তৌকির আহমেদ
তৌকীর আহমেদ। বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত অভিনেতা, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র তিন মাধ্যমেই তার শক্ত অবস্থান রয়েছে। মানবিক গল্প বলা, সমাজ ও ইতিহাসকে গভীরভাবে অনুধাবনের মধ্য দিয়ে পর্দায় তুলে ধরাই তার নির্মাণশৈলীর মূল বৈশিষ্ট্য। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘জয়যাত্রা’ তার অন্যতম আলোচিত ও ব্যতিক্রমী কাজ। এই সিনেমাসহ নানা বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির
প্রশ্ন: একজন অভিনেতা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করার পর নির্মাণে আসার পেছনে আপনার মূল প্রেরণা কী ছিল?
তৌকীর আহমেদ: অভিনয়ের ভেতর দিয়ে আমি চরিত্রের জীবন যাপন করেছি, কিন্তু নির্মাণ আমাকে পুরো গল্পটা বলার সুযোগ দিয়েছে। সমাজ, মানুষ আর সময়কে নিজের দৃষ্টিতে তুলে ধরার তাগিদ থেকেই মূলত নির্মাণে আসা। একজন নির্মাতা হিসেবে আমি শুধু বিনোদন দিতে চাই না, বরং দর্শককে ভাবতে শেখাতে চাই।
প্রশ্ন: মুক্তিযুদ্ধের মতো সংবেদনশীল ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে আপনার দায়বদ্ধতাকে কীভাবে দেখেন?
তৌকীর আহমেদ: মুক্তিযুদ্ধ আমাদের আবেগ, আমাদের পরিচয়। এই বিষয় নিয়ে কাজ করতে গেলে সততা আর দায়বদ্ধতার কোনো বিকল্প নেই। আমি কখনোই এটাকে শুধু একটি সিনেমার বিষয় হিসেবে দেখি না। এখানে ভুল করলে সেটা ইতিহাসের সঙ্গেই অন্যায় করা হয়। তাই খুব সচেতনভাবেই আমি এই গল্পগুলো বলার চেষ্টা করি।
প্রশ্ন: একাত্তরের গল্প বলতে গেলে সাধারণত যুদ্ধের দৃশ্যই প্রাধান্য পায়। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
তৌকীর আহমেদ: আমি সবসময়ই মনে করি, একাত্তরের গল্প বলা মানেই শুধু যুদ্ধ দেখানো নয়। প্রচলিত যুদ্ধনির্ভর সিনেমাগুলোতে আমরা প্রায়ই দেখি গুলি, রক্তপাত আর অত্যাচারের দৃশ্যের আধিক্য। কিন্তু আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ছবি আরও গভীর, আরও মানবিক।
প্রশ্ন: সে কারণেই কি ‘জয়যাত্রা’য় আপনি ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন?
তৌকীর আহমেদ: ঠিক তাই। ‘জয়যাত্রা’ নির্মাণের সময় সচেতনভাবেই আমি প্রচলিত ফর্মুলা থেকে সরে এসেছি। যুদ্ধের সরাসরি দৃশ্য না দেখিয়ে দেখাতে চেয়েছি যুদ্ধের ভেতর সাধারণ মানুষের জীবন তাদের কষ্ট, না বলা ভয়, সংগ্রাম আর টিকে থাকার গল্প।
প্রশ্ন: আপনার দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত রূপটি কী?
তৌকীর আহমেদ: মুক্তিযুদ্ধ ছিল না শুধু অস্ত্রধারী যোদ্ধাদের লড়াই। এটা ছিল গ্রামের মাটি, নদীপার, ঘরছাড়া নারী-শিশু, ক্ষুধার্ত মানুষের নীরব কান্না আর মানসিক যুদ্ধেরও গল্প। মানুষের ভেতরের টানাপোড়েন, ভাঙচুর, আশা আর মানবিকতার লড়াই এসবই আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার আত্মা।
প্রশ্ন: কিন্তু বাস্তবতা হলো, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবিতে হলে দর্শক কম আসে এটা কীভাবে দেখেন?
তৌকীর আহমেদ: এটা সত্যিই দুঃখের বিষয়। প্রেক্ষাগৃহে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবির প্রতি দর্শকের আগ্রহ তুলনামূলকভাবে কম। মুক্তির পর হলে তেমন দর্শক আসে না। অথচ পরে যখন টিভিতে বা ইউটিউবে ছবিটি প্রচারিত হয়, তখন অসংখ্য মানুষ আগ্রহ নিয়ে দেখেন।
প্রশ্ন: তাহলে কি ধরে নেওয়া যায়, দর্শকের গল্পের প্রতি অনাগ্রহ নেই?
তৌকীর আহমেদ: একদমই না। আমার মনে হয়, গল্পের প্রতি মানুষের অনাগ্রহ নেই। হয়তো হলে গিয়ে এই ধরনের ছবি দেখার অভ্যাস এখনো তৈরি হয়নি। এটা একটা সাংস্কৃতিক চর্চার বিষয়।
প্রশ্ন: এই জায়গায় দর্শকের ভূমিকা কী বলে আপনি মনে করেন?
তৌকীর আহমেদ: আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের কাজগুলোকে দর্শকদেরই পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। কারণ, এটি তাদেরই ইতিহাস, তাদেরই সত্তা। নির্মাতা যতই শ্রম ও সততা দিয়ে কাজ করুন না কেন, দর্শক হলে না এলে এসব কাজ টিকে থাকবে না।
প্রশ্ন: শেষ কথা হিসেবে দর্শকদের জন্য আপনার বার্তা কী?
তৌকীর আহমেদ: মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র হলে গিয়ে দেখা এবং নির্মাতাদের পাশে দাঁড়ানো এ দায়িত্ব আমাদের দর্শকদেরই। কারণ এই গল্পগুলো শুধু সিনেমা নয়, এগুলো আমাদের অস্তিত্বের গল্প।