০৩ মে ২০১২, শুক্রবার, ১১:২৭:৪৯ অপরাহ্ন


নতুন আতঙ্ক : হেলমেট ও মুখোশ পরে গুপ্ত হামলা
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-১২-২০২৩
নতুন আতঙ্ক : হেলমেট ও মুখোশ পরে গুপ্ত হামলা হেলমেট বাহিনীর নির্যাতন/ছবি সংগৃহীত


চলতি সময়ে অত্যন্ত উদ্বেগ-আতঙ্কের বিষয় হেলমেট ও মুখোশ পরে গুপ্ত হামলা ও হত্যার মতো ঘটনা। নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যখন সারা দেশে একটা নৈরাজ্য বিরাজ করছে ঠিক সে সময় এ ধরনের ঘটনাগুলো জনজীবনের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি অধিকতর প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। 

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এর পক্ষ থেকে গত অক্টোবরে দেশব্যাপী মানবাধিকারের চলমান পরিস্থিতির ওপর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এই প্রতিবেদনে পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র ধরে জানানো হয় যে, গত ১৬ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত অন্তত বিশটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে নাটোরে এগারটি, নওগাঁতে পাঁচটি, রাজশাহীতে তিনটি, পাবনাতে একটি হেলমেট পরা মুখোশধারীরা হামলা চালিয়ে ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেন। এতে তিনজন নিহত ও ১৭ জন গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। 

‘মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদন নভেম্বর ২০২৩ উপস্থাপন করতে গিয়ে এমএসএফ’র পক্ষ থেকে আরো বলা হয় আক্রান্তদের সবাই বিএনপি, জামায়াত বা ইসলামী সংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। হতাহতদের অন্তত সাতজন দল দুটির পদধারী নেতা। প্রায় প্রতিটি ঘটনায় হামলাকারীরা সাদা মাইক্রোবাস কিংবা মোটরসাইকেলে করে হেলমেট পরে আসে। হামলার সময় তাদের মুখে মুখোশ থাকে। প্রায় প্রতিটি ঘটনায় হামলাকারীরা হাত-পায়ে, বুকে-পিঠে কুপিয়েছে কিংবা পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে। আহতদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, তারা হামলাকারীদের কেউকে চিনতে পারেনি, পরবর্তীতে তাদেরকে আবারো এ ধরনের আচারণ করতে পারে এ ভয়ে তারা থানায় মামলা করতে পারেনি, যদিও এ ঘটনাগুলোতে এ পর্যন্ত ১২টি মামলা হয়েছে। মামলাগুলোর কোন অগ্রগতি নেই, পুলিশ বলেছে, ঘটনায় মুখোশ বা হেলমেট পরিহিত হামলাকারীদের বিষয়ে তারা কিছুই জানে না। 

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এর পক্ষ থেকে এধরনের ঘটনার ব্যাপারে বলা হয় দেশে নতুনভাবে যোগ হয়েছে মুখোশ পরে গুপ্ত হামলার মতো ঘটনা। অত্যন্ত উদ্বেগজনক এ বিষয়টির বেশির ভাগ ঘটনা রাতে ও নির্জন রাস্তায় ঘটছে। মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাসে করে এসে মুখোশধারী ব্যক্তিরা আহত ও নিহতদের পিটিয়ে, কুপিয়ে, হাত-পায়ের রগ কেটে, গুলি চালিয়ে হত্যা ও গুরুতর জখম করছে। খবরের তথ্য অনুযায়ী গুপ্ত হামলার শিকার বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মী। ঘটনাগুলোকে বিচারবর্হিভূত কর্মকাণ্ড হিসেবেই গণ্য করা যায়। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভুমিকা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। সারা দেশকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়ার পরও অপরাধীরা কিভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। পুলিশ বলেছে, ঘটনায় মুখোশ বা হেলমেট পরিহিত হামলাকারীদের বিষয়ে তারা কিছুই জানে না। এম এস এফ এ সমস্ত ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছে।

এ ছাড়াও মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলায় চারজন বিএনপি নেতার বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালায়। ঢাকা ও যশোরে বিএনপির দুই নেতার বাড়িতে ককটেল হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে।

এমএসএফ মনে করে, সরকার ঘোষণা দিয়ে বিরোধী দলীয় কর্মসূচি মোকাবিলায় সারা দেশে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব ও বিজিবি সদস্যদের মোতায়েন করে নিশ্ছিদ্র এসব পাহারার ব্যবস্থা করেছে। তার মধ্যে এ রকম গুপ্ত হামলা ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। এতে করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুপ্ত হামলা ও সন্ত্রাসী দমনের চেয়ে বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দমনে বেশি ব্যস্ত থাকছে। হেলমেট ও মুখোশ পরে যারা গুপ্ত হামলা ও হত্যা চালাচ্ছে, তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে দ্রুত বিচারের সম্মুখীন করা জরুরি বলে এমএসএফ মনে করে। 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আচরণ পক্ষপাতদুষ্ট 

প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করে আরো বলা হয় চলতি বছরের ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে অনাকাঙ্খিত ঘটনার পর রাজনৈতিক সংকট, হরতাল, অবরোধ, সহিংসতা, মামলা, গায়েবী মামলা, গণগ্রেফতার, সরকার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি সংঘাতময় পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে যা জনজীবনে গভীর বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। একই সাথে ক্ষমতাশীন দলের রাস্তায় শক্তি প্রদর্শন কিংবা বিরোধী দল দমনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। পুলিশের অভিযান সত্ত্বেও সরকারি দলের নেতাদের প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিতে দেখা গেছে। ফলে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আচরণ পক্ষপাতদুষ্ট। জনমনে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি করেছে। বলা হয় অর্থনৈতিক নেতিবাচক প্রভাবের কারণে অনেক গার্মেন্টস কারখানা বন্ধের উপক্রম হয়। বেকারত্ব বাড়ার পাশাপাশি মালিকদের অনেক শ্রমিকেরা বেতন-ভাতা দিতে না পারায় দীর্ঘদিন বকেয়া পড়েছে। শ্রমিক ছাঁটাইও চলছে। এর মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকরা ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধি ও বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। মজুরি নিয়ে পোশাক শ্রমিকদের অসন্তোষকে কোনোভাবেই অযৌক্তিক বলার সুযোগ থাকার কথা নেই। কিন্তু পোশাক শ্রমিকদের ন্যায্য আন্দোলন দমনে সরকার শ্রমিক বিক্ষোভের কারণ বিবেচনায় না নিয়ে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে শ্রমিক হতাহতের মত ঘটনা ঘটিয়েছে তা দুর্ভাগ্যজনক।

গ্রেফতার অভিযান চালাতে গিয়ে পলাতক বিরোধী দলের কর্মীদের বাড়িতে না পেয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের ধরে নিয়ে যাওয়া, এমন কি পলাতক বাবাকে না পেয়ে মাকে ধরে নিয়ে শিশুসন্তানদের অসহায় অবস্থায় ফেলে দেওয়ার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে। পাশাপাশি সারা মাস ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের অপহরণ অব্যাহত রয়েছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলেছে। পুলিশের আটকের ও নির্যাতনের ভয়ে আত্মরক্ষার জন্য পালাতে গিয়েও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকেরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও অবিরত হুমকির সম্মুখিন হচ্ছেন। অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার, সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে নাগরিকের মৃত্যু সংখ্যালঘু নির্যাতন, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, গণপিটুনির মত ঘটনা অব্যাহতভাবে ঘটেই চলেছে যা মানবাধিকারের চরম লংঘন। সামগ্রিক বিবেচনায় এমএসএফ মনে করে, অনির্দ্দিষ্ট ঘটনায় মামলা, হামলা ও গ্রেফতার মানবাধিকার লংঘনের সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত। দেশের নাগরিকদের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের লংঘন। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও আইনি পরিবেশ উন্নয়নে গণগ্রেফতার বন্ধ ও গায়েবি মামলাগুলি প্রত্যাহার করার পাশাপাশি সবধরনের সহিংসতা, বিশৃঙ্খলা ও ভীতিকর পরিবেশ বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ত্বরিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য এমএসএফ জোর দাবি জানাচ্ছে।

শেয়ার করুন