২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ৬:৩৬:৩৪ অপরাহ্ন
শিরোনাম :


অর্থপাচারকারীদের একজন পিকে
পিকেতে ভাসছে অনেক ইস্যু
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-০৫-২০২২
পিকেতে ভাসছে অনেক ইস্যু


ভারতে বাংলাদেশের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পাচারকারী পিকে হালদারের আটকের ঘটনাতে চলছে নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। সেখানে উঠে আসছে বিগত দিনের অনেক ইস্যু। এর মধ্যে অন্যতম যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই)-এর সেই প্রতিবেদনের কথা। গত (২০২১) ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়,আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৭৪ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ২০১৫ সনেই পাচার হয়েছিল এক লাখ কোটি টাকারও বেশি। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৩৪টি দেশের বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচারের একটি চিত্র তারা তুলে ধরেন। 

সেখানে বিস্তারিত বিবরণে বলা হয়েছে যে কিভাবে এ অর্থ সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে পাচার হয়ে থাকে। বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মূল্য ঘোষণার গরমিল দেখিয়ে কীভাবে দেশ থেকে অর্থপাচার হয়। পাশাপাশি এক দেশ থেকে অন্য দেশে আমদানি-রফতানিতে মূল্য কম-বেশি দেখানো হয়। এ সময় মূল্য ঘোষণার বাড়তি অংশ বিদেশে পাচার করে দেয়া হয়। এমন বিস্তারিত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই ওই প্রতিবেদন তৈরি হয়। 

জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এর মধ্যে ২০১৪টা বাদ রেখেছেন তারা, তবে ওই ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় চার লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা (ডলার মূল্য ৯০ টাকা হারে)। বাংলাদেশকে দেখানো হয়েছে বিশ্বের শীর্ষ অর্থপাচারকারীর মধ্যে একটি। প্রতিবেদনে চীনকে দেখানো হয়েছে শীর্ষস্থানে। এরপর পোল্যান্ড, মেক্সিকো,ভারত,রাশিয়া প্রমুখ দেশ।

তবে গবেষণায় উঠে এসেছে এ অর্থপাচারের তালিকায় রাজনীতিবিদ,ব্যবসায়ী,আমলাসহ বিভিন্নস্তরের লোক রয়েছে। যাদের সন্তান-পরিজনরা বিদেশে থাকেন, পড়ালেখা করেন। তাদের এবং ভবিষ্যতে পাচারকারীর বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্যস্থানে বসবাসের জন্য, নিরাপদ ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই এমন অর্থ প্রেরণে উৎসাহী থাকেন। 

ওই সময় স্থানীয় এক পত্রিকার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়,‘ জিএফআইয়ের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ রিক রডেন বলেন, আমদানির সময় ভাউচারে দাম বেশি দেখিয়ে এবং রফতানির সময় দাম কমানোর মাধ্যমে মূলত অর্থপাচার করা হয়। এভাবে অর্থপাচারের পরিমাণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বাংলাদেশে। এবার জিএফআই ২০১৮ সাল পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করেছে। করোনা মহামারীর কারণে পরবর্তী বছরগুলোর তথ্য প্রকাশিত হয়নি। তবে বাংলাদেশের তথ্য আছে ২০১৫ সাল পর্যন্ত। তাদের দাবি, জাতিসংঘকে টানা তিন বছর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের তথ্য দেয়নি বাংলাদেশ।

এমনকি জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০১৪, ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালের তথ্য-উপাত্ত দেয়া হয়নি। ২০১৫ সালের পর থেকে জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কোনো তথ্য নেই। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য সব দেশের যত আমদানি-রফতানি হয়, তাতে গড়ে ১৭.৩ শতাংশের মূল্য ঘোষণায় গরমিল থাকে।’

এ ব্যাপারে সে সময় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘পাচার হওয়া অর্থের একটি আংশিক চিত্র দিয়েছে জিএফআই। প্রতিবছরই নানা কায়দায় অর্থপাচার বাড়ছে। যারা অর্থপাচার করছেন, তারা আর্থিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিকভাবে অনেক প্রভাবশালী। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।’ 

এখন প্রশ্ন কেন, গত বছরের উল্লেখযোগ্য ওই প্রতিবেদন, এ মুহূর্তে প্রচণ্ডরূপে আলোচিত হচ্ছে। সেটা মূলত প্রশান্ত কুমার হালদার বা পিকে হালদারের ভারতে গ্রেফতার হওয়ার ইস্যু ঘিরেই। বাংলাদেশে এ খবরটা প্রতিটা মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারিত হয়। কেননা বাংলাদেশের আর্থিক খাতে আলোচিত এ ব্যক্তি বিশালপরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার করেছেন তার বেশিরভাগ অর্থই। যার পরিমাণ সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। শুধু যে ভারতে পাচার করেছেন তা নয়, কানাডা,যুক্তরাষ্ট্রেও তার কানেকশন। তবে প্রথম তিনি কানাডা পালিয়ে যাবার খবর উঠলেও ভারতে আটক হওয়ার ঘটনা ঘটলো। 

পিকে হালদারকে কী আদৌ ফিরিয়ে আনা যাবে। সরকার পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে ভারত তার আটকের খবর আনুষ্ঠানিক জানানোর পরই উদ্যোগ নেবে বাংলাদেশ। এবং ফিরিয়ে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। একইসঙ্গে সম্পূরক প্রশ্ন সর্বত্র, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সেটা ভাসছে যে, পিকে হালদারকে ফেরানো হলেও তার পাচার করা অর্থ কী ফেরানো যাবে? এটাকে ঘিরেও নানামত। কারণ একবার পাচার হয়ে গেলে সেটা ফেরাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। যাতে অনেক ধৈর্যেরও প্রয়োজন। সে সময়টা ও লিয়াজোঁ করার পর্যাপ্ত সময় বের করা যাবে কি-না। পাচার হওয়া দেশেরও আন্তরিকতা থাকতে হবে। ফলে অনেক কিছুর সমন্বয় ঘটাতে হবে এক্ষেত্রে। 

শুধু এখানেই শেষনয়, পিকে হালদারের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে আরো ক’জনের নাম ও তাদের অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের তথ্য। এদের মধ্যে পিকের পর রয়েছে ডাক বিভাগের শুধাংশু শেখর ভদ্র’র ৫০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্র্নর এস কে সুর চৌধুরীর এক হাজার কোটি টাকা। ওসি প্রদীপ কুমারের তিনশ কোটি টাকা পাচারের তথ্য ছবি সহকারে আলোড়ন তুলছে। এ নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন দেশে পাচারকারীর সংখ্যা অনেক হলেও কেন বেছে বেছে একটি ধর্মের কিছু লোকের নাম ও ছবি উল্লেখ করে ছড়ানো হচ্ছে। এটা উদ্দেশ্যমূলক। তবে এর জবাবে যে তথ্য তাৎক্ষণিক উঠে এসেছে, সেটা হলো যুক্তরাষ্ট্রের আগের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার সেই নালিশ।

২০১৯-এর জুলাইয়ে বিশ্বে বিভিন্ন ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হওয়া ১৯টি দেশের ২৭ জন ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউজে অনুষ্ঠিত ওই সাক্ষাৎ পর্বে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া একটি এনজিওর কর্তধার প্রিয়া সাহা ট্রাম্পের সাথে হাত মিলিয়ে কাকুতি মিনতি করে বলেন,‘স্যার, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এখানে ৩৭ মিলিয়ন হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ বিলীন (নিখোঁজ) হয়েছে। দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই। এখনো সেখানে ১৮ মিলিয়ন সংখ্যালঘু মানুষ আছে। আমার অনুরোধ, দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন। আমরা আমাদের দেশ ছাড়তে চাই না। শুধু আমাদের বাংলাদেশে থাকার জন্য সাহায্য করুন।’ এ সময় তিনি আরো বলেন, ‘আমি আমার বাড়ি হারিয়েছি। তারা আমার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, আমার জমি কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু কোনো বিচার হয়নি।’ এসময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জিজ্ঞাসা করেন, ‘কারা জমি দখল করেছে? কারা বাড়ি দখল করেছে?’ জবাবে প্রিয়া সাহা বলেন, ‘মুসলিম মৌলবাদী গ্রুপ এগুলো করছে। তারা সব সময় রাজনৈতিকভাবে শেল্টার পায়। সব সময়।’

প্রিয়া সাহার ওই ঘটনা বিশ্বের সব দেশে ফলাও করে প্রচারিত হয়। যাতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন হয়। প্রিয়া সাহার আর কোনো খোঁজ মেলেনি। দেশে ফিরেছেন কি-না সে তথ্যও নেই। তবে বাংলাদেশে যে হিন্দু বা সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত নন বা তাদের সম্পদ যে বেদখল নয়, এটা সত্য। বিশেষ করে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনা। কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের প্রত্যান্ত অঞ্চলে গিয়ে সাধারণ হিন্দুদের মন্দিরে যেয়ে পূজা-অর্চণা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনিও তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেন। সেখানেও কিন্তু হিন্দুরা যে নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন, সেটা তারা উল্লেখ করেননি। কিন্তু প্রিয়া সাহা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের সম্মান লুটিয়ে দিয়ে এসেছেন। 

ফলে সামাজিক মাধ্যমে এটাই বলা হচ্ছে এ দেশে হিন্দুরা বা সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হলে পিকে,এসকে সুর, সুধাশু, ওসি প্রদীপ বা এসকে সিনহার মতো লোকজনরা এতোটা বেপরোয়া কীভাবে হয়েছিল? 


শেয়ার করুন