০২ মে ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৩:৪৬:৪৩ অপরাহ্ন


বর্ণিল উৎসবের রঙ লেগেছে আ.লীগে
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-১১-২০২৩
বর্ণিল উৎসবের রঙ লেগেছে আ.লীগে সংসদ সদস্য তারানা হালিমের পোস্ট


২৬ নভেম্বর ছিল সংসদ সদস্য হওয়ার টিকেট লাভের দিন। এরপর ভোটের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সংসদ সদস্য। এ দৌড়ে কে জিতবেন-সেটা দেখার অপেক্ষায় ছিল গোটা বাংলাদেশ। দিনভর উৎকণ্ঠার পর অপরাহ্নে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক এক করে ২৯৮ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছেন। সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছিল ফেসবুকে। সব প্রার্থী উপস্থিত ছিলেন। কারণ তার কিছুক্ষণ আগে প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভাপতি শেখ হাসিনা মনোনয়নপ্রত্যাশী সবাইকেই ডেকেছিলেন গণভবনে। যেখানে সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন কে কে প্রার্থী। ফেসবুক লাইফ তো বটে, সেখান থেকে মোবাইল ও অন্যান্য মাধ্যমে এলাকায় জানিয়ে দেওয়ায় মুহূর্তে সারা দেশে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে যায়। এর মূল কারণ, মূলত বিগত দুই জাতীয় নির্বাচনেই নয়, স্থানীয় নির্বাচনেও একেবারে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের যে মনোনয়ন পেয়েছেন, তিনিই বিজয়ী। তার সামনে অন্য প্রার্থীরা দাঁড়ানোরও সাহস পায়নি। দু’একটি ব্যতিক্রম ঘটেছে সেটাও নিজ দলের মধ্যেই বিদ্রোহী কেউ। 

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ একমাত্র বিএনপি। বিএনপি তো সব পর্যায়ের নির্বাচন বয়কট করছে। ফলে আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে যাচ্ছে। তাই বিষয়টি এখন এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন মানেই বিজয়ী। 

উৎসবের কারণ

প্রশ্নটা আসতে পারে কেন উৎসব দেশজুড়ে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একটা অনিশ্চয়তার কালো মেঘ তাড়া করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তাদের মিত্ররা চেয়ে আসছে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এজন্য মূলত প্রয়োজন তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সরকার। কিন্তু সেটা হলে আওয়ামী লীগের সহজে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে গলদঘর্ম হওয়ার শঙ্কা। তাছাড়া বিগত সময়ে সংবিধান সংশোধন করে যে রীতি করা হয়েছে তাতে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেও নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর প্রত্যাশানুসারে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া বা বর্তমান ধারায় (আওয়ামী লীগের প্ল্যান) নির্বাচন করা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। অবশেষে নির্বাচন কমিশন, আগেভাগে তফসিল ঘোষণা করে এবং এ সূত্র ধরেই ক্ষমতাসীনরা নিজ দলের মনোয়ন প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করে ফেলেছে। ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসনে ঘোষণা করে তাদের প্রার্থী, যা অনেকটা একক নির্বাচন করার পরিকল্পনায়। ফলে এক এক করে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাওয়ায় সাধারণ নেতাকর্মীরা মনে করছেন, শেখ হাসিনা সব ম্যানেজ করে ফেলেছেন এবং প্রার্থী যখন চূড়ান্ত, তো ভোটও হয়ে যাবে। আর ভোট হওয়া মানেই বিএনপির অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা অনেকটাই নিশ্চিত বিজয়ী হচ্ছেন। এতে করে প্রার্থী নির্বাচিত হওয়া মানেই সংসদ সদস্য পদও চূড়ান্ত। আর এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন মানেই টানা চতুর্থবার ক্ষমতার মসনদে আওয়ামী লীগ। তাই তৃণমূল থেকে শুরু করে সর্বত্র বর্ণিল উৎসবের সাজে সেজেছে আওয়ামী লীগ। খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কারণ এর আগে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে বলে আসছিলেন যে, যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে, তাহলে কিন্তু কাউকেই স্বস্তিতে থাকতে দেবে না। তাই সতর্ক হোন। সব দিক বিবেচনা করে দল আরেকটি নির্বাচন পানে এগিয়ে যাওয়ায় স্বস্তি দলটিতে। ইতিমধ্যে প্রার্থীরা ফিরেছেন তৃণমূলে। সেখানেও সাজসাজ ভাব। নির্বাচনের আমেজে ঘুরছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। 

তবু তৃণমূলে আছে অস্বস্তি

এবার যারা সংসদ সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে এক পা দিয়ে এগিয়ে গেছেন, তাদের অনেকেই তৃণমূল বা বিভিন্ন সংসদীয় এলাকা থেকে মনোনয়ন পেলেও দলের অভ্যন্তরে মতবিরোধও রয়েছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে একটা কষ্ট অনেকের মধ্যেই ছাইচাপা হয়ে রয়েছে, যা অনেকটাই ‘কেউ খাবে তো কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না-’ টাইপের। কোনো প্রার্থী মনোনয়ন পেলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় কে কাজকর্ম বা প্রাধান্য পাবে সেটা ইতিমধ্যে চিহ্নিত। ফলে অন্য গ্রুপ যারা কোণঠাসা দীর্ঘদিন, তাদের মধ্যে চরম অসন্তোষ।

যা স্পষ্ট হয়েছে প্রতিটি মনোনয়নপ্রত্যাশীর মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে শোডাউন থেকেই। অনেকেই এমন শোডাউন করে বঙ্গবন্ধু অ্যভিনিউয়ে এসে মনোনয়নপত্র ক্রয় করেন, জমাও দেন। এটা ব্যাপক প্রচারিতও হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ মিডিয়াতেও। এতে বিভিন্ন পক্ষে ভাগ হয়ে যায় দলীয় লোকজন। মতবিরোধও হয় চরম। এ রেশ সহজেই যাওয়ার মতো নয়। কারণ বিপক্ষ বিএনপি মাঠে নেই। থাকলে একটা কঠোর চাপ থাকলে দলীয় প্রার্থী জিতিয়ে আনার জন্য এক হয়ে যেতো সবাই। কিন্তু এখন তো সে অবস্থা নেই। শুধু এমনটাই নয়, এ প্রক্রিয়া বিগত অন্তত দুই নির্বাচনে। স্থানীয় নির্বাচনও তো আছে। ফলে বিদ্যমান এমন মতবিরোধ মেটাবে কে? দীর্ঘদিন থেকেই কেন্দ্রের নির্দেশনা ছিল। কিন্তু সেটা কর্ণগোচর হয়নি অনেক স্থানেই। 

প্রধানমন্ত্রী ও সভানেত্রীর উদ্যোগ 

প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়টা অনেক আগে থেকেই অবহিত। এবারও তিনি মনোনয়ন দিয়েছেন তৃণমূলে অনেক বিচার-বিশ্লেষণ বা জরিপ চালিয়ে। সঙ্গে দলীয় কোন্দলটাও তিনি নোট করতে পেরেছেন। এতে করে বিগত কয়েকটি জনসভায় তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কখনো নির্দেশনাও দিয়েছেন যে, তিনি বা তারা যাকে মনোনয়ন দেবেন, তাকেই যেন সবাই ঐক্য হয়ে পাস করিয়ে নিয়ে আসেন। তিনি বোঝাতে গিয়ে এটাও বলেছেন যে, সে প্রার্থী কানা, খোঁড়া যা-ই হোক না কেন। মেসেজ তার ক্লিয়ার। এছাড়া আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রমও শক্তিশালী। ফলে বিদ্রোহী বা দলীয় প্রধানের নির্দেশের অমান্যকারীদের শাস্তি পেতে হবে এটা আর বলার অপেক্ষাও রাখে না। 

তবে এবারের নির্বাচনের জন্য মনোনয়নে অনেক নতুন মুখও রয়েছেন। ক্রিকেট অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান থেকে শুরু করে চিত্রনায়ক-নায়িকা, আমলা, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, সেনা, সচিবসহ আরো অনেকেই। ফলে ওইসব এলাকায় বঞ্চিত করা হয়েছে তৃণমূলে যুগের পর যুগ দলীয় কর্মকাণ্ড নিয়ে তিলে তিলে সংগঠন করে আসা অনেকেই। তাদের মধ্যে অনেক ক্ষোভ থাকলেও প্রকাশের সুযোগ নেই। কারণ সিদ্ধান্ত দলীয় প্রধানের। সেটাও বুঝতে হবে। ফলে মনের আগুন মনেই পুষে রেখেছেন তারা।

শেখ হাসিনার নির্দেশনা 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে-এমন মন্তব্য করে দলীয় প্রার্থীদের সতর্ক করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকার একটি মিডিয়ায় হওয়া রিপোর্টে একটি সূত্রের বরাত দিয়ে লিখেছে, শেখ হাসিনা বলেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ পাস করে আসতে পারবেন না। প্রত্যেক প্রার্থীকেই একজন করে দলীয় ড্যামি প্রার্থী রাখতে হবে। দলীয় প্রতীকের প্রার্থীর পাশাপাশি দলের যে কোনো নেতা বা ব্যক্তি স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন। কারণ নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে। রোববার গণভবনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন শেখ হাসিনা।’ তিনি আরো বলেন, ‘আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ঐক্যবদ্ধ থেকে নৌকার জন্য কাজ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ তোষামোদ করে ক্ষমতায় থাকতে চায় না, কারণ জনগণই তার শক্তি। এ মাটি আমাদের। এখানে কারো খবরদারি বরদাশত করা হবে না। আমরা কারো ওপর নির্ভরশীল নই। 

দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গত ১৫ বছরে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ তুলে ধরে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় জনগণ শান্তিতে রয়েছে। দেশের জনগণ আবারও আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতার মেয়ে হিসেবে তিনি দলমত নির্বিশেষে সবার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তার দল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় দেশের উন্নয়ন আজ দৃশ্যমান।’

সবশেষ

বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই একটা উৎসব। কিন্তু সেটা অবশ্য সবার অংশগ্রহণে। একতরফা নির্বাচন কেউই প্রত্যাশা করে না। এ নির্বাচনে বিএনপি ও তাদের মিত্রদের যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য এবং প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করে আসছে দীর্ঘদিন থেকে, তাদেরও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এমন গ্যারান্টি দিয়ে আহ্বান করা হচ্ছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে কখনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না তার রেফারেন্স হিসেবে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা ২০১৪ ও ২০১৮ সালকে টেনে আনছে। ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার যতোই আশ্বস্ত করুক, তাতে আস্থা রাখতে পারছে না তারা। তাছাড়া বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতা দণ্ডিত। বর্তমানে তারা কারাগারে। এমন সময় তারাই-বা কীভাবে নির্বাচনে আসবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আহ্বান জানিয়েছেন, যে জনপ্রিয়তা যাচাই করতে নির্বাচনে এসে অংশ নিতে। কিন্তু যারা কারাগারে, তাদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব নির্বাচনে অংশ নেওয়া। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তফসিল ঘোষণর আগের দিনও শীর্ষ তিন দলকে শর্তবিহীন সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু তাতে ক্ষমতাসীন দল সাড়া দেয়নি। বরং বিএনপি সন্ত্রাসী দল আখ্যা দিয়ে তাদের সঙ্গে কীসের সংলাপ সে উক্তি করেছেন। তফসিলের পর দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন মানেই শেখ হাসিনা তার শক্ত মনোবলের পরিচয় রেখেছেন। ইতিমধ্যে এমন ইস্পাত শক্ত মনোভাবের প্রশংসাও হচ্ছে নিজ দলে। যেমনটা প্রার্থী চূড়ান্তকরণের পর এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য তারানা হালিম তার টাইমলাইনে ইংরেজিতে যা লিখেছেন, তার অর্থ অনেকটা এমন-‘একজন মহিলার শক্তিকে কখনই অবমূল্যায়ন করবেন না যে, তার সমস্ত যুদ্ধ একাই লড়াই করেছে এবং জিতেছে।’ 

সব মিলিয়ে সব ঠিক থাকলে অর্থাৎ যেভাবে তফসিল ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত হয়েছে, এ ধারাবাহিকতায় ৭ জানুয়ারি ভোট অনুষ্ঠিত হলে ক্ষমতাসীনরাই আবার দেশ পরিচালনা কন্টিনিউ করবে, সেটা আর বোঝার বাকি নেই কারোই, আওয়ামী লীগের বর্ণিল উৎসবের মঞ্চ তৈরি করা শুরু এ থেকেই।

শেয়ার করুন