২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৯:০০:২৫ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্রমুক্ত দেশ গড়ে উঠবে - আসাদুজ্জামান খান কামাল ৭০ শতাংশ মৃত্যু অসংক্রামক রোগে, বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি ‘বিদেশে দেশবিরোধী অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় আইনে ব্যবস্থা নিন’ ভূল স্বীকার করে সরে দাড়ানোয় একজনের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার বাফেলোতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুই বাংলাদেশী নিহত ‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জের, বিএনপির বহিস্কার ৭৬ থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান


চিরন্তনের বিজয়ী বীর - চির উন্নত শিক্ষাগুরুর শির
কামরুজ্জামান ভূঁইয়া
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৫-২০২২
চিরন্তনের বিজয়ী বীর - চির উন্নত শিক্ষাগুরুর শির


সাফল্য-সন্কটে, আনন্দ-বেদনায় আজ আপন দর্পনে নিজেকে দেখতে গিয়ে, সারা জীবনে পাওয়া, নিজের যা কিছু ভালো, যা কিছু প্রাপ্তী -  যা কিছু অর্জন বলে মনে হয়, তার অনেকটাই যে আমরা শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত এবং সেই প্রাপ্তীর জন্য শিক্ষকদের কাছেই ঋনি - সে বিষয়ে কারো সন্দেহ নেই । আমরা আমাদের ছোটবেলার বাল্যশিক্ষার কাল থেকে আজ অবধি যা কিছু ভালো, যা কিছু সুন্দর - যা কিছু মানবিক, যা কিছু নৈতিক বলে জেনে এসেছি - শিখে এসেছি । তার অনেকটাই যে ঐ সকল শ্রদ্ধেয় শিক্ষককূল থেকে পেয়েছি তা আজ জীবনকালের পড়ন্ত বেলায় এসেও নির্দ্বিধায় নি:সন্কোচে স্বীকার করতে পারি এবং স্বীকার করে গর্ববোধও করতে পারি । মনে পড়ে ছোটবেলার প্রথম পাঠ সেই আদর্শলিপির (অ হতে ঔ - ক হতে) হিতপোদেশ  এবং সবুজসাথীর (ছড়া - গল্প) থেকে যে নৈতিক মূল্যবোধ আমরা মনোজগতে গেঁথে নিয়েছিলাম তা আজ বার্ধক্যকালে এসেও যে কোন ভালো কাজে আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে - উত্সাহ জাগায়, সচেতন করে । বলা বাহুল্য এর প্রতিটি কথা বানী, বাক্য-ছড়া-গল্পের সাথে মিশে আছে, আমাদের সেই সব মানুষ গড়ার মহান কারিগর শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দের ব্যক্তি আচার, ব্যক্তিগত সততা, চারিত্রিক দৃড়তা, মানবিক মহত্ত্ব ও মহানুভবতা, সত সত্য সরলতার প্রতি তাঁদের অকুন্ঠ আকুলতা । বলতে দ্বিধা নেই, আমরা আমাদের এই দীর্ঘ জীবন পরিক্রমকালে নিজেদের যতটুকু যোগ্যতর করেছি বলে ভেবে থাকি বা জীবনে যে কয়টি ভালো কাজ করেছি বলে মনে করতে পারি কিম্বা দেশ রাষ্ট্র সমাজের জন্য ও মানুষের জন্য নিজের দায়বোধ থেকে যদি কিছু কর্তব্য পালন করে থাকি, তার প্রায় অনেকটুকুই আমাদের প্রানপ্রিয় শিক্ষকদের শিক্ষা থেকে পাওয়া । চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্বে উঠা দারিদ্রক্লিষ্ট সাদামাটা অতি সাধারন অথচ এই বিশাল চরিত্রের মহান মানুষদের জীবনাচরন, কী সমাজ গঠন, কী জাতীয় চরিত্র গঠনে যে আত্বদান - আত্বনিবেদনের উজ্জ্বলতর স্বাক্ষর রেখে গেছেন তার ঋন আমরা কোনদিন শোধ করতে পারবো না । এই নির্লোভ - নির্মোহ মানুষদের অবদান আমাদের জাতীয় জীবনে এবং জাতীয় চরিত্র নির্মাণের সকল উত্কর্ষতায় সকল ঔজ্জ্বল্যের ভিত্তিমূলে সফলতার ভিত রচনা করেছে । সত্যি কথা বলতে কি, এখনো রাষ্ট্রীয় সামাজিক জরা গ্লানি অবক্ষয় অনাচারে যখনই এই মন প্রাণ বিষন্ন হয়ে যায়, হতাশ হয়ে পড়ে তখনই সেই সব প্রিয় শিক্ষকদের বানী বচন উপদেশ, তাঁদের জীবন যাপন, মূল্যবোধ স্মরণে বাঁচার স্বপ্ন দেখি - নতুন করে কিছু করার শক্তি পাই । 

বিশ্ব বানিজ্যকরনের এই ব্যবসা বান্ধব যুগে সারা পৃথিবী জুড়ে প্রকৃত মানুষের সংখ্যা বড়ই কম । বেশী যা আছে তার প্রায় সবটাই পন্য । মানবিক মূল্যবোধ মনুষ্যত্বও আজকাল লাভ ক্ষতির পাল্লায় পরিমাপ হয় । মানুষ এখন সত্যকে ভয় পায়, সত সরল নৈতিকতাকে এড়িয়ে চলে । লোভী কালের শঠতা মিথ্যা চালাকীতে মানুষ দক্ষ হয়ে উঠছে - অধিকতর পারদর্শী হয়ে উঠেছে । তেমন অধ:পতনের করাল গ্রাসে এখনো যে দু চারজন মানুষ প্রানপণ যুদ্ধ করে টিকে আছে, শক্ত হাতে হাল ধরে আছে, তাঁরা সময়ের বর - জাতির ভাগ্য । কিন্তু অভাগা আমরা, না তাঁদের মূল্যায়ন করতে পারছি, না তাঁদের ধরে রাখতে পারছি । বরং পদে পদে তাঁদের মর্যাদাহানী করছি। তাঁদের মানুষ গড়ার মহত কাজের পথকে কন্টকাকীর্ন করে তুলছি । ভাবতেও অবাক লাগে, যেখানে আজ ক্রমাগত অবক্ষয় ও নীতিহীনতার কারনে দেশ রাষ্ট্র সমাজ একটি ভয়াবহ আদর্শহীন বন্ধ্যাকাল অতিক্রম করছে। নীতি আদর্শে অবক্ষয়ের চুড়ান্ত পর্যায়ে নেমে এসেছে। সেই আকালের কালে আমরা মহত প্রান মানুষদের সম্মান দিতেও আগ্রহ বোধ করি না । একজন প্রকৃত শিক্ষক শুধু ছাত্রেরই শিক্ষক নন, তিনি সমাজেরও শিক্ষক এবং জাত ধর্ম নির্বিশেষে একজন অনুসরনীয় ব্যক্তিত্ব। তেমন মহান মানুষটিকে কারো সামান্য স্বার্থের কারনে, কারো বা ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত লাভ লোভ চরিতার্থের বর্শবর্তী হয়ে অকারনে অপমান - অপদস্থ করতেও দ্বিধা-সন্কোচ বোধ করি না। সম্প্রতি তেমনই একজন আদর্শবাদী শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের প্রতি কুচক্রীদের প্ররোচনায় তাঁরই সন্তানতুল্য ছাত্রদেরকে ব্যবহার করে যে অপমানজনক হেনস্থা করা হয়েছে তা শুধু অমার্জনীয় অপরাধই নয়, বলা যায় দেশ জাতি সমাজের জন্য একটি আত্বঘাতী অপকর্ম। হয়তো এই অপরিনামদর্শী ন্যাক্কারজনক কাজটির ভয়াবহ পরিনাম-পরিনতি উপলদ্ধি করতে জাতিকে আরো পঞ্চাশ বত্সর অপেক্ষা করতে হবে। আর তখন অনুতাপ অনুশোচনায় কোন ফল হবে না। হারানো সময় ফিরিয়ে আনা যাবে না। নিজের খোড়া গর্তেই নিজের পতন নিশ্চিত হয়ে যাবে। যেমনটি আমরা ঠিক প্রায় অর্ধশতাব্দীর বেশী সময় পূর্ব ধরে একই পন্থা ও প্রক্রিয়ায় সংগঠিত করে এসেছিলাম এবং আজ কড়ায় গন্ডায় তার সুদে আসলে পরিশোধ করছি। দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এক বক্তৃতায় গল্পচ্ছলে বলেছেন, যে কোন জাতির শিক্ষা হলো মানুষের দুটো চক্ষুর সমান। সেই চক্ষু নিয়ে তামাশা করা যায় না। ঐ দুটো চক্ষু হারালে সেই অন্ধ জাতি কোনদিনই পথের সন্ধান পাবে না। কথা প্রসঙ্গে কথা এসে যায়, আমাদের জাতি চরিত্র, সমাজ চরিত্র গঠন ও অতীত গৌরবের যা কিছু অর্জন, যা কিছু সাফল্য তার অনেকটা জুড়ে আছে শিক্ষক সমাজের নীরব ভূমিকা এবং প্রশংসনীয় অবদান। এখনো গ্রামে গ্রামে, শহর বন্দরে সেই সব ব্রতধারী শিক্ষকদের নাম ঘরে ঘরে মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছে। মানুষ পরম শ্রদ্ধাভরে তাঁদের স্মরন করে। আমার ছাত্রজীবনের সেই সব শিক্ষক মহোদয়দের সততা নিষ্ঠা, সামাজিক দায়বোধ ও চারিত্রিক দৃড়তায় উদ্ভাসিত দেবকান্ত মুখোচ্ছবি আজ এতোকাল পরেও স্বপ্নলোকের দেবদূতের মতো এসে স্মৃতিপটে দাঁড়ায়। আমি বার বার অনুপ্রাণিত হই - বিমোহিত হই। নতুন করে পুনর্বার আবিষ্কার করি চেতনার প্রভা - কৃতজ্ঞতা শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। দু:খজনক হলেও এক নিদারুন সত্য, আমরা সেই সব শিক্ষকদের একাংশের ধারাবাহিক অবস্থান বা সন্মানীয় উপস্থিতি এদেশে ধরে রাখতে পারিনি। কখনো সাম্প্রদায়ীক কারনে, কখনো রাজনৈতিক কারনে আমরা তাঁদের জানমালের নিরাপত্তাটুকু প্রদান করতে পারিনি। দেশভাগ  ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়ীক বিভাজনে প্রথিতযশা তাঁদের অনেকেই নিজ নাড়িপোঁতা স্বদেশ ছেড়ে দেশত্যাগ ও দেশান্তরে বাধ্য হয়েছেন । তাঁরা নিজ জন্মভূমিতে নিরাপদ বোধ করতে পারেন নি । ধর্মীয় অবস্থানের সুবিধায় একটি অংশ বা স্বদেশ প্রেমের আবেগে যাঁরা মাটি কাঁমড়ে পড়ে রইলেন, সেই অংশ দুটিও শিক্ষা ব্যবস্থার ক্রমাগত বানিজ্যকরনের ফলে ছাত্রদের মধ্যে তাঁর সেই মেধা নিষ্ঠার প্রকৃত শিক্ষা প্রসার বা বিস্তার ও বিকাশ ঘটাতে সামাজিক - রাজনৈতিক আনুকল্য তাঁকে তেমন সহযোগিতা প্রদান করেনি । রবী ঠাকুরের ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলোরে' — গানটির মতো তাঁরা একাই আলোর প্রদিপ নিয়ে পথ চলছিলেন । আজ আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছি, সেই প্রদিপটির উপরও ক্ষনে ক্ষনে নানা অজুহাতে আঁধারের ঝাঁপটা এসে প্রদিপখানি নিভিয়ে দিতে চাইছে । আমরা কেবলই অন্ধকারে হারিয়ে যেতে চলেছি । 

একজন বিজ্ঞান শিক্ষক তো বিজ্ঞান বিষয়েই ছাত্রদের পড়াবেন । তিনি তো ধর্ম বিষয়ে পড়াবেন না । এমনটাই তো আমরা ছাত্রজীবনে দেখে এসেছি । এবং এটিই তো শিক্ষার স্বাভাবিক নিয়ম রীতি বা পাঠ্যক্রম । জ্ঞ্যান-বিজ্ঞান যুক্তি ও প্রমান নির্ভর, অন্যদিকে ধর্ম শুধু মাত্র বিশ্বাস নির্ভর । এক এক ধর্মের এক এক মত, এক এক বিশ্বাস । আমরা জানি ধর্মে, নানা ধর্মের নানা পথ । বিজ্ঞান ইহজাগতিক, ধর্ম পারলৌকিক । বিজ্ঞানে সকল বিজ্ঞানীর একমত । বিজ্ঞান যুক্তি-প্রমান ছাড়া এগুতে পারে না । এক সময় ধর্মের বিশ্বাস ছিল, সূর্য্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে । বিজ্ঞান প্রমান করে দিয়েছিল পৃথিবী সূর্য্যের চারদিকে ঘোরে । আমরা জানি এই বৈজ্ঞানিক সত্যটি প্রমান করতে গিয়ে বিশ্বশ্রেষ্ট বিজ্ঞানীদেরকে ধর্মযাজকদের হাতে অকথ্য নির্যাতন সইতে হয়েছে । কাউকে বন্দী করে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে, কাউকে নির্বাসন দেয়া হয়েছে ।  কাউকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে । কিন্তু দেখা গেল এক সময় ধর্মীয় বিশ্বাসকে বিজ্ঞানের কাছে হার মানতেই হয়েছে । সমাজ সভ্যতা বিকাশের ধারায় এভাবেই বিজ্ঞান সকল ধর্মীয় কুপমুন্ডকতা ও ধর্মীয় কুসংস্কারকে বার বার পরাস্ত করে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছে । 

মনে পড়ে ছোটবেলায় একই বাড়ীতে প্রায় সমবয়ষি আমি ও আমার এক চাচাতো ভাই দুজনে আমরা একসংঙ্গে লেখাপড়া করতাম । আমি স্কুলে - সে মাদ্রাসায় । সমবয়ষি হবার কারনে আমাদের সখ্যতা কম ছিল না । কিন্তু শিক্ষার পাঠ ও পাঠ্যক্রমের ভিন্নতার কারনে তার সাথে আমার বহু বিষয়ে একমত হয়ে চলতে সহজ বোধ হতো না । কিন্তু এমন কঠিনও হতো না যে, আমরা পরষ্পরের সাথে চলতে ফিরতে অস্বস্তি বোধ করতাম । একদিন বেশ বড় ধরনের ভূমিকম্প হলো দেশে । বড় ধরনের তেমন কোনও ক্ষয়ক্ষতি না হলেও ভূকম্পনের সাথে সাথে ভীত সন্ত্রস্ত সকলের মধ্যে সেদিন  একটা ভয়জনিত বিশাল নাড়া দিয়ে গেল । এ নিয়ে বাড়ীর বড় ছোট সকলের মাঝে সম্ভাব্য ঘটন অঘটনের সম্ভাবনা নিয়ে একবেলা ধরে সবাই আলাপ আলোচনায় গল্পে সময় কাটালো । বড়দের তো সময় কাটলো, কিন্তু আমাদের মতো ছোটদের মধ্যে সেই চাচাতো ভাই এর সাথে ভূমিকম্প নিয়ে গোল বেঁধে গেল আমার । আমি বলছি ভূমিকম্পন হয়, ভূমির অভ্যন্তরে জানা অজানা নানাবিধ রাসায়নিক ক্রীয়ার ফলে, সেই সম্মন্ধে আমাদের স্কুল শিক্ষকের কাছ থেকে আমি কোন একদিন গল্পচ্ছলে শুনেছিলাম । ক্লাস শিক্ষক আরো কিছু বৈজ্ঞানিক কারন বলেছিলেন, যা ঐ কিশোর বয়ষে অতটা বুঝতে পারিনি বা মনেও রাখতে পারিনি । কিন্তু মাদ্রাসায় পড়া আমার চাচাতো  ভাইটি তা মানতেই নারাজ । সে তার প্রচন্ড আত্ববিশ্বাস নিয়ে বললো, এই পৃথিবী নাকি কোন এক প্রকার ষাঁড় জাতীয় বড় বৃহত কোন প্রাণীর শিং এর উপর ঘুর্নায়মান অবস্থান করে । ভারে ক্লান্ত ঐ প্রানীটি যখন পৃথিবীটাকে এক শিং থেকে অন্য শিং এ স্থানান্তর করে, তখনই ভূকম্পন অনুভব হয় - পৃথিবীটা ভয়ন্কর রুপে কেঁপে উঠে । সমস্যা বেঁধেছে আমি তার কথায় তো সায় দেই ই নি, উপরন্তু অবিশ্বাস করে হাসাহাসি করছিলাম । তখন উপস্থিত অন্যরাও আমার কথায় সায় দিয়ে তাকে খানিকটা অপদস্থের মতন পরিস্থিতির সৃষ্টি করলো । যা পরে ঝগড়া ঝাঁটিতে রুপ নিলে বড়দের হস্তক্ষেপে বুঝিয়ে সুজিয়ে কোন এক প্রকারে  নিষ্পত্তি করতে হলো । কিন্তু এ কথাও সত্য যে, অনেক অনেক ছোট বড় বিষয়ে, এমন ঘর গৃহস্থালি নানা বিষয়ে কোনদিনই আর তার সাথে আমি একমত হয়ে চলতে পারিনি । ক্রমেই দুজনের চিন্তা জগতে, মন মানসিকতায়  দূরত্ব বেড়েই গেছে । একসময় দূরত্ব ধিরে ধিরে এতোটাই বেড়ে গেল যে, আমি পারতপক্ষে তার সঙ্গে কোন বিষয়ে তর্ক বিতর্কে জড়াতে চাইতাম না । কারন আমার বিজ্ঞানমনষ্ক শিক্ষা আর তার ধর্মবিশ্বাসের শিক্ষা পরষ্পর বিপরীতমুখী এবং সাংঙ্গর্ষিক । যা দুজনের পারিবারিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মাঝে সীমানা দেয়াল তৈরী করে দিয়েছিল । যে দেয়াল আজ অবধি আমরা ভাঙতে পারিনি । 

এই তো সেদিন বিনোদপুর রামকুমার হাইস্কুল, মুন্সীগন্জ এর একজন প্রথিতযশা স্বনামধন্য শিক্ষক শ্রী হৃদয় মন্ডল শ্রেণীকক্ষে তাঁর ছাত্রদের প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষকসুলভ আবেগ - আন্তরিকতা নিয়ে, বিশ্বের মানব প্রজাতির বিবর্তন ধারা ও বিকাশের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করছিলেন । যেখানে বিশ্ব সেরা বৈজ্ঞানিক ডারউইন এর তত্ত্বটি অনিবার্য্য ভাবে এসে পড়ে । আমরা জানি যে, কোন কারনে কেউ মানি বা না মানি, তাহলেও মানব জাতির সৃষ্টি, বিকাশের ইতিহাস ও প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করতে গেলে মহা বিজ্ঞানী ডারউইনের আবিষ্কার উপেক্ষা করে তা সম্ভব হতে পারে না । অথচ নীচ হীন একটি কুচক্রী মহল তার বা তাদের ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থে বৈজ্ঞানিক বিষয়টির মধ্যে ধর্মীয় প্রলেপ দিয়ে, এবং দু:খজনক হলেও নির্মম সত্য যে, তাঁরই সন্তানতুল্য ছাত্রদের প্ররোচিত করে, ব্যবহার করে শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে হেনস্থা করার কৌশল অবলম্বন করে । এবং জাতির দুর্ভাগ্য তাতে তারা সফলও হয়। এমন মানুষ গড়ার কারিগর মহান শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা হলো, সমস্ত নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে, আত্বপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে, তাঁকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করলো । তিনি মাসাধিক কাল জেল হাজত খেটে, সারা দেশের সচেতন মানুষের প্রতিবাদ প্রতিরোধের মুখে শেষে জামিন পেলেন । একটি দেশের জন্য, জাতির জন্য এমন বিস্ময়কর, এমন লজ্জাকর বিষয় আর কি হতে পারে, তা ধারনা করাও কঠিন । যে দেশে যে সমাজে দুর্নীতিবাজ চোর ডাকাত দস্যুরা মাথা উঁচিয়ে চষে বেড়ায়, সেই সমাজে হয়তো সাধু সুধীজনদের এমন অসহায়ত্ব স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়া যেতে পারে, কিন্তু সে জাতির আশু পরিনামের কথা ভাবলে তো শিউরে উঠতে হয় । আমি জানি না, আগামী দিনে, আগামী প্রজন্মের কাছে বর্তমান কালের এমন আত্বঘাতী অপকর্মগুলো আমাদেরকে কোন পরিচয়ে পরিচিত করবে । তবে এটুকু জানি, বিশাল মাপের, বড় মনের মানুষ হৃদয় মন্ডলের আকাশছোঁয়া উন্নত চরিত্রের প্রভা, মহানুভবতা, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং মানুষের প্রতি, বিশেষ করে প্রাণাধিক  ছাত্রদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার নিদর্শনটুকু আগামী সময় ও সমাজের জন্য পাথেয় হয়ে রইবে । এতো অপমান এতো নির্যাতন সয়েও যে মানুষটি আপন মহিমায় বলতে পারেন, ‘আমি আবার ক্লাসে ফিরবো । আমরা যেহেতু শিক্ষক, ক্ষমাই আমাদের ধর্ম । শিক্ষার্থীরা যাই করুক, আমাকে ওদের ক্ষমা করতে হবে, ভালোবাসতে হবে । এভাবেই এগিয়ে যেতে হবে । কিম্বা সমস্ত কষ্ট-বেদনা, পীড়ন যন্ত্রনা ভুলে হাসিমুখে বলতে পারেন, ‘শিক্ষক হিসাবে (যদি) ক্ষমাই করতে না পারি, তাহলে শিক্ষক কি করে হলাম' । আমরা দল মত, ধর্ম শাস্ত্র নির্বিশেষে তাঁর এই অজর বাণীর অমৃত ছোঁয়া থেকে এই বিশ্বাস এই আশা নিয়ে বলতে পারি, সত্যিই তুমি বিজয়ী বীর, সত্যিই চির উন্নত তুমি - হে শিক্ষাগুরুর শির । 

লেখক : কবি ও সাহিত্যিক । 

শেয়ার করুন