আচার-আচরণ, চিন্তা-ভাবনা, ব্যবহারবিধি রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও জনমানসে প্রভাব ফেলে। স্বীকার করতে হবে, একজন সমাজপতির স্বভাব চরিত্র, নিষ্ঠা-ন্যায্যতা, নীতি-নৈতিকতা সমাজ মানসে প্রভাব বিস্তার করে। সে কারণে রাষ্ট্র ও সমাজ নেতৃত্বে যিনি বা যারাই আসবেন, অবশ্যই তাদেরকে নীতি-আদর্শ, নিষ্ঠা-নৈতিকতার বিষয়ে আদর্শবাদী না হওয়ার কোনোই বিকল্প নেই। তার চারিত্রিক গুণাবলি ও দৃঢ়তা যেমন সমাজকে বিকশিত করবে, শুদ্ধতা ও অনুপ্রেরণায় উদ্ভাসিত করবে, প্রতিশ্রুত আগামীর পথ উন্মোচন করবে। তেমনি একইভাবে তার চারিত্রিক দোষ-দৈন্যতা, ব্যর্থতা, মিথ্যাচার, অন্যায়-অন্যায্যতা  সমাজ দেহে সংক্রমিত হয়ে সমাজকে কলুষিত করবে। সম্ভাবনাময় একটি আগামীর পথ অবরুদ্ধ করে দাঁড়াবে। 

আমাদের সমকালীন ইতিহাসে তার কুপ্রভাব অত্যন্ত বেশিমাত্রায় পরিলতি। এখনো যার কালো বৃত্ত থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নেতৃত্বের আদর্শবাদী চর্চা ও অনুশীলন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিশেষ করে যখন যে মতায়, সেই সব মতাসীনদের আচার-আচরণ েেত্র তা ততোটা অধিক মাত্রায় সত্যও পরিলতি। তাদের থেকে আমরা প্রতিশ্রুতি পাই, বাস্তবায়ন দেখি না। আশায় বুক বাঁধি, নিরাশাতে বেদনাহত হই। নেতৃত্ব আমাদের চরিত্র গঠন করে না, বরং যা ছিল তাও নষ্ট করে দেয়। নেতৃত্ব আমাদেরকে সহজ-সরল হতে শেখায় না, ধূর্ত চালাক হতে অনুপ্রাণিত করে। নেতৃত্ব আমাদের সত্য বলতে উৎসাহ জোগায় না, মিথ্যা ও চালাকি দিয়ে সফল হতে শেখায়। নেতৃত্ব আমাদেরকে এখন আর দেশপ্রেমে টানে না, দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ করে না, আপন স্বার্থপ্রেমে অন্ধ করে রাখে। বিশেষ করে মতাসীন নেতৃত্ব আমাদেরকে গণস্বার্থ, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতে উৎসাহিত করে না, বরং স্বৈরতন্ত্রে দীতি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। নেতৃত্ব আমাদেরকে পরমত সহ্য করতে শেখায় না, ভিন্নমত দমনে দলবদ্ধ হতে শক্তি জোগায়। সকল নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ব্যক্তিগত লোভ-লাভের নেশায় উন্মত্ত করে তোলে। এই ব্যর্থতা ধীরে ধীরে সমাজকে ভিতর থেকে দুর্বল করে ফেলে। নেতৃত্বের প্রতি মানুষ আস্থা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে। এমনকি নির্লজ্জ নেতৃত্বের লজ্জাহীনতা সমাজ দেহে সংক্রমিত হয়ে মানুষের মনোজগতে ধীরে ধীরে সহনশীল হয়ে ওঠে। 

তবে বর্তমানের এই আঁধার কালের মাঝেও আমাদের অতীত কালের আলোকময় দিনগুলো নত্রপুঞ্জ হয়ে জ্বলে। আমাদের জাতীয় মুক্তি-সংগ্রাম কালের সেই সব নেতৃত্ব আজো দূর আলোকবর্তিকা হয়ে আশা জাগায়, অনুপ্রাণিত করে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী সুভাষ বসু, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, কমরেড মণি সিং, শেখ মুজিবর রহমান- তাঁদের মধ্যে অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁদের রাজনৈতিক সততা, দেশপ্রেম, সমাজের প্রতি দায়বোধ, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আজো অনুসরণীয় হয়ে আছে। সেই সময়কালের নেতৃত্বের উচ্চতার মাপকাঠি, বর্তমান কালের নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়। নেতৃত্ব যদি নীতি-আদর্শের বাহক না হয়ে দুর্নীতি-দূরাচারের বাহক হয়ে ওঠে, নেতৃত্ব যদি সত্যের সাধক না হয়ে মিথ্যার বাহক হয়ে পড়ে, নেতৃত্ব যদি সৎ-সততার ধারক না হয়ে শঠ-ধূর্ততার ধারক হয়ে যায়, নেতৃত্ব যদি মানবতার মিত্র না হয়ে শত্রæ হয়ে ওঠে, নেতৃত্ব যদি জনস্বার্থ রা না করে গোষ্ঠীস্বার্থ রা করে চলে, তবে সেই নেতৃত্ব রাষ্ট্র-সমাজের কি প্রয়োজন? কোন শক্তি বলে তার টিকে থাকা? কেনইবা তাকে মেনে চলা? আজ আমদেরকে সেই বিষয়ে ভাবতে হবে। আজ আমাদেরকেই তার অপসারণ বা অবসান ঘটাতে হবে। কারণ আমরা মানুষের বহু রক্ত-ঘামে অর্জিত এই মানব সভ্যতাকে কোনো অসুর শক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে ছেড়ে দিতে পারি না। কোনো গোষ্ঠীচক্রের স্বার্থের কাছে সমর্পণ করে দিতে পারি না। 

রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায়, নেতৃত্বের চারিত্রিক প্রভাব রাজনীতি ও সমাজ মানসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখে থাকে। আদর্শিক নৈতিক ও সৎ নেতৃত্ব যে কোনো রাষ্ট্র-সমাজকে নীতি-আদর্শ, সততায় উৎসাহিত করে, উদ্ভাসিত করে। তাই সেই সমাজ, সেই রাষ্ট্রে তার একটি আদর্শিক ছাপও স্পষ্ট হয়ে ওঠে পরিলিত হয়। আবার ঠিক একইভাবে তার বিপরীতটিও সত্য। অপ্রিয় হলেও সেই সত্যটি আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজের চিন্তা-কর্ম, আচার-আচরণে ব্যবহৃত হতে দেখি, প্রভাবিত হতে দেখি। আমরা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বকেও দেখেছি, কীভাবে কতটা নিচে নেমে মিথ্যাচার-হঠকারিতা-ক‚টকৌশল অপকৌশল প্রয়োগে রাষ্ট্রপরিচালনা করতে। আমরা দেখেছি শুধু মতা কুগিত করে রাখতে বা কোনো কায়েমি গোষ্ঠীস্বার্থ রা করতে কতটা নির্লজ্জ, কতটা স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে। দেখেছি ধর্মীয় নিষ্ঠা সততার সাথে, ধর্মীয় নৈতিকতার সাথে শতভাগ অসঙ্গতিপূর্ণ মানুষটি, কেমন করে ধর্মের ব্যবহার করে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানোর চেষ্টা করেছে, করছে। তেমন মানুষের হাত ধরেই জাত-ধর্ম নির্বিশেষে রক্তস্নাত অর্জিত রাষ্ট্রের সংবিধানে কেমন করে ধর্মবাণী আরোপিত হয়েছে। তেমন মানুষের হাত ধরেই কেমন করে একটি ধর্মনিরপে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তিত হয়েছে। রাষ্ট্র তার সেক্যুলার চরিত্র হারিয়ে ধর্ম চরিত্র ধারণ করেছে। বড় দুর্ভাগা, বড় অসহায় জাতি আমরা, আমাদেরকে এমনটাও দেখতে হয়েছে, রাষ্ট্র নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ কেমন করে মসজিদ-মন্দিরে দাঁড়িয়ে জনসমে মিথ্যাচার করতে পারে। মাজারে দাঁড়িয়ে জনসমাবেশে বলছেন, তিনি স্বপ্নে দেখে সৃষ্টিকর্তার আদেশে অনুপ্রাণিত, জনস্বার্থে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজটি করছেন। আজ দেশ ও জাতির সকল অধঃপতন, অবয়ের পিছনে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, গণমনুষ্য চরিত্র হননে এবং জনমানসে শঠতা, ধূর্ততা, মিথ্যার প্রসারে রাষ্ট্র নেতৃত্বের চরিত্র ভ‚মিকা কতটা দায়ী, কতটা সংক্রমিত এবং তার ক্রমাগত ধারাবাহিক অপচর্চা ও আবর্তন, রুচিমান চরিত্রে, দেশ-জাতি-সমাজকে যে কতটা নিচে নামিয়ে এনেছে, তা বোঝা বা নিরূপণ করাও বোধহয় আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। সেই হীরক রাজার দেশের বাস্তবতায় এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান’-না বলে যদি আমরা বলি, রাজা তুমি ভগবান, নেই প্রশ্ন নেই বাণ। আমরা বুঝিবা সবাই হীরক রাজার মস্তিষ্ক প্রালন যন্ত্রমন্ত্রের দাপটে কেবলই অসাড় অবশ হয়ে অসহায় কৃষক ফজল মিয়া হয়ে উঠছি। আর বলছি ‘বাকি রাখা খাজনা, মোটেই ভালো কাজ না’ কিম্বা ‘ভরপেট নাও খাই, রাজকর দেয়া চাই’। যদি যন্তরমন্তর ঘরে নেয়া মস্তিষ্ক প্রলিত খনির বলরাম মজুরের ভাষায় বলতে বাধ্য থাকি, ‘যে করে খনিতে শ্রম, যেন তারে ডরে যম’ কিম্বা ‘অনাহারে নাহি খেদ, বেশি খেলে বাড়ে মেদ’। তাহলে চরিত্রহীন ওই সব সভাকবির অন্যায়-অন্যায্য শ্লোক-স্তবক কেবল বাড়তেই থাকবে। শোষণ অত্যাচারের মাত্রা সকল সীমা ছাড়িয়ে যাবে। সমাজ নষ্ট হতে হতে নষ্টদের দখলে চলে যাবে। আর তার সাথে সুবিধাভোগীদের লুটপাটের তৎপরতা বাড়তেই থাকবে। আজ সময় এসেছে নতুনভাবে ভাববার, কী ব্যক্তি, কী দেশ, কী সমাজ, কী রাষ্ট্র- সর্বত্র নেতৃত্বের চারিত্রিক শুদ্ধতা ফিরিয়ে আনতে হবে। সম্পদের য়তি হয়তো ণস্থায়ী, কষ্টসাধ্য হলেও একসময় পুষিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু চারিত্রিক স্খলন দূরারোগ্য ক্যানসারের মতন ভিতর থেকে নিঃশেষ করে দেয়। 

লেখক: কবি-সাহিত্যিক

শেয়ার করুন