৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৮:৩০:৩২ অপরাহ্ন


হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র না কি অন্যকিছু
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-০৮-২০২৪
হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র না কি অন্যকিছু শেখ হাসিনা


বাংলাদেশে দীর্ঘ ১৬ বছর দাপটের সঙ্গে চালিয়ে যাওয়া ক্ষমতাচ্যুত হয়ে চলে যাওয়া শেখ হাসিনা এখন ভারতে অবস্থান করছেন। গন্তব্যের গতিপথ নিয়ে নানা গুঞ্জন হলেও এখন ভারতেই মোটামুটি স্থায়ী হচ্ছেন। 

বাংলাদেশের শীর্ষ দল আওয়ামী লীগকে ফেলে জীবন বাঁচাতে চলে যাওয়া শেখ হাসিনার কী ভবিষ্যত সেটা নিয়ে দলের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা। তার চেয়েও কম আলোচনা থেমে নেই দলটির কী হবে সেটা নিয়ে। টানা ক্ষমতায় থেকে দলের ব্যাপক প্রসারও মিলেছিল। কিন্তু আপাতত সকলেই গা ঢাকা। ১৫ আগষ্ট একটা শো ডাউনের কথা শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে ঢাকায় তার ম্যুরালে এসে শ্রদ্ধাঞ্জলী দেয়া ও মৌনমিছিলের। কিন্তু সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তার দোলাচাল শুরু। কারণ গোপালগঞ্জ এবং বিভিন্ন ধরনের সরকারবিরোধী হুমকি। হুমকির প্রেক্ষিতে ১৫ আগস্টের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরানোর জন্য উত্তেজিত একদল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী যেভাবে উত্তাল করেছিলেন এবং ঢাকা খুলনা মহাসড়ক অবরোধ করেন। সে সূত্র ধরে সেনাবাহিনীর সদস্যদের ব্যাপক মারধর, অস্ত্র লুট ও তা উচিয়ে মিছিল এবং সেনাবাহিনীর গাড়ী আগুনে পুড়িয়ে দেয়া। 

ওই ঘটনায় অন্তত কয়েক হাজার সেনাবাহিনী যে অ্যাকশনে গেছেন সেটা দ্বিতীয়বার আর টু শব্দ করেনি গোপালগঞ্জ। সব নীরব ভূমিকায়। সংখ্যালঘুদের শাহবাগে জড়ো হওয়া থেকে শুরু করে চট্টগ্রামেও মিছিল বিক্ষোভ সব থেমেছে। শাসনামলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একবার বলেছিলেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলে বিএনপি এক রাতেই শেষ করে দেবে আওয়ামী লীগকে- সে তথ্য ও অশংকা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত। ১৬ বছরের শাসনামলে তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায়ে যে দুর্নীতি অপশাসন চলছিল সেটাতে দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দসহ বহু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী কেউ দেশ ছেড়েছেন কেউ লুকিয়ে বিভিন্ন নিরাপদ স্থানে। 

অপরদিকে রাষ্ট্রসংস্কারে হাত দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দেশের এমন পরিস্থিতি নিয়ে শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বেশ কয়েকবার ভিডিওতে ও নানা সংবাদমাধ্যমে নানা রকম বক্তব্য দিয়েছেন। যার একটার সঙ্গে অন্যটার মিল খুঁজে পেতে হিমশিম খেতে হতে হচ্ছে। তবে ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে এক বক্তব্য প্রচার করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্ট প্রতিবেদনে। শেখ হাসিনার বার্তা উদ্ধৃত করে দ্য প্রিন্ট প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আমি যদি যুক্তরাষ্ট্রের হাতে সেন্ট মার্টিন ও বঙ্গোপসাগর ছেড়ে দিতাম, তাহলে আমি ক্ষমতায় থাকতে পারতাম।’ এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের টানাপোড়েন চলছিল বেশ অনেক দিন ধরেই। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি বলেছিলেন, বিমানঘাঁটি করতে দেওয়ার বিনিময়ে তাঁকে সহজে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রলোভন দিয়েছিলেন এক ‘শ্বেতাঙ্গ’ ব্যক্তি। কোনো বিদেশি শক্তির দ্বারা ‘ব্যবহৃত’ না হওয়ার জন্য নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্ক করেছেন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘লাশের মিছিল যাতে দেখতে না হয়, সে জন্য আমি পদত্যাগ করেছি। তাঁরা আপনাদের (শিক্ষার্থীদের) লাশের ওপর দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল। আমি তা হতে দিইনি।’ তিনি আরও বলেন, তিনি দেশে থাকলে হয়তো আরও প্রাণহানি হতো। আরও অনেক সম্পদহানি হতো।

দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে দেওয়া বার্তায় শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসার অঙ্গীকার করেছেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আমি শিগগির ফিরব, ইনশাআল্লাহ। পরাজয় আমার, কিন্তু জয়ী হয়েছে বাংলাদেশের জনগণ। আমি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি। আপনাদের সমর্থন নিয়ে আমি এসেছিলাম, আপনারা ছিলেন আমার শক্তি। আপনারা যখন আমাকে চাননি, তখন আমি নিজে থেকে সরে গেছি, পদত্যাগ করেছি। আমার যেসব কর্মী সেখানে আছেন, তাঁরা কেউ মনোবল হারাবেন না। আওয়ামী লীগ বারবারই উঠে দাঁড়িয়েছে।’

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে যাওয়ার পর একাধিকবার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে দেখা হয়েছে শেখ হাসিনার। ভারতীয় নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক কর্তাদের সঙ্গেও কথা হয়েছে তাঁর। তবে গত ১১ আগস্ট রোববার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির জন্য তিনি আমেরিকাকে সরাসরি দায়ী করেছেন।

ওই সূত্রমতে, দেশত্যাগ করার আগে যে বক্তব্য তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে দিতে চেয়েছিলেন, তাতেও এর উল্লেখ ছিল বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, আমেরিকার কথামতো বঙ্গোপসাগরে একক আধিপত্যের জন্য সেন্ট মার্টিন দ্বীপ তাদের ছেড়ে না দেওয়ার মাশুল হিসেবে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। তিনি বাংলাদেশিদের সতর্ক করেছেন, তাঁদের ওপর মৌলবাদীরা যেন ভর না করে। শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেছেন, তিনি আবার নিজের দেশে ফিরে যাবেন। তিনি মনে করেন, আওয়ামী লীগ বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, আবারও দাঁড়াবে। তাঁর দলের বহু নেতাকে হত্যা এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার খবরে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবাদ 

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউস। সম্প্রতি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা ও দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন হাসিনা। তার ক্ষমতাচ্যুতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছে কেউ কেউ। এর জবাবে ১২ আগস্ট সোমবার হোয়াইট হাউস স্পষ্ট জানিয়েছে, হাসিনার ক্ষমতা হারানোর পেছনে কোনরকম যোগসূত্রতা নেই যুক্তরাষ্ট্রের। মার্কিন হস্তক্ষেপের অভিযোগকে তারা মিথ্যা বলে অভিহিত করেছে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র কারিন জিন পিয়ের এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা থাকার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি আরও বলেন, আমাদের আদৌ কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রকে জড়িয়ে যেকোনো খবর বা গুজব নিছক মিথ্যা। 

তবে শেখ হাসিনা পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় রোববার তার এক্স একাউন্টের পোস্টে বলেছেন, তার মা ক্ষমতা ছাড়ার বিষয়ে আগে বা পরে কোনো বিবৃতি দেননি। এসব বক্তব্যেকে মিথ্যা বলে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, হোয়াইট হাউজ বলে আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশের জনগণ ভবিষ্যৎ সরকার নির্ধারণ করেছে এবং আমরা তাদের পাশে আছি।

ভারতীয় প্রচারমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা 

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত নিয়ে ব্যাপক সোচ্চার ইন্ডিয়ান মিডিয়া। সত্য মিথ্যা জড়িয়ে যে সব রিপোর্ট তারা করে যাচ্ছে তাতে প্রতিবাদ করারও সময় নেই অবশ্য বাংলাদেশে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরা এসব রিপোর্ট বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক অবস্থায় গিয়েছে যে এটা বিবিসি ও আল জাজিরাও রিপোর্ট করেছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর ভাংচুর ও মন্দির ভাঙা নিয়ে বিভিন্ন রিপোর্ট যে অসত্য সেটাই জানান দিয়েছে বিবিসি। 

আল জাজিরাও বিভিন্নভাবে ফ্যাক্টচেক ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে খবর নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার অসত্য বয়ান সেটা জানান দেয়ায় আন্তর্জাতিক পর্যায় বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে সম্প্রীতি বিদ্যমান সেটা প্রকাশ পেয়েছে। সেই ভারতীয় মিডিয়াতেও শেখ হাসিনার পতন নিয়েও চলেছে নানা প্রতিবেদন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টমার্টিন দখল, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দিতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশকে কব্জা করা হয়েছে জাতীয় বয়ান প্রচার করে যাচ্ছে। যদিও এসব ক্রমশ কমে আসছে।

শেয়ার করুন