হানিফ সংকেত
তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশের জনপ্রিয়তম ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ নির্মাণ ও উপস্থাপনার মাধ্যমে সমাজ, সংস্কৃতি ও মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব রেখে আসছেন হানিফ সংকেত। টেলিভিশনের শুরুর দিনগুলোর অভিজ্ঞতা, সমাজ নিয়ে তার ভাবনা, সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের উদ্বেগ এবং নতুন প্রজন্মের প্রতি প্রত্যাশা সব মিলিয়েই তিনি এখন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘ পথচলার অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার মতো গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। এ বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির
প্রশ্ন: আপনার টেলিভিশন ক্যারিয়ারের প্রথম দিককার স্মৃতিতে ফিরে গেলে কার কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে?
হানিফ সংকেত: আমার যাত্রার শুরুতে ফজলে লোহানী ছিলেন এক আলোকবর্তিকা। তিনি শুধু লেখক বা উপস্থাপক নন একজন মমতাময়, আধুনিক, মানবিক মানুষ। টিভি সাংবাদিকতার পথিকৃৎ বললেও কম বলা হবে। দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজ করতে করতে তিনি বন্ধু যেমন হয়েছিলেন, অভিভাবকও ছিলেন। তিনি সব সময় হাসিখুশি একজন মানুষ তার সঙ্গে অসংখ্য স্মৃতি জমা আছে।
প্রশ্ন: তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ‘ইত্যাদি’ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। কীভাবে সম্ভব হলো?
হানিফ সংকেত: নব্বইয়ের দশক থেকেই আমরা অনুষ্ঠানটিকে স্টুডিওর চার দেওয়াল ছাড়িয়ে মানুষের মাঝে নিয়ে গেছি। দেশের নানা অঞ্চলে গিয়ে ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরেছি, নতুন শিল্পী উপহার দিয়েছি। ব্যাটারিচালিত টিভির সময় থেকে আজকের অনলাইন যুগ- সব সময় দর্শকের ভালোবাসা পেয়েছি। সেই ভালোবাসাই আমাদের শক্তি। আর এ দীর্ঘ পথচলায় ছিল আন্তরিকতা, কঠোর পরিশ্রম, সততা এবং মানুষের জন্য কিছু করার দায়বোধ।
প্রশ্ন: ফরম্যাট প্রায় একই থাকা সত্ত্বেও আগ্রহ কমে না এর রহস্য কী?
হানিফ সংকেত: দর্শকের মন জয় করাটাই মূল লক্ষ্য। ফরম্যাট একই হলেও প্রতিটি পর্বে থাকে নতুন বিষয়, নতুন স্থান, নতুন মানুষ। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরি বলেই দর্শকদের কাছে অনুষ্ঠানটি সবসময় সতেজ লাগে। আর প্রতি পর্বে লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি আমাদের অনুপ্রাণিত করে।
প্রশ্ন: অনুষ্ঠান তৈরির সময় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী?
হানিফ সংকেত: দর্শকের প্রত্যাশা। প্রতিবারই চেষ্টা করি আগের পর্বের চেয়ে আরো ভালো কিছু দিতে।
প্রশ্ন: সমাজের অসংগতি তুলে ধরার ভাবনা কোথা থেকে এলো?
হানিফ সংকেত: ছোটবেলায় লিখতাম। তখন থেকেই চারপাশের অনিয়ম আমাকে স্পর্শ করত। বিশ্বাস করি, সমাজের অসংগতি দূর হলে সমাজ শুদ্ধ হয়। তাই ইত্যাদিতেও অন্যায়ের বিপরীতে আলোকিত মানুষের গল্প তুলে ধরার চেষ্টা করি।
প্রশ্ন: ‘ইত্যাদি’ সমাজে কী ধরনের প্রভাব রাখতে পেরেছে বলে মনে করেন?
হানিফ সংকেত: আমরা দেশের নানা প্রান্তে গিয়ে সাধারণ মানুষের সংগ্রাম, সফলতা, অবদান তুলে ধরেছি। প্রচারবিমুখ মানুষ-যারা সত্যিকারের সমাজসেবী- তাঁদের সামনে এনেছি। তাদের কেউ কেউ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন। আবার বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরার পর কর্তৃপক্ষও বহু সমস্যার সমাধান করেছে। ইত্যাদির মাধ্যমে অনেক সামাজিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও তৈরি হয়েছে।
প্রশ্ন: আজকের সমাজে কোন বিষয়গুলো নিয়ে আপনি সবচেয়ে উদ্বিগ্ন?
হানিফ সংকেত: ধর্ষণ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, রাজনৈতিক সহিংসতা এগুলো সমাজের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ করছে। পাশাপাশি অশ্লীলতা ও অপসংস্কৃতির বিস্তারও উদ্বেগজনক। আমরা এমন এক দেশ চাই যেখানে পরিবেশ হবে শান্ত, নির্মল ও সৃজনশীলতার উপযোগী।
প্রশ্ন: আপনার অনুপ্রেরণার উৎস কী?
হানিফ সংকেত: বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে মানুষের হাসিমুখ দেখাই আমাকে অনুপ্রাণিত করে। ইত্যাদির মাধ্যমে সাহায্য পাওয়া মানুষের পরিবর্তিত জীবন আমার কাছে বড় প্রেরণা। যেমন ভাসমান স্কুলের শিক্ষার্থীদের ইঞ্জিনবোট পাওয়া কিংবা পাহাড়ি অঞ্চলে পানির ব্যবস্থা হওয়া এ রকম শত শত ঘটনা আছে।
প্রশ্ন: আপনার অগ্রাধিকার কোনটি বিনোদন, নৈতিকতা না বার্তা?
হানিফ সংকেত: প্রথমেই নৈতিকতা। তারপর তথ্যসমৃদ্ধ বার্তা। ইত্যাদি যেহেতু শিক্ষা, তথ্য ও বিনোদনের সমন্বয় তাই এই তিনটিকেই আমরা গুরুত্ব দিই।
প্রশ্ন: এখন পর্যন্ত কত জেলায় ‘ইত্যাদি’ ধারণ হয়েছে?
হানিফ সংকেত: জেলাভিত্তিকভাবে ৫১টি জেলায় হয়েছে। এখনো ১৩টি জেলা বাকি। তবে ঐতিহ্য-সংস্কৃতি বিবেচনায় অনেক জেলাতেই তিন-চারবার করে ধারণ করা হয়েছে।
প্রশ্ন: নতুন প্রজন্মের দর্শকদের জন্য কোনো পরিবর্তনের পরিকল্পনা আছে?
হানিফ সংকেত: সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা সবসময়ই সমসাময়িক বিষয় রাখি। বিভিন্ন প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করি।
প্রশ্ন: এত চ্যানেল থাকা সত্ত্বেও আপনি কেন এখনো শুধু সরকারি টেলিভিশনেই অনুষ্ঠান করেন?
হানিফ সংকেত: আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল এখানেই। তাই সম্পর্কটা আত্মিক। এটি কারো ব্যক্তিগত টিভি নয় রাষ্ট্রের। রাজনীতির বাইরে থাকতে পারি বলেই সরকার বদলালেও ‘ইত্যাদি’ বদলায় না।
প্রশ্ন: কখনো কি আপনাকে কালো তালিকাভুক্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে?
হানিফ সংকেত: ব্যক্তিগতভাবে না। তবে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক কারণে অনেক শিল্পী নিষিদ্ধ হয়েছেন। আমার অনুষ্ঠানে কিছু শিল্পীকে নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। কিন্তু আমি এমন শিল্পীদের আগেই দূরে রাখি যারা রাজনীতির সুবিধাভোগী। আমি রাজনীতি সচেতন, কিন্তু রাজনীতি করি না।
প্রশ্ন: একজন সাংস্কৃতিক কর্মী কীভাবে সমাজে প্রভাব রাখতে পারেন?
হানিফ সংকেত: প্রথমত শিল্পীকে হতে হবে সৎ ও গ্রহণযোগ্য। সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে। দেশীয় সংস্কৃতি তুলে ধরা শিল্পীর দায়িত্ব। সমাজ তখনই বদলায় যখন সবাই নিজের ক্ষেত্রটুকু সততার সঙ্গে করেন।
প্রশ্ন: অসুস্থ বিনোদনের বাড়বাড়ন্ত কীভাবে ঠেকানো সম্ভব?
হানিফ সংকেত: প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের হাতে, তাই কঠোর পদক্ষেপও প্রয়োজন।
প্রশ্ন: প্রযুক্তির যুগে শিল্প-সাহিত্য কোন চ্যালেঞ্জে পড়েছে?
হানিফ সংকেত: মানুষের মনোযোগ কমে যাচ্ছে, খারাপ কনটেন্ট দ্রুত ছড়াচ্ছে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জের মধ্যেও নতুন সম্ভাবনা আছে। দায়িত্বশীল গণমাধ্যম ও সচেতনতা দরকার।
প্রশ্ন: অনেকে বলেন সংস্কৃতির জগত অবক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে। আপনার মত?
হানিফ সংকেত: এখন ভিউ ও আয়ের লোভে নিম্নমানের বিষয়ও ‘কনটেন্ট’ হয়ে যাচ্ছে। ভাইরালের নামে যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। গালি এখন শিল্প ভাবা হচ্ছে। সুস্থ লেখা বা নান্দনিক ভিডিও ভাইরাল হয় না অশ্লীলতাই ছড়াচ্ছে দ্রুত। তরুণদের জন্য এটি ক্ষতিকর।
প্রশ্ন: আগামী প্রজন্মের জন্য আপনার বার্তা কী?
হানিফ সংকেত: তরুণরাই জাতির ভবিষ্যৎ। তাঁদের প্রথম গুণ হওয়া উচিত সততা। সৎ তরুণেরা সব অনিয়মকে প্রতিহত করে দেশকে এগিয়ে নিতে পারবে।
প্রশ্ন: অনেকে বলেন আপনার কোনো উত্তরসূরি নেই। এর দায় কি আপনার?
হানিফ সংকেত: সব সময় সবার উত্তরসূরি থাকে না। নতুন প্রজন্মকে নিজ মেধায় নিজের জায়গা তৈরি করতে হয়। ‘অনন্যতা’ এই শব্দটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ, কাজ, সৃষ্টি সবই আলাদা। তাই উত্তরসূরি মানেই অনুকরণ নয় নিজেকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করা।