এমনিতেই দৈনিক ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ঘাটতি, এরপরও মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে সামিট গ্রুপ পরিচালনাধীন ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল। ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আর এলএনজি সরবরাহ ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট কমে যাওয়া। দেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন প্রতিদিন কমছে। গ্যাসনির্ভর বাংলাদেশ অর্থনীতি এখন তীব্র সংকটে। কেন কোন কৌশলের কারণে বাংলাদেশ ২০০০-২০২৪ নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধান উন্নয়ন ন্যূনতম রেখেছে এর পারফেক্ট উত্তর নেই। কেন বিকল্প জ্বালানি হিসাবে নিজস্ব আবিষ্কৃত কয়লা সম্পদ আহরণ করা হয়নি? আত্মঘাতী এ কর্মকা-ের হোতাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে? সরকারকে বিব্রত ও জনগণকে কষ্ট দেওয়ার জন্য যে বা যারাই দায়ী তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত।
গ্যাস সরবরাহ সংকটে দেশে বিরাজমান বিদ্যুৎ উৎপাদনে রীতিমত ধস নেমেছে। ঢাকায় বিদ্যুৎ মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও সারা দেশে লোডশেডিং তীব্র থেকে তীব্রতর। দেশের শিল্প কারখানাগুলো মারাত্মক বিদ্যুৎ জ্বালানি সংকটে। সিএনজি পাম্পে যানবাহনের লম্বা সারি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও মিলছে না সিএনজি। যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে সেটা অর্ধেক বা তার চেয়েও কম। জুন মাসের শুরু থেকেই সামিট পরিচালনাধীন ভাসমান টার্মিনালটি সিঙ্গাপুর আছে মেরামত কাজের জন্য। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন ১৫ জুলাইয়ের পর চালু হবে ভাসমান টার্মিনালটি। ঘূর্ণিঝড়ের সময় কাদের গাফিলতি এবং অবহেলায় নৌ-বাহিনীর জলযান ভাসমান টার্মিনালটি ক্ষতিগ্রস্ত করলো? রেমাল তো হুট করে আসেনি। দীর্ঘদিন সিগনাল দিয়েই এসেছিল। তাহলে যথাযত উদ্যোগ নিলে সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা না। টার্মিনালটি সচল না থাকায় অর্থনীতির বিশাল ক্ষতি হয়ে গেলো। বিপাকে সরকারের রাজস্ব।
টার্মিনালটি চালু থাকলেও অন্তত ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ঘাটতি থাকে। তবে পেট্রোবাংলা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বর্তমানে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুটের স্থানে ১ হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করতে পারে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বস্তিতে থাকে। তবুও অধিকাংশ সারকারখানায় গ্যাস সরবরাহ স্থগিত থাকে, শিল্প কারখানাগুলোতে থাকে তীব্র জ্বালানি সংকট। সহসা মুক্তি মিলছে না গ্যাস জ্বালানি সংকট।
জ্বালানি সংকটের জন্য ২০০০-২০২৪ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা সব সরকার সমানভাবে দায়ী। ২০০০ সালে তৎকালীন সরকার বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের আংশিক গ্যাস ভারতে পাইপলাইনে রফতানির মার্কিন কোম্পানি ইউনোকোলের প্রস্তাব অনুমোদনে অস্বীকৃতি জানানোর পর দেশের গ্যাস আহরণ এবং উন্নয়ন স্তিমিত হয়ে পরে। অন্যদিকে সুলভ মূল্যে গ্যাস-বিদ্যুৎ পাওয়ায় এবং অপেক্ষরাকৃত সুলভ শ্রমিক সুবিধার কারণে বাংলাদেশে চীন, কোরিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক শিল্পকারখানা বাংলাদেশে চলে আসে। জ্বালানি চাহিদা পুনঃপুনিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেতে থাকে। ধীরে ধীরে চাহিদা সরবরাহ ব্যাবধান বেড়ে তীব্র আকার ধারণ করলেও সরকার গ্যাস অনুসন্ধান এবং উৎপাদন কাক্সিক্ষত মাত্রায় বৃদ্ধি করেনি। এমনকি বিকল্প জ্বালানি হিসাবে নিজস্ব কয়লা সঠিক পদ্ধতিতে আহরণের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। উপরন্তু ভুল পরামর্শে বিদেশ থেকে কয়লা, এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে জ্বালানি বিদ্যুৎখাত। দুঃখজনক হলেও সত্য, ঘটনাগুলো ঘটে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সরকারের ১৬ বছরের কার্যকালে। করোনা অতিমারির প্রভাবে এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজায় গণহত্যার কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি মূল্য আকাশ ছুঁয়ে যায়। এর ধারাবাহিকতায় ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ জ্বালানি আমদানিতে মারাত্মক সংকটে পড়ে। বিদ্যমান অবস্থায় বাংলাদেশ নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর কিছু উদ্যোগ নিলেও ঘাটতি এতো বিপুল যে, কার্যক্রমগুলো থেকে সাফল্যের সম্ভাবনা সীমিত। আবার গ্যাস ঘাটতি মেটানোর জন্য এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রেও ২০২৬ র পূর্বে স্বস্তি আসার সম্ভাবনা নেই। ২০২৬ শেষ দিকে সামিট এনার্জির নতুন ভাসমান টার্মিনাল উৎপাদনে আসলে এবং এই সময়ের মধ্যে জিটিসিএল মাতারবাড়ী থেকে তৃতীয় এলএনজি পরিবহন পাইপলাইন নির্মাণ করা না পর্যন্ত এলএনজি সরবরাহ বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা নেই এটা অনেকটাই নিশ্চিত।
কুয়াকাটা উপকুল থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে গভীর সাগরে মার্কিন কোম্পানি এক্সসেলেব্রেট প্রভাবিত এলএনজি স্থাপনা থেকে ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ সাবমেরিন পাইপলাইন দিয়ে আর এলএনজি সরবরাহ আর্থিকভাবে বাংলাদেশের জন্য গ্রহণযোগ্য বিকল্প হবে। ভারত থেকে পাইপলাইনে আর এলএনজি আমদানির উদ্যোগ সঠিক মনে হচ্ছে না। এমতাবস্থায় সেরা বিকল্প বিকল্প জ্বালানি নিজস্ব কয়লা সম্পদ উত্তোলন এবং গ্যাস অনুসন্ধান এবং উন্নয়নে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবদান বাড়ানোর জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা।
উপরের কোনো কাজ বর্তমান ব্যর্থ জ্বালানি বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার পক্ষে সম্ভব নয়। সরকারপ্রধানের উচিত জ্বালানি সিন্ডিকেটের হোতাদের পরিবর্তন যোগ্য দক্ষ দেশপ্রেমিক পেশাদারদের দায়িত্ব প্রদান এবং কাজের স্বাধীনতা দেওয়া। বাংলাদেশকে উন্নয়ন ভিশন অর্জন করতে হলে অবশ্যই দীর্ঘস্থায়ী টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জন করতে হবে। আর সেটির জন্য প্রয়োজন আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক জ্বালানি ব্যবস্থাপনা।