২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৮:০৪:৩৮ পূর্বাহ্ন


ভারতে দালাইলামার সাথে বৈঠক: চীনের কড়া প্রতিবাদ
বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ সফরে মার্কিন প্রতিনিধি দল
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০৭-২০২৩
বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ সফরে মার্কিন প্রতিনিধি দল দালাইলামার সাথে মার্কিন প্রতিনিধি দলের বৈঠক


এশিয়া অঞ্চলে পা রেখেই গরম করে দিয়েছে বাইডেন প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল দল। সূচনায় হয়েছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক। মূলত ভারত সফর দিয়ে ওই সফর শুরু। যাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি ও মার্কিন বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত উজরা জেয়া। ভারত সফরের সূচনা করেন তারা, তিব্বতীয় ধর্মগুরু দালাই লামার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে। দালাইলামা তার টুইটারের একটা ছবি পোস্ট দিয়েছেন। যাতে দেখা যায় মার্কিন ওই প্রতিনিধি দল দালাইলামার সঙ্গে সাক্ষাতে গেলে তিনি খুবই একান্তে তাদের সমাদর করছেন। হাসিমুখে সে আতিতেয়থাও গ্রহণ করে মার্কিন প্রতিনিধি দল। গত ৯ জুলাই রোববার ওই সাক্ষাত দুই পক্ষের। কিন্তু এ সাক্ষাতের কঠোর সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেছে চীন।  

সাক্ষাতের পরের দিন ১০ জুলাই সোমবার ভারতে নিযুক্ত চীনা দূতাবাস থেকে প্রচারিত এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে কড়া ভাষায় বলা হয়েছে, তারা যেন চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিন্দুমাত্র নাক গলানোর চেষ্টা না করে। উজরা যা করেছেন, তা ‘নির্ভেজাল অপরাধ’। দিল্লিতে চীনা দূতাবাসের মুখপাত্র ওয়াং সিয়াওজিয়াং বিবৃতিতে বলেন, সিজাংকে (তিব্বত) চীনের অঙ্গ হিসেবে মেনে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেটা তাদের পালন করা উচিত। তিব্বতের দোহাই দিয়ে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো বন্ধ করুক। তিব্বতের ভারপ্রাপ্ত তথাকথিত বিশেষ কো- অর্ডিনেটর (উজরা) যা করেছেন, তা ‘নির্ভেজাল অপরাধ’। তিব্বতের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা নষ্টের চেষ্টায় তা এক রাজনৈতিক ছক। উল্লেখ্য, গত ৬ জুলাই ছিল দালাইলামার ৮৮ তম জন্মদিন। 

চায়না দূতাবাসের মুখপাত্র আরো জানান, তিব্বত পুরোপুরি চীনের ঘরোয়া বিষয়। সেখানে নাক গলানোর কোনো অধিকারই বাইরের কারও নেই। তিব্বতের স্বাধীনতাকামী শক্তিদের সঙ্গে বিদেশি কর্তাদের কোনো রকম যোগাযোগ চীন দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করে। তথাকথিত তিব্বতের সরকার এক বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠী। অবৈধও। পৃথিবীর কোনো দেশ তাদের স্বীকৃতি দেয়নি।

এখানে উজরা জেয়া তিব্বতবিষয়ক ভারপ্রাপ্ত ‘সমন্বয়ক’। ২০২১ সালে সেই দায়িত্ব পাওয়ার পরের বছর ২০২২ সালে ভারতে এসে তিনি দালাইলামার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সেবারও চীন এমনই বিরোধিতা করেছিল। 

ভূরাজনৈতিক এক পটভূমিতে ভারত সফরে এসে দালাই লামার সঙ্গে উজরা জেয়ার সাক্ষাৎ স্বাভাবিক কারণেই চীনকে ক্ষুব্ধ করেছে। চীন ঐতিহাসিকভাবেই তিব্বত সম্পর্কে স্পর্শকাতর। ভারতের সঙ্গে তাদের সীমান্ত বিরোধও ২০২০ সাল থেকে তীব্রতর হয়েছে। বুঝাই যাচ্ছে, চীন ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত অনেক কাছাকাছিতে অবস্থান করছে। 

উল্লেখ্য, দালাইলামার সঙ্গে ওই সাক্ষাতের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ছিলেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ভারপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু, ইউএসএআইডির উপসহকারী প্রশাসক অঞ্জলি কৌর ও ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেট্টি।

যে কারণে মার্কিন প্রতিনিধিদের এ সফর 

উজরা জেয়া, ডোনাল্ড লু, অঞ্জলি কৌরসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা এ অঞ্চলের সফরকে কেন্দ্র করে আলোচনা সমালোচনা চলছে। ভারত সফরে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করেছেন।

এরপরই তারা এখন বাংলাদেশ সফরে রয়েছেন (১১ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই)। এ সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে উজরা প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘আমরা সেই পৃথিবী গড়ে তুলতে চাই, যা মুক্ত, সমৃদ্ধশালী, নিরাপদ, স্থিতিশীল ও যেখানে সবার অন্তর্ভুক্তি থাকবে।’

উজরা জেয়ার হোমওয়ার্ক 

ভারত ও বাংলাদেশে ঢাকা সফরে যাওয়ার আগেই ওয়াশিংটনে সফরের প্রাক আলোচনা সেরে আসেন। সেখানে তিনি ভারত ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করেন। ওয়াশিংটনে তিনি বৈঠক করেন ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরান ও ভারতীয় রাষ্ট্রদূত তারাজিৎ সিং সান্ধুর সঙ্গে। এরপর উজরা তার টুইটার পোস্টে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের কথা জানান। বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তার একটি ছবি প্রকাশ করে তিনি লিখেন- গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শ্রমের ন্যায্য চর্চা এবং মানবিক সহযোগিতা প্রসঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরানকে ধন্যবাদ। আমি দুই দেশের শক্তিশালী অংশীদারিত্ব আরও গভীর করার জন্য উন্মুখ।

এর আগেই যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত তারাজিত সিং সান্ধুর সঙ্গেও বৈঠক করেন উজরা জেয়া। বৈঠকের আলোচ্য বিষয় ছিল ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল। কীভাবে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও গভীর করার মধ্য দিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল উপকৃত হতে পারে তা নিয়েই আলোচনা করেন উজরা জেয়া ও তারাজিত সিং। এক ধরনের টুইট বার্তায় উজরা জেয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সামপ্রতিক যুক্তরাষ্ট্র সফরের পরপরই ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক হলো। বৈঠকে আমি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে আরও উন্মুক্ত, মুক্ত, সমৃদ্ধ এবং নিরাপদ করতে আমাদের যৌথ প্রচেষ্টা নিয়ে আলোচনা করেছি। 

বাংলাদেশ প্রসঙ্গ 

মার্কিন প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফরটা বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। দলটি এমন এক সময় সফর করছে যার কিছুদিন আগে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয় সেটা নিশ্চিত করতে ওই প্রক্রিয়ায় যারা বাধাগ্রস্ত করবেন, তাদের জন্য আমেরিকা সফরে একটা ভিসানীতি প্রনয়ণ করছে মার্কিনীরা। ওই ভিসানীতি নিয়ে ইতিমধ্যে তোলপাড় বাংলাদেশে। বাংলাদেশের আসন্ন ওই নির্বাচন, র‌্যাবের উপর স্যাংশন, ভিসানীতিসহ ওই সংক্রান্ত কর্মকান্ডের কঠোর সমালোচনায় চীন, রাশিয়া। ভারত এ ক্ষেত্রে নিশ্চুপ। ইরানের রাষ্ট্রীয় এক টেলিভিশনেও বাংলাদেশে মার্কিন এসব উদ্যোগের কঠোর সমালোচনা করতে দেখা গেছে। 

কিন্তু বাংলাদেশ কেন্ত্রিক ভূরাজনীতি, তথা ইন্দো প্যাসেফিক জোনসহ এ অঞ্চলে শান্তি সমৃদ্ধির কথা বলা হলেও মূলে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমাতেই মূলত মার্কিনীরা বেশ কিছুদিন থেকে তৎপর। রাশিয়ার বিবৃতি সঙ্গত কারণেই, কারণ ইউক্রেন ইস্যুতে মার্কিনীরা সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে বিবাদে জড়িত। একই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্কের সূত্র ধরে এবং মার্কিনীদের সঙ্গে চীনের বিরোধর কিছুটা হলেও আচ করা যাচ্ছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। ফলে বাংলাদেশে গত প্রায় ১৫ বছর টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে কথিত চীনের সখ্যতা (বাংলাদেশ স্বীকার করে না), সহ ক্ষমতাসীন সরকারের মার্কিন বিরোধী বিভিন্ন কথাবার্তা নিয়ে প্রকাশ্যে মার্কিনীরা কিছু না বললেও তাদের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একটা উদ্যোগ স্পষ্ট। যারা ‘ভাষা’ বুঝতে আর কারোরই বাকি নেই। য়ার ফলে সর্বশেষ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেনও অনেককিছু বলেছেন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে। 

মার্কিন প্রতিনিধি দলে রয়েছেন ডোনাল্ড লু। যাকে ঘিরে কিছুটা ভীতি দীর্ঘদিন থেকেই। বিশেষ করে পাকিস্তানে ইমরান খানের পতনে তাকে সরাসরি দায়ী করে ইমরান পক্ষ। সে সূত্রে বাংলাদেশে তার বারবার আগমন ও তার নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ (ভিসানীতি) ব্যবহার করে মার্কিন চিন্তাধারার বাস্তব প্রয়োগ করার কারিগর হিসেবেই মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশে তারা একে একে আলোচনা করবেন। ইস্যু, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করার স্বার্থে সরকার, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে ওই আলোচনা। তবে ভারতে যে সব আলোচনা হয়েছে তার কোথাও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ ছিল কি না সেটা জানা না গেলেও বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার মার্কিন প্রতিনিধি দলের ভারত সফর চলাকালীন দিল্লিতে গেছেন এমন একটা সংবাদ অসমার্থিত সূত্র থেকে জানা গেছে।  উল্লেখ্য, উজরা জেয়ার এটা বাংলাদেশে প্রথম সফর হলেও ডোনাল্ড লু’র এটি তৃতীয় সফর।

সফরসূচিতে যা থাকছে 

বুধবার (১১ জুলাই ) বাইডেন প্রশাসনের এ দলটি ৪ দিনের এই সফরের ঢাকা পৌঁছান। এরপর সফরের তৃতীয় দিনে ১৩ জুলাই বৃহস্পতিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন বলে জানা গেছে। 

একই দিনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠক হবে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে ডিনার এবং পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেয়ার কথা রয়েছে। সফরকালে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক হবে মার্কিন প্রতিনিধিদলের। 

আছে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরও পরিদর্শনের সিডিউল। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট আগেই জানিয়েছে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, মানবাধিকার ইস্যুসহ বিভিন্ন বিষয়ে দেশের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে বাংলাদেশ সফরে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের সিভিলিয়ান সিকিউরিটি, ডেমোক্রেসি ও হিউম্যান রাইটস বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। গত ৭ জুলাই প্রচারিত এ সংক্রান্ত এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের সংগঠনের সঙ্গে মতপ্রকাশ ও সমাবেশের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনায় লিপ্ত থাকবে প্রতিনিধিদলটি। তারা আলোচনা করবেন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, রোহিঙ্গা সংকট, শ্রম ইস্যু, মানব পাচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে।

শেয়ার করুন