২৯ অক্টোবর ২০২৫, বুধবার, ১১:৩৫:৪০ অপরাহ্ন


কঠোর ও জটিল চাপে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনীতি
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-১০-২০২৫
কঠোর ও জটিল চাপে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনীতি জুলাই সনদ হস্তান্তর অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন প্রধান উপদেষ্টা


একদিকে আন্তর্জাতিক হিসাব নিকাশ আর চাপ। অন্যদিকে গণভোট, লেবেল প্লেয়িং ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির প্রসঙ্গ। সব মিলিয়ে কঠোর ও জটিল চাপে অন্তর্বর্তী সরকার। 

আন্তর্জাতিক চাপ

আন্তর্জাতিক হিসাব নিকাশ চাপ উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় নতুন মাত্রা দিয়েছে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) এর একটি বিবৃতি। আইএমএফ বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণের ষষ্ঠ কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে নতুন মতামত দিয়েছে। তারা বাংলাদেশকে জানিয়ে দিয়েছে, নির্বাচিত সরকার ছাড়া ঋণের ষষ্ঠ কিস্তির অর্থ ছাড় করবে না। তাদের ভাষায় নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসতে হবে। এরপর তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করবে। এরপর চলমান সংস্কার কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি আদায় করার পরই ঋণের অর্থ ছাড় করতে চায় আইএমএফ। ষষ্ঠ কিস্তি বাবদ আইএমএফ-এর কাছ থেকে ৮০ কোটি ডলারের কিছু বেশি অর্থ পাওয়ার কথা। এতোদিন ধারণা করা হয়েছিল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার তার জাতীয় আন্তর্জাতিক ইমেজকে কাছে লাগিয়ে হয়ত আইএমএফকে রাজি করাতে পারবেন। কিন্তু এটা যে সম্ভব হচ্ছে না তা স্পষ্ট। এবং এর পাশাপাশি সরকারের ওপর একটি মানসিক চাপ তা অনেকেই মনে করেন। আর এমন চাপের খবর অনেকেই সানন্দে নিয়েছে বিশেষ করে সদ্য পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাকর্মীরা। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিকে স্বাগত জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ। 

মানবাধিকার রিপোর্ট

বাংলাদেশে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থকদের গ্রেফতারে সম্প্রতি সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ব্যবহার বাড়াচ্ছে বলে বলেছে নিউইয়র্ক-ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা এইচআরডব্লিউ। এ ব্যাপারে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, আইনটি রাজনৈতিক দমন-পীড়নের সমার্থক হয়ে উঠছে। তিনি অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, এর পরিবর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরাপদ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে মনোযোগ দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কারাগারে পাঠানো হোক অথবা শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশে বাধা দেওয়া হোক, অন্তর্বর্তী সরকারের এমন কোনো পক্ষপাতমূলক আচরণ করা উচিত নয় যা শেখ হাসিনার সরকারের সময় বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে করা হয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলি একের পর এক দাবি

এদিকে ছোট বড়ো সব রাজনৈতিক দলই এখন একের পর একের পর দাবি জানিয়ে আসছে। এর মধেই শুরু হয়েছে উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি জানানোর বিষয়টি। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠকে কয়েকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘যারা উপদেষ্টা, তাদের ব্যাপারে বলেছি, সকলের ব্যাপারে নয়। আমরা বলেছি, কিছু কিছু লোক আপনাকে (প্রধান উপদেষ্টা) বিভ্রান্ত করে। আপনার প্রতি আমাদের আস্থা আছে। কিন্তু আপনার কিছু লোক আপনার পাশে আপনাকে বিভ্রান্ত করে এবং ওরা কোনো একটা দলের পক্ষে কাজ করে আমরা মনে করি। তাদের ব্যাপারে আপনাকে হুঁশিয়ার থাকা দরকার।’

এনসিপির সাথে বৈঠকে

আগামী সাধারণ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি ও সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা করতে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নেতারা। ২২ অক্টোবর বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় পৃথক বৈঠক অনুষ্ঠানে এনসিপি ও জামায়াত নেতারা জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি, গণভোট এবং জুলাই হত্যাকান্ডের বিচারের রোডম্যাপ নিয়েও আলোচনা করেন। নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের আগে জুলাই হত্যাকান্ডের বিচারের রোডম্যাপ ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা চাই। এ বিষয়ে সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।’

বিএনপি’র দাবি

এদিকে ছোট্ট ছোট্ট দলগুলি যখন এরকর পর এক দাবি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে আসছে তখন বাংলাদেশে বর্তমানে প্রধান রাজনৈতকি দল বিএনপির নতুন আওয়াজ আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মত হয়েছে। এয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ব্যাংক ও সমমনা প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তাকে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব না দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। ২৩ অক্টোবর দলটি ৩৬ দফার প্রস্তাবনা প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের কাছে জমা দিতে গিয়ে এসব কথা বলা হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে। প্রস্তবানায় বলা হয়, নির্বাচনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বা পোলিং পারসোনাল-যেমন প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার-নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো দলীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বা কর্মচারিকে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল ও ইবনে সিনা গ্রুপের নাম উল্লেখ করা হয়। আর এমন প্রস্তাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বিএনপির দাবিকে ‘অযৌক্তিক ও অমূলক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সেবামূলক ও অরাজনৈতিক এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নির্বাচনী দায়িত্ব না দেওয়ার দাবি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অযৌক্তিক ও সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।’

ফলাফল কি দাঁড়ালো

একদিকে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম হুঙ্কার দিয়েছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) যদি শাপলা প্রতীক না দেয় তাহলে রাস্তায়। অন্যদিকে জুলাই সনদে স্বাক্ষর ঝুলিয়ে রেখে তারা। বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা পেলে জুলাই জাতীয় সনদে সই করবে এনসিপি বলে জানিয়েছেন দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন। তিনি আরেকটি খোচা মেরে বলেছেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধিত প্রস্তাব থেকে সরে এলে, সরকার লন্ডনের বৈঠকের ধারাবাহিকতায় বিএনপির কাছে ক্ষমতা হন্তান্তর প্রক্রিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হবে। অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও পীর সাহেব চরমোনাই মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, সকল রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে জুলাই সনদ হয়েছে। অথচ সেই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে তালবাহানা চলছে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে প্রয়োজনে গণভোট দিতে হবে এবং সেটা অবশ্যই নির্বাচনের আগে। কোনো দল ক্ষমতায় গিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে সেটা হবে বিরাট এক শুভঙ্করের ফাঁকি।

তবে ঐকমত্য কমিশন সূত্রে বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ ২০২৫-এর খসড়া করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ভোটের অনুপাত (পিআর) পদ্ধতিতে আগামী সংসদে উচ্চকক্ষ গঠনে আদেশে বিশেষ শর্ত থাকবে। গণভোটে আদেশ পাস হলে সংবিধান সংস্কার পরিষদ উচ্চকক্ষ গঠনের অনুমোদন দেবে। যদিও বিএনপি পিআরের ঘোর বিরোধী। জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল পুরো নির্বাচনে পিআর চাইলেও তারা এবং এনসিপি অন্তত উচ্চকক্ষে পিআরের দাবিতে অনড়। কারো কারো এই বিরোধ জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রধান বাধা। আর সেকারণে যে আদেশে পিআর নিয়ে সংকট সমাধানে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মতামতের সমন্বয় করা হয়েছে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে। তবে ২৭ অক্টৈাবর সোমবার প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন কমিশনের অন্য সদস্যরা। প্রধান উপদেষ্টা সঙ্গে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে তৈরি করা সুপারিশের খসড়া নিয়ে আলোচনা হয়। সভাপতির মতামতের ভিত্তিতে সুপারিশের খসড়ায় সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে। তবে সর্বশেষ খবর হলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন অথবা এর আগে যে কোনো একদিন গণভোটের আয়োজন করার সুপারিশ করেছে ঐকমত্য কমিশন। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ২৮ অক্টোবর মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ। এর আগে এর আগে মঙ্গলবার সকালে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

শেষমেষ

প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের দিন অথবা এর আগে গণভোটের যে সুপারিশ ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে করা হয়েছে তা নিয়েও জটিলতা আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব বিষয়গুলি নিয়ে সরকারের ভেতরে আছে অস্থিরতা। তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে অস্থিরতা শঙ্কা কাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে সব মহলই অজানা আশঙ্কায় ভুগছে। তা না হলে কোনোই বা তারেক রহমান বলেন, ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে দল মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে কাজ না করলে সামনে আরও কঠিন সময় আসবে। নিজেদের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুড়ি করলে প্রতিপক্ষ সুযোগ পাবে। তিনি তো এই ব্যাপারে কিছুই খোলাসা করে বলেননি কে তার প্রতিপক্ষ কে কারা সে-ই সুযোগ পাবে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন শুরু না হতে কেনোই বা জামায়াতে ইসলামীরা নেতারা এই বক্তব্য দিলেন। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে তা বাতিল করা হবে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে এমন ঘোষণা চেয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা,সযা রহস্যজনক বটেও। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে দলের পক্ষ থেকে এই আহ্বান রাখা হয় বলে এক গোলটেবিল বৈঠকে এই তথ্য জানান জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের।

শেয়ার করুন